আজ রবিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমরা অদূরদর্শী আত্ম-বিধ্বংসী পথে হাঁটছি

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৬, ২০২৪, ০৩:১৬ অপরাহ্ণ
আমরা অদূরদর্শী আত্ম-বিধ্বংসী পথে হাঁটছি

Sharing is caring!

ফরহাদ মজহার 

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন (সেডিশন ল’) ছিল উপনিবেশে জনগণের কণ্ঠরোধ করার একটি হাতিয়ার। ব্রিটিশ আমলে ১৮৭০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, যা আজও অনেক স্বাধীন দেশে টিকে আছে। বাংলাদেশেও এই আইন এখনও সক্রিয়। ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রও জনগণের কন্ঠরোধ অর্থাৎ বিবেক ও স্বাধীন চিন্তা দমন ও সভা সমাবেশ বন্ধ করার জন্য নানান ধরণের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রণয়ন ও আরোপ করেছে।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ১২৪এ বলা হয়েছে যদি কেউ কথায়, লেখায় বা অন্য কোনোভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তবে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা করা হতে পারে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ ধারা ১৬তে বলা বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা বিদ্রোহের জন্য শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ধারা ৫৭তে বলা হয়েছে ইন্টারনেট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক বক্তব্য বা তথ্য প্রচারের জন্য ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮, ধারা ২১ অনুযায়ী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক বক্তব্য বা তথ্য প্রচারের জন্য শাস্তি হতে পারে ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার সংখ্যা এবং শাস্তির পরিসংখ্যান আমার জানা নাই। তবে, বিভিন্ন সূত্র থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০টি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু মামলায় অবশ্যই শাস্তি হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যূত্থানের পরে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের বিরোধী। এই আইনের প্রয়োগ একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ বলা হচ্ছে আমরা স্বাধীন ভাবে কথা বলা কিম্বা শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশ করতে পারব না।
অথচ রাষ্ট্রের নামে নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমরা ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছি। এই জন্যই পুরানা সকল ঔপনিবেশিক ইংরেজের আইন সহ শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আইন বাতিল করে আমরা নতুন গঠনতন্ত্র (Constitution) চেয়ে আসছি। আমরা বার বার বলেছি নেলসন মান্ডেলার Truth & Juustice Commission-এর মতো আমাদেরও সত্য প্রতিষ্ঠা এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ মীমাংসার জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হোক। আমার বিভিন্ন ভিডিও বার্তায় আমি তা বলেছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় আমি আকুতি-মিনতি জানিয়েছি আমরা যেন দ্রুত একটি National Reconciliation & Reconstruction Council গঠন করি। দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে কোন নামেই Truth & Jaustice ধরনের ‘জাতীয় কমিশন’ বা ‘জাতীয় কাউন্সিল’ হতে পারে। যদি ৫ই অগাস্টের পরপরই আমরা তা করতে পারতাম আজ বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা খুবই সহজ হোত।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক সংলাপ, সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক নীতি, রীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষাই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। সরকারের উচিত রাষ্ট্রের নামে দমন পীড়ন বন্ধ করা এবং জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সাম্প্রতিক সময়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ চরম অদূরদর্শিতা। এই আইনের ব্যবহার কতটা বৈধ ও নৈতিক—তা যারপরনাই প্রশ্নবিদ্ধ। কারন তা জনগণের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ইংরেজের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের জনগণের অধিকার হরণের নিকৃষ্ট মাধ্যম। এর ফলে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনশৃংখলার পরিবেশ কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি, তেমনি এই আইনের প্রয়োগ বাংলাদেশকে বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য বিস্তারের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
আফসোস, আমরা অদূরদর্শী আত্ম-বিধ্বংসী পথে হাঁটছি।

ফরহাদ মজহার ঃ কবি, দার্শনিক