Sharing is caring!
আবেদীন কাদের
‘শামস আল মমীনের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর ব্যক্তিক অনুভব, চিন্তার গভীরতা, এবং ভিন্নতর প্রকাশভঙ্গি। তিনি ছন্দের সীমাবদ্ধ গণ্ডী পেরিয়ে মুক্ত আঙ্গিক ও গদ্য-কবিতার শৈলীতে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছেন, যা তাঁকে প্রচলিত ধারা থেকে আলাদা করে।’—-চ্যাটজিপিটি
হঠাৎ করে শীত নিউ ইয়র্কে জাঁকিয়ে বসেছে, প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি থেকে ফারেনহাইটে তিরিশের নীচের দিকে নেমে এসেছে। বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা। আমি শুধু সেই সব বন্ধুদের জন্য চিন্তিত ছিলাম যারা বাসে বা অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে আসবেন। আহমাদ মাযহারকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা ঠাণ্ডায় হাঁটতে হয় আবার বাস থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে আমার ঘরে আসতে হয়। ভাবছিলাম ওঁকে ফোন করি বাসে না আসতে, আমি যদি গিয়ে নিয়ে আসি! এসব নানা কথা ভাবতেই দেখি টেলিফোন বাজলো, আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে কালোয়াতি গান শুনছিলাম, মাযহার কয়েকবার দরোজায় টোকা দিয়েছেন, আমি কিছুই শুনি নি। তাই টেলিফোনে জানালেন তিনি দরোজার সামনে। আমি দরোজা খুলে দিলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, সঙ্গে কিছু বাতাস, তাই আরও বেশি ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে। আমি ওঁকে বসতে দিয়েই কফি বানাতে গেলাম যদি কফি হাতে নিলে কিছুটা ভালো লাগে! আমি আর মাযহার কথা শুরু করলাম, আমাদের সাম্প্রতিক লেখা নিয়ে যে ব্যস্ততা, সে-বিষয়েই কথা হচ্ছিলো। তবে আমি আজকাল লেখার বিষয়ের চাইতে বেশি উদ্বিগ্ন থাকি রাজনীতির হাজারটা গতি-প্রকৃতি নিয়ে। কারণ কেন জানি না, বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমের খবর দেখলে কিছুটা ভয় লাগা স্বাভাবিক। যে ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনার সরকারকে হঠাতে সক্ষম হয়েছে, তারা কি দেশের মানুষের উদ্দেশ্য বুঝতে ভুল করেছে! নাকি দেশের মানুষ যেমন এসব ছাত্র সমন্বয়কদের পরিচয় জানতে ভুল করেছে! আমি এখনও বিষয়টা নিয়ে পরিষ্কার নই। শেখ হাসিনার শাসন খুব স্বৈরতান্ত্রিক ছিলো সন্দেহ নেই, আমাদের গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম এবং রাজনীতিকদের অধিকাংশ হাসিনার শাসনকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আখ্যা দিয়েছে, তারা ব্যাখ্যা করেনি ‘ফ্যাসিবাদ’ ব্যবস্থাটা আসলে কেমন। এছাড়া জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল থেকে হাসিনার শাসন পদ্ধতি কতোটা ভিন্নরূপ হলে তা স্বৈরশাসন থেকে ফ্যাসিবাদী চরিত্রে রূপ নেয়! আমরা জানি, তিনটি জাতীয় নির্বাচন শেখ হাসিনার সময় বলা যায় বেআইনি, মিথ্যাশ্রয়ী ছিলো। অবশ্যই তা ঘৃণ্য, কিন্তু খালেদার ‘৯৬ সালের নির্বাচন কেমন ছিলো? যদি আমরা জেনারেল জিয়া ও এরশাদ আমলের নির্বাচনকে বিচারে নেই, তাহলে কেমন ছিলো সে-সব নির্বাচন। কোন আইনে জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলো? কোন আইনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলো এই সেনাপতি? এসব বিষয় কখনও বিচারের আওতায় আনা হয়নি! আমাদের জাতীয় রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করতে হলে এসব ঐতিহাসিক বিষয় সবগুলোকে কমিশন করে তদন্তের পর শ্বেতপত্র দাখিল করে ইতিহাসের জন্য পরিচ্ছন্ন করা প্রয়োজন। এর বাইরে রয়েছে দুর্নীতি করে বিদেশে টাকা পাচার, এ বিষয়টি গত তিনটি বা চারটি সরকারের আমলে কখন কতোটা হয়েছে তা অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিৎ। এমনকি আমাদের কোন সাংবাদিক বা রাজনীতিক কোনদিন একটিবারের জন্য প্রশ্ন করেন নি জেনারেল জিয়ার ছেলে তারেক জিয়া গত প্রায় দুই দশকের কাছাকাছি সময় বিলেতে বাস করেন সপরিবারে, তার বেঁচে থাকার ব্যয় মেটান যে অর্থ দিয়ে তার উৎস কী? যেহেতু তিনি বাংলাদেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের একজন, তাই সাধারণ মানুষের এই তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। কোন সাংবাদিক কোনদিন প্রতিবেদন করার প্রয়োজন বোধ করেন নি কীভাবে আমাদের রাজনীতিবিদদের জীবন নির্বাহ হয়ে থাকে!
