Sharing is caring!
আখতারুজ্জামান আজাদ
অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন বেশকিছু প্রস্তাব দাখিল করেছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। এর মধ্যে একটি হলো— সংবিধানের চার মূল নীতির অন্যতম হিশেবে বিদ্যমান ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়া। এতে কেউ হয়েছেন উল্লসিত, কেউ হয়েছেন উৎকণ্ঠিত।
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা উচিত কি না; এই নিবন্ধে সে-প্রসঙ্গে এখনই না-যাই, গেলে শুভলগ্ন দেখে পরে যাওয়া যাবে। এর আগে স্মর্তব্য যে, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যাওয়ার প্রস্তাব যখন এল; দেশে তখন কোনো রাজনৈতিক সরকার বিদ্যমান নেই, বিদ্যমান এমন একটি সরকার— যে-সরকার রাজনৈতিকও না, নির্বাচিতও না, সামরিকও না, ধর্মীয়ও না।
দেশের ইতিহাসে এমন বেধড়ক রকমের বিচিত্র ও অকথ্য রকমের অসংজ্ঞায়িত সরকার এর আগে কখনোই আসেনি। খোদ সরকারপ্রধানকেও এই সরকারের চরিত্র জিজ্ঞেস করলে এলোমেলো উত্তর দেন, এই সরকার এতটাই চরিত্রহীন বা চরিত্রবহির্ভূত। সরকারটি পুরোপুরি সামরিক না-হলেও সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট। ২০০৭ সালের সরকারকে আধাসামরিক বা পৌনে সামরিক সরকার বললে ২০২৪-এর আগস্টপরবর্তী সরকারকে অন্তত সিকি সামরিক বলা যায়। বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বেশি সুবিধা পায় সামরিক, আধাসামরিক বা সিকি সামরিক শাসনামলে। প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আনুষ্ঠানিকভাবেই বন্ধ ছিল, উন্মুক্ত হয়েছে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে, বিকশিত হয়েছে আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। বাহাত্তরের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়েছিল যখন, তখন ছিল জিয়ার সামরিক শাসনামল; সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যখন, তখনও এরশাদের সামরিক শাসনামল; সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করার প্রস্তাব যখন এল, তখনও দেশে প্রায়-সামরিক শাসনামল। অর্থাৎ সামরিক শাসনামলেই দেশে ধর্মীয় রাজনীতির জবরদস্ত জয়জয়কার থাকে, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বেমালুম বিদায় হয়, সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মুহুর্মুহু মনোরঞ্জন হয়।
অতীতের একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি— যতই ধার্মিক, ধর্মপ্রাণ কিংবা ধর্মান্ধ হোক; বাংলাদেশের জনগণ কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে ভোট দেয় না, ভোট দেয় শেষ পর্যন্ত আওয়ামি লিগের নৌকায় বা বিএনপির ধানের শিষে। ধর্মীয় বিশ্বাসে আন্তরিকভাবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান হলেও ভোটকেন্দ্রে বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ। এ-দেশের ভোটাররা, যেকোনোভাবেই হোক, বুঝে ফেলেছেন— রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য যে-পরিমাণ শিক্ষাগত সক্ষমতা বা সাংগঠনিক শক্তি থাকতে হয়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর তা নেই। তারা জানেন, বাংলাদেশের ধর্মযাজকরা নিজ-নিজ উপাসনালয়ে উদ্ভূত বিবাদ মেটাতেই সক্ষম না, রাষ্ট্রপরিচালনা দিল্লি দূর অস্ত। তাই, তারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট না-দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকেই ভোট দেয়। বিএনপিকে, অন্তত এই লেখায়, ধর্মনিরপেক্ষ দল হিশেবেই বিবেচনা করছি। যা হোক, ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা করতে না-পারার কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো অপেক্ষায় থাকে সামরিক শাসনামলের এবং সামরিক শাসনামলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলই। উদাহরণস্বরূপ জামায়াতে ইসলামির প্রসঙ্গ টানা যায়। দেশে এই মুহূর্তে সিকি সামরিক সরকার আছে; তাই, জামায়াত এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ভোগ করছে, এত বেশি ক্ষমতা তারা চারদলীয় জোট সরকারের অংশীদার থাকাকালে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালেও ভোগ করেনি। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলেই (যে-দলই আসুক) জামায়াত আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। এজন্যই জামায়াত এখন নির্বাচন চাইছে না, বিএনপি চাইছে; কেননা, নির্বাচন হলেই জামায়াত পরাজিত হবে এবং তাদের বর্তমানকার ক্ষমতা আর থাকবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত জামায়াত, উন্মুক্ত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে (বা ভারত-পাকিস্তানে) কখনোই সুবিধা করতে পারেনি, পারবেও না। