আজ বৃহস্পতিবার, ৯ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আক্রান্ত মিডিয়া অসহায় সাংবাদিক

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ৫, ২০২৫, ০৬:৫৬ অপরাহ্ণ
আক্রান্ত মিডিয়া  অসহায় সাংবাদিক

Sharing is caring!

টাইমস নিউজ

আক্রান্ত মানুষের খবর প্রচারে মিডিয়ার ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করেছি। তবে এজন্য সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকদের দোষ দেই না। যারা নিজেরা আক্রান্ত হলেও তা বলার সাহস বা সামর্থ্য রাখে না, তারা অন্যদের বিপন্ন মূক মুখে বাণী দিবে এমন আশা কেমনে করব?
২০২৪এর আগস্ট মাসে আন্দোলনকারীরা সাংবাদিকদের ধরে ধরে পিটিয়েছে। মিডিয়া কি এই মার খাওয়ার খবর প্রচার করতে পেরেছে? বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন কেন্দ্রে শত শত হামলাকারী দলবদ্ধভাবে চড়াও হয়েছে। ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে; অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিকরা নিজেদের জান নিয়ে পালিয়েছে।
আমরা এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র দেড় শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা চাপানো, কয়েকজনকে গ্রেপ্তার এবং মিডিয়া এক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল নিয়ে টুকটাক কিছু কথা বলেছি। ভেতরের নাজুক অবস্থা অপ্রকাশিত।
কয়েকদিন আগে সময় টিভির কয়েকজন সাংবাদিকের চাকরি খাওয়া নিয়ে সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর সমালোচনা হচ্ছে। অথচ এটি একদম ছোট একটি ঘটনা। আগস্টের ৫ তারিখ থেকে ওরা সংবাদ মাধ্যমের অফিসে অফিসে অভিযান চালিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ঐ যে পালিয়েছে, দ্বিতীয় দিন সেখানে ঢুকতে পারেনি। তার পদ ইতিমধ্যে দখল হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে। জীবন জীবিকা ছেড়ে পালিয়েছে সাংবাদিক। যে প্রতিষ্ঠানে যেসব সাংবাদিকের নাম ধরে ধরে মব-বাহিনী অনুসন্ধান করেছে তারা আর ফিরতে পারেনি। বহু সাংবাদিকের চাকরি গেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত টিভি টকশোগুলোতে রাজনৈতিক ভিন্নমতের দুইজন দুই পক্ষে বসতেন। এখন একপক্ষের কথা বলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের বাস্তবতা লজ্জায় বলা যাচ্ছে না। শেখ হাসিনার শাসনকালে সাংবাদিকতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এমন কোন হস্তক্ষেপ আছে যার বিরুদ্ধে আমরা কথা বলিনি বা রাজপথে দাঁড়াইনি? এখন সবাই নিরব!
যারা বাইরে থেকে সাংবাদিকদের সমালোচনা করেন তারা ভুলে যান, আর দশটা পেশার মতই সাংবাদিকতা একটি পেশা। সাংবাদিকদেরও সংসার আছে, সন্তানদের জন্য রুটিরুজির চিন্তা আছে। যদি চাকরিরই নিরাপত্তা না থাকে তবে সে স্বাধীনভাবে লিখবে কিভাবে? তদুপরি এই পেশায় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবসময় একধরনের বাড়তি ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মিডিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এর মালিকানা। মালিকদের দশরকম বিজনেস আছে। মিডিয়ার উপর হাত না দিয়ে, সরকার যদি মালিকের আর দশটা ব্যাবসার রশি ধরে টান দেয় তাহলে ঐ মালিক সবার আগে আত্মসমর্পণ করে। সে অন্যের মর্জি অনুযায়ী তার মালিকানাধীন মিডিয়ায় কর্মরত সম্পাদক বা সাংবাদিকের চাকরি খায়। মিডিয়া সরকার বা প্রভাবশালীদের অনুগত হতে বাধ্য হয়। এছাড়া স্বতস্ফুর্ত দালালি তো আছেই। পদপদবী ও প্রমোশনের আকাঙ্খা, ক্যারিয়ারে উন্নতি করার বাসনা আছে, যা শুধু যোগ্যতায় পাওয়া যায় না –বিশ্বস্ত ও অনুগত হতে হয়। কোন পেশা লোভ-লালসার ঊর্দ্ধে?
বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বিব্রত করতে চাই না। বিষয়গুলো তারাও বোঝেন। অন্যের সুখ-দুঃখের কথা বলার আগে তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানে হামলার কথা প্রচার করার কথা; আগুন দেওয়ার ভিডিওচিত্র ঘুরেফিরে দেখানোর কথা; বার বার চিৎকার করে প্রতিবাদ করার কথা। করতে পেরেছে বা পারছে কি?
নানামুখী চাপ সত্ত্বেও সাংবাদিকরা যতটুকু তুলে ধরেন তার জন্যই আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। যে সাংবাদিকতা নিজে আক্রান্ত হয়েও বোবা হয়ে থাকে, তার কাছে অপরাপর আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা বৃথা। চ্যালেঞ্জ বহুমাত্রিক। আসুন রবীন্দ্রনাথের ছন্দবদ্ধ পংক্তিমালা পাঠ করি:
“বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার; সংকুচিত ভীত ক্রীতদাস
লুকাইছে ছদ্মবেশে। ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে– ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী; স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি, যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার–
———-
এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা–
এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা–
ডাকিয়া বলিতে হবে–
মুহূর্ত তুলিয়া শির
একত্র দাঁড়াও দেখি সবে।”