শুধু আইনের দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক ও নৈতিক দিক থেকে শেখ হাসিনার শাসনকাল অবশ্যই খুব বিতর্কিত এবং ঘৃণার যোগ্য, সন্দেহ নেই তার শাসনকে হঠানো জরুরি ছিলো, কিন্তু তারপর নতুন সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনার পদ্ধতি কী হবে! একজন বিশাল ক্ষমতাধর উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক কী ছিলো! বর্তমান সরকারে থাকাকালীন তার কর্মকাণ্ডের তদারকি কে করেন? কার কাছে তিনি জবাবদিহি করবেন কোন অধিকারে তিনি আরেকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেয়ার অধিকার রাখেন? সাধারণ জনগণ কি এই মানুষটার ‘রাজনীতি’ জানেন! বিশেষ করে জাহানারা ইমামের রাজাকার বিরোধী আন্দোলন, রেসকোর্সের সেই গণ-আদালত এবং এ-সম্পর্কিত ঘটনাবলির সঙ্গে এই লোকটির সম্পর্ক কী ছিলো! ২০০৭/২০০৮ সালে মইনুদ্দিন ফখরুদ্দীন সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী ছিলো! তার ব্যক্তিজীবনের নৈতিক অবস্থান কেমন? এসব বিষয় আমাদের সংবাদ মাধ্যম বা সাধারণ মানুষ কি খুব বিশ্লেষণ করে দেখেন! যিনি ব্যক্তিগত জীবনে অনৈতিক বা বিশ্বাসযোগ্য না হন, তিনি কি সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবনে বিশ্বাসযোগ্য হন! এসব প্রশ্ন আমাকে আজকাল খুব ভাবায়। রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন মানুষকে নিয়োগ দেয়া কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ যার ব্যক্তিগত জীবন খুব বেশি ‘পরিচ্ছন্ন’ নয়, হোক তা ব্যক্তিগত, নারীঘটিত, প্রেম বা বিবাহঘটিত! তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা নেয়ার পর যে বিপুল সংখ্যক বিচারক ও অন্যান্য নিয়োগ দিয়েছেন তার আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি কী? তিনি শেখ হাসিনার সময়ের ‘ফ্যাসিবাদী’ আইনে নিয়োগ দিয়েছেন, নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছেন, এ বিষয়গুলো কি আমাদের সংবাদ মাধ্যম কখনও তদন্ত করার চেষ্টা করেছে? তার ক্ষমতা দখলের পর বিচার বিভাগে যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিচারের রায় বেরিয়েছে ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের বোমা বিস্ফোরণ মামলার রায়সহ তা কি স্বচ্ছ বিচার, নাকি এই বিচারের রায় রাজনৈতিক হয়েছে, জনগণের কাছে কোন সংবাদ মাধ্যম কি কখনও কিছু জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে! আসিফ নজরুল অনির্বাচিত উপদেষ্টা, তার ক্ষমতার সীমানা কখনও নির্বাচিত মন্ত্রীর সঙ্গে তুলনীয় নয়, কিন্তু গত তিন মাসে তার কার্যকলাপ ও রাজনৈতিক বক্তব্য সাধারণ মানুষের কাছে অবশ্যই বিচার্য! এখন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ। তার ডাল ও চাল কেনেন জনগণের করের টাকায়, তাই তার প্রতিটি কাজের জন্য তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। কদিন আগে একটি বিএনপিপন্থী দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সামনে এক পাবলিক অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা দেন, ‘বেঁচে থাকলে আমরা শেখ হাসিনাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছাড়বো!’ রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ একজন মানুষ একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, যিনি অনেক মামলার আসামী, তাঁর বিচার শুরুর আগে এধরণের মন্তব্য কীভাবে করেন! বিচারে তাঁর ফাঁসি হলে হবে, কিন্তু তিনি বিচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে এধরণের ঘোষণা কীভাবে দেন! বিষয়টা সমাজের বিবেকী মানুষকে চিন্তিত করতে পারে বটে! এছাড়া অন্যান্য উপদেষ্টাদের কথাবার্তা শুনলেও সন্দেহ জাগে যে দেশটি সম্ভবত একটি সরকারের অধীনে আছে যেখানে জামাতে ইসলামী বা কোন ইসলামপন্থী দলের নিয়ন্ত্রণে অনেকখানি