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে জামায়াত সুবিধা করতে পেরেছে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, শক্তি সঞ্চয় করেছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে, এর আগে একাত্তরে দেশব্যাপী তাণ্ডব চালিয়েছে ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে; তিনজনই ছিলেন সামরিক শাসক। এজন্যই, জামায়াত একাত্তরেও সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিল; এজন্যই, এখনও বলছে— শুধু সেনাবাহিনী আর জামায়াতই ‘দেশপ্রেমিক শক্তি’। গণসম্পৃক্ততা থাকে না বিধায় এবং যেকোনো সময়ে ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক থাকে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনে সামরিক শাসকরা উদ্গ্রীব থাকেন।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে চার মূল নীতির অন্যতম হিশেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ছিল, ছিল না কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় বাক্যের উপস্থিতি। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মপ্রবেশ শুরু হয়। শেখ মুজিবকে হত্যার খবর প্রচারের জন্য পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট খুনিচক্রের পক্ষে শরিফুল হক ডালিম যে-বেতারভাষণ দিয়েছিলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর নাম পালটে তিনি বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেন সেই ভাষণেই। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো দ্রুততার সঙ্গে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে’ স্বীকৃতি দেন এবং সৌদি আরবসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছেও পাকিস্তানকে অনুসরণের আবেদন জানান। অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদও বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রই রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় তা পেরে ওঠেননি, তাকে অটুট থাকতে হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতায়ই। মোশতাক অবশ্য বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর আদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ করেছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের নাম ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করেছিলেন, পুরুষদের জন্য জাতীয় পোশাক নির্ধারণ করেছিলেন আচকান ও জিন্নাহ্ টুপি। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলেও মোশতাক তা পেরে ওঠেননি, এর আগেই পালটা সামরিক অভ্যুত্থানে তার একাশি দিনের শাসনামলের রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। এই নিবন্ধের এই অনুচ্ছেদের সারমর্ম হলো— বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতিতে ধর্মের প্রবেশ ঘটেছিল একজন আত্মস্বীকৃত খুনির (ডালিম) মুখ থেকে এবং ঠিক একটা সপরিবার হত্যাকাণ্ডের রাতেই। বলাই বাহুল্য— সেই খুনি দেশকে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেছিলেন ধর্মের প্রতি প্রেম থেকে নয়, বরং দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার পরপর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায়ের উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ ডালিমের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পেছনে ধর্ম কাজ করেনি; কাজ করেছে হত্যাকাণ্ড, কাজ করেছে স্বার্থ, কাজ করেছে রক্তাক্ত রাজনীতি।
বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি জিয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদন করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মূল নীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়, প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং প্রস্তাবনার আগে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ যুক্ত করা হয়, ২৫(২) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়— ‘রাষ্ট্র ইসলামি সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্বসম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবে’। এই ব্যাপারগুলো বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের, নিঃসন্দেহে, যারপরনাই পছন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু এ-কথাও মনে রাখতে হবে যে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন বিপুল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে, জিয়া-সরকারের গণভিত্তি বা গণসম্পৃক্ততা ছিল না, জিয়ার আমলে সশস্ত্রবাহিনীতে নিয়মিত বিরতিতেই বিদ্রোহ হতো এবং সেসব বিদ্রোহের শাস্তি হিশেবে তিনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন হাজার-হাজার সেনাসদস্যের। জিয়াউর রহমানের প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহানুভূতি এবং মুসলমান-অধ্যুষিত আরব দেশগুলোর স্বীকৃতি। জিয়া সংবিধানে ধর্মের প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায় করে নিজের টালমাটাল সরকারকে নৈতিক ভিত্তি এনে দেওয়ার উদ্দ্যেশ্যে এবং আরব দেশগুলোর সহযোগিতা পেতে; অর্থাৎ এখানেও ধর্ম কাজ করেনি, কাজ করেছে সামরিক স্বার্থ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি।
পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যে কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করা হয়েছে আর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বা ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযুক্ত করা হয়েছে, তা-ই নয়। এই সংযুক্তিগুলো আপাত-নিরীহ হলেও আলোচ্য পঞ্চম সংশোধনী দেশের সংবিধানে যুক্ত করেছিল অত্যন্ত ভয়ংকর কিছু অধ্যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার না-হওয়ার বিধান সংবলিত যে-‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ খন্দকার মোশতাক আহমেদ জারি করেছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল এই পঞ্চম সংশোধনীরই মাধ্যমে জাতীয় সংসদে সেই অধ্যাদেশকে অনুমোদন দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেওয়া হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা, যার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বীরদর্পে ফিরে আসার সুযোগ পায় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র সহযোগিতা-করা দলগুলো। দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীরা ভোটার হতে পারবে না এবং নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না— এই মর্মে যে-অনুচ্ছেদটি সংবিধানে ছিল, এই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই সেই অনুচ্ছেদটি তুলে নেওয়া হয়। অর্থাৎ যে-সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করেছে এবং সংবিধানে বিসমিল্লাহ্ এনে দিয়েছে, দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতির সপরিবার হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য প্রণীত দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে ঐ একই সংশোধনী বৈধতা দিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদেরকে ভোটাধিকার দিয়েছে, দিয়েছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নিয়েছে এবং বিসমিল্লাহ্ ঢুকেছে যে-পথে; একই সময়ে একই পথে ঢুকেছে ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ এবং যুদ্ধাপরাধীদের ভোটাধিকার ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে আসেন আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮৮ সালের ৮ জুন তিনি সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর অনুমোদন দেন এবং সেই সংশোধনীই দেশে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করে। এ-কথা কারোই অজানা না যে, এরশাদের যাপিত জীবনে ধর্মের ছিটেফোঁটা পর্যন্ত ছিল না। বাংলাদেশের সবচেয়ে অসৎ ও লম্পট শাসক ছিলেন তিনি। লাম্পট্যের এমন কোনো শাখাপ্রশাখা নেই, যাতে তিনি বিচরণ করেননি। তবু, তিনি নিজেকে ধার্মিক হিশেবে প্রমাণ করার জন্য যারপরনাই মরিয়া ছিলেন, যাতে তার স্যাঁতসেঁতে স্বৈরশাসনের প্রতি জনসাধারণের ন্যূনতম সহানুভূতি থাকে। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে কৃত্রিমভাবে তুষ্ট রেখে নিজের ক্ষমতাকে সংহত রাখতে এরশাদ নানান ধরনের ছলচাতুরির আশ্রয় নিতেন। এরই অংশস্বরূপ তিনি রবিবারের বদলে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি বানিয়েছিলেন, প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, ধর্মীয় উপাসনালয়ের বিদ্যুৎবিল মওকুফ করেছিলেন, বায়তুল মোকাররমকে জাতীয় মসজিদ ঘোষণা করেছিলেন, রেডিও-টেলিভিশনে আজান প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন, আলিয়া মাদ্রাসার দাখিলকে এসএসসি ও আলিমকে এইচএসসির সমমান দিয়েছিলেন, এসএসসি পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন (শেখ হাসিনা যেভাবে উপজেলায়-উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দিয়ে ‘কওমি জননী’ খেতাব নিয়েছিলেন, হেফাজতে ইসলামের নেতাদেরকে দিয়েছিলেন রেলওয়ের জমি)। আগে থেকেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এরশাদ একেক শুক্রবার দেশের একেক মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যেতেন, কিন্তু গিয়ে দাবি করতেন ঐ মসজিদেই নামাজ পড়ার কথা তিনি আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছেন। এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে ছুটে যেতেন বিভিন্ন পিরের (বিশেষত আটরশি ও শর্শিনা) দরবার শরিফে। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধনির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের জুন মাসে। এরশাদ ১৯৮২ সালে ঘোষণা দেন এই নির্মাণকাজ তিনি শেষ করবেন। কিন্তু স্মৃতিসৌধের মূল নকশা থেকে তিনি ‘শিখা অনির্বাণ’ বাদ দেন ধর্মানুভূতির ধুয়া তুলে (তথ্যসূত্র— ‘বাংলাদেশী জেনারেলদের মন’, মুনতাসীর মামুন)। ১৯৮৩ সালের ১৪ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধী আবদুল মান্নানের আয়োজিত মিলাদ মাহফিলে এরশাদ বলেন— শহিদমিনারে এখন থেকে ফুল দেওয়া ও আল্পনা আঁকা চলবে না, কোরানখানি হবে (তথ্যসূত্র— ‘স্বৈরশাসনের নয় বছর’, মেজর রফিকুল ইসলাম)।
এরশাদের বিরুদ্ধে একটা ভয়ংকর অভিযোগ আছে। এরশাদের পতন ঘটেছিল ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। এর পূর্ববর্তী কয়েক মাস, খুব স্বাভাবিকভাবেই, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ ছিল; দেশজুড়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ছিল এবং সবকিছুই ছিল এরশাদের বিপক্ষে। তখন এরশাদের হাতে আসে বেশ কার্যকর একটা ধর্মকার্ড। বলাই বাহুল্য— এরশাদ সেই ধর্মকার্ড লুফে নিতে কালবিলম্ব করেননি। ব্যাপারটা খোলাসা করা যাক। ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর ভারতের অসংখ্য হিন্দু উগ্রবাদী ধাবিত হয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য, অবশ্য তখন ভাঙতে পারেনি (ভাঙতে পেরেছিল দুই বছর পর)। ইনকিলাব পত্রিকার মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যুদ্ধাপরাধী আবদুল মান্নান, যিনি ছিলেন এরশাদের মন্ত্রিসভাসদস্য। এরশাদের ইন্ধনে এই মান্নানের ইনকিলাবে ৩১ অক্টোবর আট কলামজুড়ে খবর ছেপে দেওয়া হয় যে, ভারতে হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে। ইনকিলাব পত্রিকার ঐদিনকার সংখ্যা যোগাড় করে দেখলাম, শিরোনামে লেখা হয়েছে— ‘নজিরবিহীন নিরাপত্তা, লক্ষ-লক্ষ সৈন্য মোতায়েন, ৩৬জন নিহত/ বাবরি মসজিদ ভাঙ্গিয়া মন্দির নির্মাণের চেষ্টা, অযোধ্যা রণক্ষেত্রে পরিণত’। এই সংবাদ দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে সক্ষম হয়, সেই অস্থিরতাকে পুঁজি করে এরশাদ নিজস্ব বাহিনী ব্যবহার করে প্রথমে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এবং পরে দেশজুড়ে ধর্মীয় দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেন, চেষ্টায় কিছুটা সফলও হন— অকথ্য নিপীড়ন চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর, পুলিশের উপস্থিতিতে ভাঙা হয় অসংখ্য মন্দির। কথিত দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনতে এরশাদ ঢাকায় কারফিউও জারি করেন। এই কারফিউ জারির মূল উদ্দেশ্য ছিল— এরশাদবিরোধী যে-আন্দোলন তখন তুঙ্গে উঠেছিল, সেই আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়া। কিন্তু তখন দাঙ্গা দেশব্যাপী খুব-একটা ছড়িয়ে পড়েনি, কৃত্রিম দাঙ্গা ছড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এরশাদ। ভুয়া খবর প্রচারের দায়ে, লোক দেখাতে, এরশাদ ইনকিলাবের ডিক্লেয়ারেশন প্রথমে বাতিল করেছিলেন; এক সপ্তাহ পর ডিক্লেয়ারেশন ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। অর্থাৎ এমন কোনো ফর্মুলা বাকি নেই, যে-ফর্মুলায় এরশাদ ধর্মকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির অস্ত্র হিশেবে বীভৎসভাবে ব্যবহার করেননি। ধর্মকে এত বিশ্রীভাবে ব্যবহার করেননি দেশের ইতিহাসে আর কোনো শাসকই।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। সবগুলো প্রধান দল সেই নির্বাচন বর্জন করায় এরশাদ তখন রাজনৈতিকভাবে বেশ বিপাকে ছিলেন। এর তিন মাস পর, ৭ জুন, এরশাদ সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী আনেন এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিশেবে স্বীকৃতি দেন। উপর্যুক্ত তথ্যাদি থেকে এ-কথা নিঃসঙ্কোচেই বলা যায়— এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়েছিলেন ইসলামের প্রতি প্রেম থেকে নয়; বরং নিজ দলের রাজনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য। তখনকার বিচারবিভাগ ও আইনজীবীরা এরশাদের ক্ষমতার পথের কাঁটা ছিলেন। ঐ একই সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি দেশের ছয়টা বিভাগীয় শহরে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের ছয়টা বেঞ্চ স্থাপন করেন, যাতে বিচারক ও আইনজীবীরা বিভাগে-বিভাগে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন এবং যাতে তাদের শক্তিক্ষয় হয়। বিভাগীয় শহরগুলোয় হাই কোর্ট বিভাগের বেঞ্চ বসানো যদিও সমর্থন করি, তবু জানিয়ে রাখতে হচ্ছে— বিচারবিভাগের এই বিকেন্দ্রীকরণের পেছনে এরশাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল না। বিচারবিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের পেছনেও এরশাদের অসৎ উদ্দেশ্য ছিল, অসৎ উদ্দেশ্য ছিল ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানানোর পেছনেও।
এরশাদের এই রাষ্ট্রধর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল। শেখ হাসিনা একে ‘ধর্মের রাষ্ট্রীয়করণ’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন সুযোগ পেলেই আওয়ামি লিগ ধর্ম-আইন বাতিল করবে। রাষ্ট্রধর্মপ্রণয়নকে খালেদা জিয়া অভিহিত করেছিলেন ‘ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত’ হিশেবে (তথ্যসূত্র— ৮ জুন ১৯৮৮, ইত্তেফাক)। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমান বলেছিলেন— ‘চলমান আন্দোলনে বিভক্তিসৃষ্টি ও অগণতান্ত্রিক শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিল পাশ করা হয়েছে।’ এখন জেনে অবিশ্বাস্য লাগবে— সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিলের দাবিতে বিএনপি অর্ধবেলা হরতালও ডেকেছিল (তথ্যসূত্র— ১২ জুন ১৯৮৮, দৈনিক বাংলা)। লোমহর্ষক ব্যাপার হলো— এমনকি, জামায়াতে ইসলামিও এরশাদের সেই রাষ্ট্রধর্মপ্রণয়ন মেনে নেয়নি। এক প্রেস নোটে জামায়াতে ইসলামি বলেছিল— ‘সরকার তার নিজস্ব রাজনৈতিক প্রয়োজনেই এই বিল পাশ করেছে। সরকার তার গণবিরোধী কার্যকলাপ ঢাকা দেওয়ার জন্য ইসলামের নাম ব্যবহার করেছে। ইসলাম কায়েম সরকারের উদ্দেশ্য নয়, বরং ইসলামি আন্দোলনের অগ্রগতি প্রতিহত করাই তাদের উদ্দেশ্য (তথ্যসূত্র— ১০ জুন ১৯৮৮, দৈনিক বাংলা)।’ মজার ব্যাপার হচ্ছে— ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে সভা ডেকেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ। বলাই বাহুল্য— ঐ অংশটি ছিল এরশাদের টাকায় পোষা গৃহপালিত ক্লাব। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিল সংসদে যিনি উত্থাপন করেছিলেন, কেউ দাবি করতে পারবে না— সেই মওদুদ আহমদের যাপিত জীবনও ইসলামসম্মত ছিল।
অষ্টম সংশোধনী পাশের সময়ে বরগুনার সাংসদ নুরুল ইসলাম মণি জাতীয় সংসদে বলেছিলেন— ‘যে-দেশে শতকরা পঁচানব্বইজন মুসলমান, সে-দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে, এ-রকম একটি নামকরণ করে সুড়সুড়ি দেয়ার অবকাশ কোথায়? এটা তো যেকোনো দিন সকালবেলা বলে দেওয়া যেতে পারে যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আমরা তো সেটা পালন করছি। এখানে তো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধিতা কেউ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এটাকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’ ঢাকা-৫ থেকে নির্বাচিত সাংসদ সিরাজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন— ‘আজকে নীতিগতভাবে এই বিলের বিরুদ্ধে বলতে গেলে মৌলবাদীদের চিন্তা-চেতনা বা আমাদের মোল্লাদের চিন্তা-চেতনায় এটাকে তারা কোন্ ফতোয়ায় ফেলবেন, আমি জানি না। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ঠিক যে-মুহূর্তে আমাদের সংসদে এই বিলটি এসেছে, সে-সময়ে আজকে পাকিস্তানে ইসলামি শাসনতন্ত্রের নামে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে আজকে ইসলামিকরণের যে-হাওয়া বইছে, এই হাওয়া বাংলাদেশেও এসে পৌঁছেছে। ইসলাম মানবতার ধর্ম, ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলামের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি নেই। নবি করিম সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না-করার জন্য। কিন্তু আজকে ধর্মকে বাইরে টেনে আনা হচ্ছে। এর ফলে বাইরে যে-আন্দোলন, যে-কথাবার্তা হচ্ছে, তাতে কিছুটা হলেও আমাদের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটছে।’ সম্মিলিত বিরোধীদল থেকে নির্বাচিত রাজবাড়ি-২ আসনের সাংসদ মোসলেমউদ্দিন বলেছিলেন, ‘একটি ধর্মকে জোর করে কারো ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। কাউকে বিশ্বাসী করা যায় না। কাউকে জোর করে নামাজ পড়ানো যায় না, রোজা রাখানো যায় না, হজ-জাকাত কোনোকিছুই বাধ্যতামূলক করা যায় না। এগুলো একটি মানুষের আত্মার চাহিদা এবং সেই চাহিদা মোতাবেক একটি ঐশ্বরিক শান্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ ধর্মকে অনুসরণ করে এবং তার পূর্বপুরুষ থেকে যে-ধর্মে অবস্থান করে, সেদিকেই সে প্রবাহিত হয়। তাই, আমি মনে করি যে, ইসলামধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করলেই এখানকার মানুষ নতুন করে নামাজ পড়বে না, নতুন করে মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে উঠবে না।’