রয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের প্রধানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দেশদ্রোহী মামলায়। আসলে কী দেশদ্রোহিতা তিনি করেছেন তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। মামলাটি করেছে আসলে একজন বিএনপি দলীয় সদস্য, যদিও এই ঘটনার পর বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। আন্দাজ করা যায় এই গ্রেপ্তারের পর ভারতে বড় প্রতিক্রিয়া হবে বাংলাদেশের এখনকার সরকার তা জানতো। তবে এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে কারও তেমন কিছু লাভ হবে মনে হয় না। কিন্তু এই উত্তেজনাটা এই সরকার চালিয়ে যাবে তাদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ফায়দা লাভের আশায়। কিন্তু শেখ হাসিনার সময় ভারতের সঙ্গে যে সমস্যাগুলো রয়েছে তা তারা কখনই মেটাবার চেষ্টা সম্ভবত করবে না। তিস্তার পানি সমস্যা, কোন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভারতীয় সাহায্য বন্ধ করে দেয়া, আদানির সঙ্গে অতিরিক্ত দামে কেনা বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল করা, শেখ হাসিনার করা ভারতের সঙ্গে অন্যান্য চুক্তি সামনে এনে সব বাতিল করা, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট বন্ধ করে দেয়া, সকল আমদানি বন্ধ বা কমিয়ে বাণিজ্য বৈষম্য নির্মূল করা, বা আমাদের রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী সব লেনদেন বন্ধ করা। এসব না করে শুধু ভারতের বিরুদ্ধে প্রচার চালালে আর কিছু হিন্দুকে হেনস্থা করলে সরকারের লাভ বেশি, বিশেষ করে কোন কোন রাজনৈতিক দলের ভোটের বাক্সের।
বিপরীতে ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা প্রচার করে তাও আমাদের জন্য খুব সম্মানের নয়। বাংলাদেশ কখনই অসাম্প্রদায়িক দেশ নয়, কিন্তু জামাত বা বিএনপির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটা প্রচার করে। বাংলাদেশে ‘৪৭ সালের পর বহুবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, পাকিস্তান আমলে একাধিকবার, ‘৬৪ সালের দাঙ্গায় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের রাস্তায় নামতে হয়েছিলো, এরশাদের আমলে বা তারপরও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, হিন্দুদের বিপুল সম্পদ ও ঘরবাড়ি পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা দখল করেছে। একমাত্র শেখ হাসিনার সরকারের সময় গোপালগঞ্জের একজন আইজিপি বেনজীর আহমেদ বিপুল পরিমাণ হিন্দুর জমিজমা দখল করে নিয়েছে, যার কোন বিচার হয়নি। ‘৪৭ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ছিলো ২২/২৩ শতাংশ, তা আজ নেমে এসেছে ৭ থেকে ৮ শতাংশে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণা করে দেখিয়েছেন এই জনসংখ্যা নিয়মিত নিম্নমুখী। এছাড়া ‘৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এ অঞ্চলে হিন্দু পরিবারের কোন সদস্য বিদেশে থাকলেই তার জমিজমাকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা দিয়ে সরকার মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেছে। ‘৭১ সালে যুদ্ধ থেকে ফিরেই বাঙালি মুসলমানরা ভারতবিরোধী প্রচারণা শুরু করেছে। এটা কিছুটা স্বার্থ সম্পর্কিত, কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক। হিন্ধুদের বিরুদ্ধে বা ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারণাটা আমাদেরকে কিছুটা ‘৭১ সালে ভারতের সাহায্য নেয়ার কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে মুক্তি দেয়। তাছাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের যে খুব খারাপ সম্পর্ক এটা প্রচার করতে পারলে আমাদের অক্ষমতার গ্লানিও কিছুটা কমে। জগতের সকল বড় দেশের সঙ্গে প্রতিবেশীদের সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য। ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসীদের যুদ্ধ হয়েছে শতাব্দী ব্যাপী, জার্মানদের সঙ্গে ফরাসীদের যুদ্ধ হয়েছে একই রকম দীর্ঘ সময়। আমাদের ‘পেয়ারা’ মার্কিনীরা মেক্সিকোর একটি অংশ টেক্সাসকে জোর করে দখল করে নিয়েছে। তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী মেক্সিকানদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আসছে। ক্যানাডিয়ানদের সঙ্গে মার্কিনীদের সম্পর্ক মহা-তেতো, কোরিয়ানদের সঙ্গে জাপানিদের সম্পর্ক আদায় কাচকলায় তা কে না জানে। ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের সম্পর্কও তাই। সুতরাং এ সম্পর্ক বিচার করা প্রয়োজন মিশেল ফুঁকোর ‘ক্ষমতা তত্ত্ব’ দিয়ে। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের বা শ্রীলঙ্কার, এমনকি নেপালের যদি ক্ষমতা ভারতের চেয়ে বেশি হতো, এ সব ক্ষুদ্র দেশগুলো যে রূপ ধারণ করতো তা সহজেই অনুমেয়। মার্কিনী মদতে পাকিস্তান গত সত্তর বছরে বার কয়েক যুদ্ধ করেছে ভারতের সঙ্গে একমাত্র প্যাঁদানি খাওয়ার জন্য, কিন্তু লাভের মধ্যে যা হয়েছে সেটা হলো আজ পাকিস্তান একটি ‘গ্যারিসন রাষ্ট্র’। বাংলাদেশ জেনারেল জিয়ার আমল থেকে সেরকম বিদেশ নীতিই অনুসরণ করে আসছে। এমনকি খালেদা জিয়ার শেষ শাসন আমলেও মনমোহন সিংকে দুই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক মিটিঙে স্যাটেলাইট ছবি উপস্থাপন করে দেখাতে হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী ইসলামী জঙ্গিদের সামরিক কার্যকলাপ চলছিলো। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলতে ভারতীয় সন্ত্রাসবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় কোন কোন সরকারের আমলে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে কথা বলেন না, কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের বিদায়ের পর কী কারণে শত শত ইসলামি সন্ত্রাসীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে সে- বিষয়ে একেবারে নীরব তিনি। আমাদের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজ, বা আমাদের স্বার্থবিরোধী কোন কাজ যেমন আমাদের সহ্য করা উচিৎ নয়, তেমনি আমাদের সরকারের মদতে ভারতের স্বার্থবিরোধী কিছু ঘটলে সেটাও ভারতকে খুব বেশি খুশি করবে না। রাষ্ট্রপরিচালনায় শেখ হাসিনা যা করেছে, বিশেষ করে ভোটাধিকার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে তা ক্ষমার অযোগ্য, তার জন্য হাসিনার বিচার হওয়া জরুরি, কিন্তু হাসিনার আগের সকল সরকার খুব গণতান্ত্রিক সরকার ছিলো তাও নয়। হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ বিপুল দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচার। এগুলো প্রচারে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিৎ সঠিক তদন্ত করে কোথা থেকে কীভাবে কত পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার শ্বেতপত্র জনগণের সামনে দাখিল করা, টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা, যেমন হাসিনা জেনারেল জিয়ার ছেলে কোকোর পাচার করা টাকা সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে দরবার করে ফিরিয়ে এনেছিলো। আমাদের শাসনতন্ত্রে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ বলে কিছু নেই, সেদিক থেকে এই সরকার শাসনতান্ত্রিকভাবে অবৈধ, কিন্তু জনগণ একে মেনে নিয়েছে। কিন্তু গত প্রায় চার মাসে এই সরকারের সাফল্য আসলে কী! একথা বিচারেরও সময় এসেছে। ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারকাজ না করে ভারত যেসব সমস্যা সৃষ্টি করছে তার সমাধান করা জরুরি। সেদিকে দৃষ্টি দেয়া অত্যাবশ্যক! সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করা সহজ, সেটা জেনারেল আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জেনারেল জিয়া ও এরশাদ সবাই করেছে। ধর্মের ঘোলাজল সৃষ্টি অতি সহজ রাজনীতিতে!
কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ধর্ম নিয়ে যা ঘটছে তা আসলে কিছুটা ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। শুরু হয়েছে ইসকনের ধর্মগুরুর গ্রেপ্তার নিয়ে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে দুই দেশের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের উস্কানিমূলক কথাবার্তার ফলে কেমন একটা তিক্ততার সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন কী চায় এই দেশ দুটির সাংস্কৃতিক কর্মী বা রাজনীতিকরা! তারা কি যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে! আমার বিষয়টা মোটেই তা মনে হয় না। কারণ যুদ্ধ করার মত রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের নেই। তাছাড়া যুদ্ধ সত্যি সত্যি বেঁধে গেলে বাংলাদেশের বিপুল ক্ষতি হবে। ভারতের যে ক্ষতি হবে সেটা যতোটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। বিশ্বের কাছে ভারতের মান বলে কিছু থাকবে না, কারণ বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ, বিশ্বের মানুষ ভাববে যুদ্ধটা ভারত লাগিয়েছে। সেই দেশই মূলত যুদ্ধের জন্য দায়ী। তাছাড়া আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন ভারতের হিন্দুত্ত্ববাদী মোদী সরকার মৌলিকভাবে কোন সেন্ট্রিষ্ট রাজনৈতিক দলের বন্ধু নয়, সে আরেকটি মৌলবাদী জামাতেরই বন্ধু। মোদীর মৌলবাদী শাসন লাভবান হয় জামাতের বা বিএনপির শাসনে, তারা অনেক বেশি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারে ভোটের বাক্সের ফায়দা কুড়াতে পারে!
রাজনৈতিক তক্কাতক্কি আমরা আড্ডায় মোটেই করতে চাই না, কিন্তু আমাদের সমস্যাটি ভিন্ন, আমরা যারা আড্ডায় বসি তারা ভীষণভাবে রাজনীতি বা আমাদের দেশের সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তাড়িত থাকি। সারাদিন আমাদের পেশাগত কাজে ব্যস্ত থাকার সঙ্গে সঙ্গে জগতের বড় সংবাদমাধ্যমগুলোতে অন্বেষণ করতে থাকি বাংলাদেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক খবর কী বেরুলো। আমাদের রাজনীতিকদের একটি বড় সমস্যা হলো তাদের অধিকাংশের পেশা ব্যবসা, তাই তারা রাজনৈতিক ‘পদ’ কেনেন বিভিন্ন দল থেকে নগদ টাকা দিয়ে। এরপর কয়েক বছর সেই লগ্নিকৃত টাকা ও মুনাফা তোলেন রাজনৈতিক দুর্নীতি করে। এদের আয়ের পথ যদি স্বচ্ছ হতো, রাজনীতি যদি তাদের পেশা হতো এবং বেঁচে থাকার জন্য স্বচ্ছ আয়ের পথ থাকতো, সঙ্গে সঙ্গে দেশে যদি দুর্নীতির কঠোর বিচার হতো তাহলে দেশের এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হতো। ‘৭২ সালের বঙ্গবন্ধুর শাসনামল থেকে আজ অবধি আমাদের সমাজে দুর্নীতি বন্ধে কোন কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ নেই। মাঝখানে সেনা শাসনামলগুলো ছিলো সত্যিই ভয়ঙ্কর। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের হার্ভার্ডে ফেলো থাকা কালীন সময়ে লেখা একটি গবেষণা প্রবন্ধ ছিলো কোন রাষ্ট্র যখন তার জাতীয় বাজেটের একটি নির্দিষ্ট শতাংশের বেশি ব্যয় হয় সেনাবাহিনীর জন্য তখন সেদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা সেনারা দখল করবেই। এটা পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের ওপর গবেষণা ও তুলনামূলক আলোচনা করে রাজ্জাক সাহেব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য ১৯৭৫ সালের পর থেকে আজ অবধি কী পরিমাণ ব্যয় হয়েছে এবং তা জাতীয় বাজেটের কত শতাংশ তা জনগণের সামনে হাজির করা সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য জরুরি! আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনী বা বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভূমিকা কী, তা গবেষকদের অন্বেষণের বিষয় হওয়াও জরুরি। এসব বিষয় নিয়ে আমরা আড্ডায় তক্কাতক্কি করছিলাম, যাতে নসরত শাহ, কবি এবিএম সালেহউদ্দীন ও লেখক আদনান সৈয়দ যোগ দেন। এসব বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার থাকি আমি ও মাযহার, কিন্তু গত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সালেহউদ্দীন, নসরত ও আদনানও বিশেষভাবে আলোচনায় যোগ দেন। বোঝা যায় আমাদের ঢাকায় যেমন অধিকাংশ লেখক সাহিত্যিক রাজনীতি দ্বারা তাড়িত, প্রবাসী লেখকরাও অনেকটাই সেরকম তাড়িত। এসপ্তাহের আড্ডার একটি দীর্ঘ সময় কাটে সাহিত্য বিষয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তির ভূমিকা, আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স ও চ্যাটজিপিটির ভূমিকা, তারা কতোটা মূল্যায়নে সক্ষম সাহিত্য বা শিল্পকলার গুণগত মান! কয়েক মাস আগে আমাদের আড্ডার সাথী ও ছোটগল্প লেখক তানভীর রব্বানী আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স বিষয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। সেই প্রথম আমি এ বিষয়ে একটি সাধারণ ধারণা পাই। আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু লেখক ও কণ্ঠশিল্পী ডঃ জীবন বিশ্বাস এ বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন, বর্তমানে একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তাঁর কাছে মাঝে মাঝে আড্ডায় আমি এই প্রযুক্তির ক্ষমতা শুনে বিস্মিত হয়েছি। কিন্তু আমি প্রযুক্তিবিমুখ মানুষ বলে এবিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করি নি। রাব্বী আমাদের আড্ডায় আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের ক্ষমতা বোঝানোর জন্য কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটি আধুনিক কবিতা তাদের দিয়ে লিখিয়ে দেখালেন। বিষাদের আধিক্য-ছোঁয়া প্রেমের কবিতা, রোমান্টিক কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য-নির্ভর কিছু দারুণ কবিতাও লিখে দেখালেন, যেগুলোকে সহজেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা বলে ভ্রম হতে পারে। এরপর রাব্বী এআই-এর সাহায্যে কিছু পেইন্টিং করে দেখালেন, যা সহজেই সালভাদর দালি বা পিকাসোর চিত্রকলা বলে সাধারণ দর্শকের ভুল হতে পারে। এই যদি হয় এ আই-এর ক্ষমতা তাহলে শিল্পসাহিত্য বা যে কোন গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডিত্যের বিষয় আজকাল এই প্রযুক্তির সাহায্যে করা সম্ভব। অর্থাৎ মানব সমাজের মেধার বিকল্প দিয়ে অধিকাংশ কাজ করা সম্ভব। মাযহার ঘণ্টা তিনেক ধরে এই এ আই- এর সাহায্যে আমাদের লেখক ও কবি সাহিত্যিকদের শিল্পকর্মের মূল্যায়ন করে দেখালেন। প্রথমেই মাযহার আমার প্রবন্ধের একাধিক বই সম্পর্কে এ আই- এর মূল্যায়ন দেখালেন। এরপর আদনান সৈয়দের লেখার মূল্যায়ন, নসরত শাহর লেখার ও এবিএম