রাষ্ট্রধর্ম বিলকে সরকারের ‘শেষ ট্যাবলেট’ উল্লেখ করে গাইবান্ধা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আতাউর রহমান বলেছিলেন— ‘বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারি নাই। ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করার জন্য যারা চিন্তাভাবনা-চেষ্টাচরিত্র করছেন, তারা সবাই ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য যতটুকু করা প্রয়োজন, তা তারা করতে পারেন নাই। তাই, আমরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দেখছি ঘুষ, দুর্নীতি, অনাচার, অবিচার, জুলুম, নারীনির্যাতন— এমন কোনো ব্যবস্থা নাই— যেটা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় এবং প্রশাসনে নাই। আজকে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ধর্মকে টেনে আনা হচ্ছে। আমার মনে হয়, বর্তমান সরকারের এটা শেষ ট্যাবলেট।’ রাষ্ট্রধর্ম বিলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো এবং দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা আ স ম আবদুর রব। রব বলেছিলেন— ‘পাকিস্তান ছিল ইসলামি রাষ্ট্র। সেই পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের উপর কী ধরনের অত্যাচার করেছে এই ইসলামের নামে; আমরা সবাই সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। আজ আমাদের দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার পর, এ-দেশে যে— মদ, জুয়া, জেনা, ধোঁকাবাজি, ঘুষ, মোনাফেকি, কুফরি— এগুলি কি ইসলামি মদ, ইসলামি জুয়া, ইসলামি ঘুষ, ইসলামি কুফরি ইত্যাদি হবে বলে ধরে নেব? আসলে এইসব সামাজিক অনাচার-অপকর্ম যতদিন পর্যন্ত না আমরা আমাদের সমাজ থেকে দূর করতে পারব, ততদিন পর্যন্ত ইসলামি কায়দায় টুপি পরে, চাঁদতারা লাগিয়ে, বুকের মধ্যে তাবিজের মতো আল্লাহু আকবর ঝুলিয়ে, পিঠের মধ্যে ইসলামি সাইনবোর্ড লাগিয়ে সমস্ত আকাম-কুকাম করা মানুষটা আল্লাহর খাস মুসলমান বা ইসলামের জন্য জান-কোরবান মুসলমান হতে পারে না।’ তৎকালীন সাংসদদের এই উক্তিগুলো নিয়েছি ২০২৪ সালের ১৩ জানুয়ারি বিডিনিউজে প্রকাশিত সাংবাদিক আমিন আল-রশিদের একটা লেখা থেকে।
আওয়ামি লিগ সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করেনি; যদিও শেখ হাসিনা ১৯৮৮ সালে বলেছিলেন আওয়ামি লিগ সুযোগ পেলেই সংবিধান থেকে ধর্ম-আইন তুলে নেবে। ২০১১ সালে সুযোগ পেয়েও আওয়ামি লিগ সরকার সে-পথে পা বাড়ায়নি। কেননা, এটি সহজেই অনুমেয়— এখন সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বিদায় করলে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, অপরিমেয় রক্তপাতহেতু দেশে লেগে যেতে পারে গৃহযুদ্ধও। এর প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে একটা কলামে লিখেছিলাম— ‘এই পৃথিবীতে এখন বাংলাদেশই বোধহয় একমাত্র দেশ; যে-দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মও আছে, ধর্মনিরপেক্ষতাও আছে। এর মাধ্যমে আওয়ামি লিগ ধর্মীয় গোষ্ঠীকেও বশে রাখল, ধর্মনিরপেক্ষ অংশকেও সীমিত আকারে সন্তুষ্ট রাখল। অর্থাৎ বাংলাদেশের এই না-ঘরকা না-ঘাটকা সংবিধান মাছও ধরে, পানিও ছোঁয় না; নাচতেও নামে, ঘোমটাও খোলে না; সর্প হয়ে দংশনও করে, ওঝা হয়েও ঝাড়ে। মাত্রাতিরিক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন আওয়ামি লিগ জাতিকে পৃথিবীর বিচিত্রতম সংবিধান ধরিয়ে দিয়ে এগারো বছর ধরে বসে আছে।’ ১৯৮৮ সালে সব বিরোধীদল রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করলেও এখন তারাই রাষ্ট্রধর্মের প্রধান রক্ষক, রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করলে তারাই এখন যুদ্ধ ঘোষণা করে বসবে। সময়ের আবর্তনে ও বিবর্তনে রাজনীতি যে কতটা তীব্রভাবে একশো আশি ডিগ্রি বদলে যায়, এর প্রমাণ রাষ্ট্রধর্ম ইশুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ১৯৮৮ সালের অবস্থান আর এখনকার অবস্থান। ভোল যে এরশাদ একা পালটাতেন, তা নয়; আজ এক ঢোল পিটিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘোল খাওয়ানোর জন্য আগামীকাল আরেক ঢোল পেটানোর মাধ্যমে রাজনৈতিক ঝোল খাওয়ার কাজটি বাংলাদেশের সবগুলো দলই করেছে। এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রণয়ন করেছিলেন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। তখন আওয়ামি লিগ, বিএনপি, জামায়াত রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতাও করেছিল রাজনৈতিক কারণেই। ধর্ম নয়, দুই ক্ষেত্রেই কাজ করেছে রাজনীতি।
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা উচিত কি না, শেষের দিকে সে-প্রসঙ্গে আলোচনা করতে পারি বলে লেখার শুরুতে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। বাহাত্তরের সংবিধানের দ্বাদশ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতার বর্ণনা ছিল সেরেফ এভাবে— ‘ধর্মনিরপেক্ষতা-নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা-দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ ধর্মনিরপেক্ষতা কী, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলে দেশে কী কী করা যাবে আর কী কী করা যাবে না— এর স্পষ্ট দিক্নির্দেশনা এই দ্বাদশ অনুচ্ছেদেই দেওয়া আছে। রাষ্ট্র নির্দিষ্ট একটা ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে (অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম হিশেবে ঘোষণা করে) অন্য ধর্মের মানুষদেরকে প্রকারান্তরে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে দেবে না আর রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম ব্যবহার করা যাবে না— বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার সহজতম ব্যাখ্যা এটুকুই। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো নাগরিকই, দলমতনির্বিশেষে, এটুকুর সাথে একমত হবেনই। সুস্থ-স্বাভাবিক চিন্তার কেউই চাইবেন না তার ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করুক বা এক ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্য ধর্মের লোকজনকে সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাতে। ধর্মীয়ভাবে এ-দেশে যারা সংখ্যাগুরু, ও-দেশে তারা সংখ্যালঘু; ও-দেশে যারা সংখ্যাগুরু, এ-দেশে তারা সংখ্যালঘু। সেরেফ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এ-দেশে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বানানোর আগে চিন্তা করতে হবে এই একই ধর্মের মানুষজন অন্য যে-দেশে সংখ্যালঘু, সে-দেশে অন্য কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বানালে তখন কেমন অনুভূতি হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানে পাঁচটা নতুন মূলনীতি সুপারিশ করেছে— ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’। এখানকার ‘সাম্য’ আর ‘বহুত্ববাদ’ যা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকারান্তরে তা-ই। নির্দিষ্ট একটা ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়ে দিলে রাষ্ট্রে সাম্যও থাকে না, বহুত্ববাদও থাকে না; চলে আসে একত্ববাদ, ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্র, সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একাধিপত্য। রাষ্ট্রে বহুত্ববাদ নিশ্চিত হয় তখনই, রাষ্ট্র যখন নির্দিষ্ট কোনো ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা না-দেয়। ফলে, সংস্কার কমিশন মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার আশেপাশেই ঘুরঘুর করেছে; মুখ ফুটে বলতে পারেনি যে, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম না-থাকুক, ধর্মনিরপেক্ষতাই থেকে যাক। সংস্কার কমিশনের প্রধান নিজেও যাপিত জীবনে ধর্মনিরপেক্ষ। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল রাখার প্রস্তাব তিনি কোনোভাবেই দিতে পারবেন না, সেই ক্ষমতা মেটিকিউলাস ডিজাইনাররা তাকে দেয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মের প্রবেশ ঘটেছিল যে-দুটো সংশোধনীর মাধ্যমে, সে-দুটোর দুটোই বাতিল হয়েছে। বাতিল করেছে আদালত। অর্থাৎ এই দুই সংশোধনীর মাধ্যমে যত পরিবর্তন আনা হয়েছিল, বাতিল হয়েছে সবই। শুধু রয়ে গেছে রাষ্ট্রধর্ম আর বিসমিল্লাহ্। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সংবিধান থেকে এগুলো অপসারণ এখন আর সম্ভব না। যে-রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সালে খোদ বিএনপি, এমনকি জামায়াতে ইসলামিও, আন্দোলন করেছিল; সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম না-রাখার কথা তারা এখন কল্পনাও করতে পারবে না, আওয়ামি লিগের পারার তো প্রশ্নই আসে না। কালের আবর্তে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে। তাই, ২০১১ সালে আওয়ামি লিগ সরকার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও এবং একই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা কোনোক্রমেই সম্ভব না-হলেও রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিতে পারেনি। ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলে ধর্মনিরপেক্ষ লোকজন বড়জোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর প্রতিবাদ করবেন, খানিকটা আফসোস করবেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন; এই কামনা করবেন যেন সবার শুভবুদ্ধির উদয় হয়। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিলে রাষ্ট্রধর্মের পক্ষের লোকজন দেশ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অচল করে দেবেন, চৌষট্টি জেলায় ফেলে দেবেন ছয়শো চল্লিশ লাশ, নিমিষেই পতন ঘটবে রাষ্ট্রধর্ম-বাদ-দেওয়া সরকারের। রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা— দুটোর যেকোনো একটা বাদ যেহেতু দিতেই হবে এবং রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিলে যেহেতু পৌনঃপুনিক প্রাণহানির আশঙ্কা আছে; সেহেতু সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মই থাকুক, ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায়ই হোক। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ যেহেতু সৎ, সাহসী ও সুনীতিপরায়ণ; এ-দেশে যেহেতু কোনো দুর্নীতি নেই, অনিয়ম নেই, পাপ-পঙ্কিলতা নেই; সেহেতু এ-দেশে রাষ্ট্রধর্ম ভীষণ প্রয়োজন, ধর্মনিরপেক্ষতা নিছকই নিষ্প্রয়োজন।
যা হোক, রাষ্ট্রধর্ম বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের বিশদ বিবরণ এই লেখার মূল বিষয় না। এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য কেবল এটুকু সবিস্তার জানিয়ে দেওয়া যে, এ-দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ্ এসেছে সামরিক শাসনামলে এবং এখন যে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করার সুপারিশ এসেছে, এখনও চলছে সিকি সামরিক শাসন। এখন যিনি সরকারপ্রধান; তার যাপিত জীবন মোটেই ধর্মসম্মত না, বরং ছয় মাস আগেও ওয়াজ মাহফিলে তাকে সুদখোর বলা হতো, ক্ষুদ্রঋণপ্রকল্পের মাধ্যমে নারীদেরকে ‘বেপর্দা’ করার অপরাধে তাকে নিয়মিত জাহান্নামে পাঠানো হতো। এই সরকারপ্রধানের আমলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করার সুপারিশ যে এল এবং তাতে তিনি যে সায়ও দিচ্ছেন; তা তিনি দিচ্ছেন ধর্মীয় কারণে না, রাজনৈতিক কারণে। তাকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে, তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের লোক না। নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে তিনি, তাই, নিজে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করার পক্ষে থাকছেন। সংবিধানে যিনি বিসমিল্লাহ্ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তিনিও (জিয়াউর রহমান) কাজটি করেছিলেন নিজের টালমাটাল তখতে তাউসকে শক্তপোক্ত করতে এবং ঐ বিসমিল্লাহ্র পাশাপাশি একই সংশোধনীর হাত ধরে এসেছে পনেরোই আগস্টের হত্যাকারীদের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ এবং যুদ্ধাপরাধীদের ভোটাধিকার। সংবিধানে যিনি (এরশাদ) রাষ্ট্রধর্ম এনেছেন; নিজের গদিকে নিষ্কণ্টক করতে সেই লাগামহীন লম্পট শাসক ধর্মকে ব্যবহার করেছেন কুৎসিততম উপায়ে এবং কৃত্রিম ধর্মীয় দাঙ্গা বাধিয়ে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে স্তিমিত করতে চেয়েছিলেন তার স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন। মোদ্দা কথা— এ-দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় করে যারা রাষ্ট্রধর্ম ঢুকিয়েছেন; তাদের কেউ ধর্মীয় মহাপুরুষ না, তাদের যাপিত জীবন ধর্মসম্মত না, এসবের পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল সেরেফ রাজনৈতিক। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্মের সাথে ধর্মের সম্পর্ক শূন্য, সামরিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক ভোগদখলের সম্পর্ক শতভাগ। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার হয়তো ফিরবে। হয়তো তখন ফিরবে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার-অপব্যবহার দেখতে-দেখতে মানুষ যখন ত্যক্তবিরক্ত হয়ে যাবে। মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতাকে সবিনয় নিমন্ত্রণ জানিয়ে সংবিধানে তখন আবার নিয়ে আসবে, ধর্ম পালন করবে ব্যক্তিগত পরিসরে, রুখে দেবে রাষ্ট্রধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে।
১৬ জানুয়ারি ২০২৫