সালেহউদ্দীনের কবিতার মূল্যায়ন করে দেখালেন। বিষয়টি আমাদের মাঝে হাসির উদ্রেক করলেও কিছুটা আতঙ্কেরও সৃষ্টি করলো! মাযহার জানালেন তাঁর এক বিখ্যাত লেখক বন্ধু তাঁকে এ আই-এর করা মাযহারের লেখার মূল্যায়ন দেখে আঁতকে উঠেছেন। তিনি বলেছেন এই যদি এ আই-এর ক্ষমতা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের সমালোচকদের আর কোন প্রয়োজন থাকবে না। যদিও এসব নিয়ে আমরা আড্ডায় হাসাহাসি করেছি বটে, কিন্তু কিছুটা বিস্মিত হয়েছি এসব মূল্যায়ন দেখে।
আমার মনে হয়েছে বিভিন্ন সমালোচকদের যে মূল্যায়ন অনলাইনে রয়েছে এ আই সেগুলো নিজের ডোমেইনে কনসালট করে একটা মূল্যায়ন তৈরি করে। এ আই- এর প্রোগ্রামটা বিজ্ঞানীরা এভাবেই করেছেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু যেসকল কবি সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন কোথাও করা হয় নি, তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে এআইকে নিশ্চয় ভিন্ন পথ বেছে নিতে হয়। যাহোক, বিষয়টি কিছুটা বিস্ময় সৃষ্টি করে বৈকি! মাযহার সবশেষে কবি শামস আল মমীনের কবিতা বিষয়ে একটি মূল্যায়ন আমাদের দেখান। এছাড়া এ আই কবিতার মূল্যায়নে কোন নন্দনতত্ত্ব, প্রাচ্যের নাকি পাশ্চাত্যের, এ বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার মাযহার নেন এ আই -এর সঙ্গে, সেটিরও খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্তব্য তিনি দেখান আমাদের সামনে হাজির করে। কবি শামস আল মমীনের কবিতা বিষয়ে সাক্ষাৎকারে মাযহার চ্যাটজিপিটিকে প্রশ্ন করেন ছন্দরীতি সম্পর্কে। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এ আই জানায়, “শামস আল মমীনের কবিতা নিয়ে এরকম একটি ইংগিতের কারণ হতে পারে তাঁর লেখার ভিন্নতর শৈলী। প্রচলিত ছন্দরীতি অনুসরণ না করাটা আসলে তাঁর সীমাবদ্ধতা নয়, বরং এটি তাঁর কাব্যচর্চার একটি সচেতন প্রবণতা। শামস আল মমীনের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর ব্যক্তিক অনুভব, চিন্তার গভীরতা, এবং ভিন্নতর প্রকাশভঙ্গি। তিনি ছন্দের সীমাবদ্ধ গণ্ডী পেরিয়ে মুক্ত আঙ্গিক ও গদ্য-কবিতার শৈলীতে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছেন, যা তাঁকে প্রচলিত ধারা থেকে আলাদা করে। প্রচলিত ছন্দরীতি কবিতায় সুর ও তালের এক ধরণের গাঁথুনি দেয়, কিন্তু শামস আল মমীন তাঁর কবিতায় এই গাঁথুনির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। বরং তিনি শব্দের শক্তি, ভাবের অন্তর্নিহিত ছন্দ এবং বিষয়বস্তুর গভীরতার ওপর জোর দিয়েছেন। এটি তাঁর কবিতাকে আরও সমসাময়িক ও বহুমাত্রিক করেছে। অতএব, তাঁর ছন্দবর্জনকে সীমাবদ্ধতা না ভেবে তাঁর কাব্যিক পরীক্ষার অংশ হিশেবে দেখা উচিৎ। এটি তাঁর স্বাতন্ত্র্য এবং সাহসী কাব্যচর্চার উদাহরণ।”
রাত গভীর হয়েছে, আমরা কবিতা, এ আই-এর বিস্ময়কর ক্ষমতা ও নিজেদের মাথার কিছুটা দুলুনি নিয়ে এতোটাই সমাচ্ছন্ন ছিলাম যে টের পাই নি আড্ডার সময়ের। সবাই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন! আমি সবাইকে বিদায় দিয়ে পড়ার টেবিলে বসে জগতের বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর ও সংবাদ মাধ্যমের বাংলাদেশ বিষয়ক মন্তব্য দেখার চেষ্টা করলাম ধ্রুপদী সঙ্গীত রেকর্ডারে ছেড়ে দিয়ে!