আজ শনিবার, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছালেহার কালো বোরখা

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫, ০৪:৫৬ অপরাহ্ণ
ছালেহার কালো বোরখা

Sharing is caring!

অপু ইসলাম 

বৃটিশ আমলের কথা। স্কুল ছুটি হয়েছে। কুলাউড়া রেলওয়ে প্রাইমারি স্কুল থেকে ছালেহা তার বোনদের সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। অনেকটা পথ তাদের রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেটে যেতে হয়।

কুলাউড়া জংশন থেকে একটি মালবাহী ট্রেন ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছে। ছালেহা দাঁড়িয়ে লাল বগিওয়ালা মালবাহী ট্রেনের ছুটে চলা দেখতে লাগলো। ছালেহার ট্রেনের বগি গুনতে খুব ভাল লাগে। সে গুনতে শুরু করলো এক দুই তিন.. বারো তেরো..। যতক্ষন পর্যন্ত না ট্রেনের শেষ বগি ছালেহাকে অতিক্রম করলো ততক্ষণ পর্যন্ত ছালেহা বোনদের সাথে দাঁড়িয়ে রইল। এ যেন পথের পাঁচালীর দূর্গার সেই ট্রেন দেখা।
বাড়ি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ট্রেনের শব্দ ছালেহার কানে আসছিলো। ট্রেনটি লংলা স্টেশন পার করে সামনের দিকে এগিয়ে চললো। ট্রেনের শব্দও আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগলো।
বাড়ির সামনে রাস্তার মুখে বৃহৎ বটগাছ আর দীঘি পেরিয়ে ছালেহা বোনদের সাথে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছালো।

ছালেহাদের বাড়ির বিরাট নামডাক। কুলাউড়ার উছলাপাড়া খান সাহেব বাড়িকে এক নামে সবাই চিনতো। ছালেহার দাদা খান বাহাদুর মৌলবী আমজদ আলী এই পাকা বাড়িটি ১৯২৫ সালে নির্মাণ করেন। মৌলবী আমজদ আলী বৃটিশ সরকারের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিষ্ট্রেশন পদে কর্মরত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সিনেট মেম্বারও ছিলেন ছালেহার দাদা আমজদ আলী। ছালেহার দাদার বন্ধু ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ খান। অন্যদিকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও ছিলেন আমজদ আলীর খুবই বন্ধুসম। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একদা এই কুলাউড়ার বাড়িতে এসেছিলেন। তখনকার সময় কুলাউড়ায় হাতেগোনা কয়েকটি পাকা বাড়ির মধ্যে এই বাড়িটি ছিল অন্যতম।

রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার হলেও শিক্ষাদীক্ষায় ছালেহাদের পরিবার অনেক অগ্রগামী ছিল। তখনকার সময়ে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রেও তাদের পরিবারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
শিক্ষানুরাগী আমজদ আলীর বড় ছেলে অর্থাৎ ছালেহার বাবা এ এম আশরাফ আলী পেশায় ছিলেন সাব রেজিস্ট্রার। ছালেহার মায়ের নাম মনিরুন্নেছা বেগম। ছালেহারা তিন বোন আর দুই ভাই। ছালেহার পুরো নাম ছালেহা বেগম, সবাই তাকে ছালু নামে ডাকতো। বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু আর মেঝো বোন হোসনে আরা বেগম। কে জানতো বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়ে ছালেহা ও তার দুই বোন তাদের নাম লেখাবে একদিন!

বছর গড়িয়ে যায়। কুলাউড়ায় প্রাইমারী স্কুল শেষ করে ছালেহা ভর্তি হয় সিলেট অগ্রগামী স্কুলে। মেয়েদের তেমন ভাল স্কুল না থাকায় অষ্টম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় ছালেহার মায়ের মামা ফরেস্ট অফিসার মান্নান সাহেব ছালেহাকে উনার কাছে ময়মনসিংহ নিয়ে যান। ছালেহাকে ভর্তি করানো হয় ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে। কারণ ছালেহা খুবই মেধাবী ছাত্রী ছিল এবং হাতের লেখাও ছিল অত্যন্ত সুন্দর। ছালেহা ভাল রেজাল্ট করে রাতারাতি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল হয়ে যায়। ছালেহার পছন্দের বিষয় ছিল অংক। অংকে অনার্স-মাস্টার্স করার ইচ্ছা ছিল ছালেহার।

দেশ ভাগের পর ছালেহার বাবার পোস্টিং হয় সিলেট থেকে পিরোজপুরে। ছালেহার মেঝো বোন হোসনে আরা বেগম তখন পিরোজপুর আরবান গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সেই সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা দেন। তার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালনে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসের অংশ হয়ে যান হোসনে আরা বেগম।

১৯৫২ সাল। ছালেহা তখন ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ফার্স্ট গার্ল। ছালেহাকে ময়মনসিংহে থাকতে হতো স্কুলের শানকিপাড়ার ছাত্রী হোস্টেলে। মাঝে মধ্যে নানার বাসায় গিয়েও থাকতো। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাঁতারেও চ্যাম্পিয়ন হয় ছালেহা। স্কুলে এবং ক্লাসে অত্যন্ত সাহসী ও নেতৃত্ব দানকারী মেয়ে হিসেবে সবার নজর কাড়ে ছালেহা বেগম।

১৯৫২ এর ফেব্রুয়ারী মাস। ঢাকা সহ সারা দেশে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয় যা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এসে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ খবর ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। এর প্রতিবাদে সাহসী ছালেহা বেগম তার সহপাঠীদের নিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারী স্কুলের ক্লাস বর্জন করে।
এদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ও রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। ছালেহার বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। রওশন আরা ২১শে ফেব্রুয়ারী বিক্ষোভ মিছিলে সক্রিয় ভুমিকা পালন করে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন।
মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার সহ আরও অনেকে। ছালেহার বড় বোন রওশন আরা বাচ্চুও আন্দোলনে অবদানের জন্য ইতিহাসের পাতায় ভাষা সৈনিকের নাম লেখান।

ঐদিন দুপুরের পর বিভিন্ন মারফতে ঢাকায় ঘটে যাওয়া খবর ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। খবর চলে আসে ময়মনসিংহেও। ময়মনসিংহ শহরের ছাত্রজনতা এদিন সকাল থেকেই ঢাকায় কি হচ্ছে খবর জানার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ছালেহা খবর শুনে রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাতে ছালেহা একফোঁটাও ঘুমাতে পারলো না।
পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারী সকালে স্কুলের হোস্টেল সুপার কড়া নির্দেশ দিলেন কেউ যেন হোস্টেলের বাইরে পা না রাখে। কিন্তু সাহসী ছালেহাকে দমিয়ে রাখার সাধ্য কার! ছালেহা তার বান্ধবী বেলী, আছমা, শেফালী সহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠকে বসে। ছালেহা বলে আমাদের এভাবে বসে থাকলে হবে না। ঢাকায় আমাদের ভাইয়েরা গুলি খেয়ে শহীদ হয়েছে আর আমরা চুপ করে থাকবো? এর প্রতিবাদে অবশ্যই আমরা রাস্তায় নামবো। ভাইদের শোকে আমরা কালো পতাকা উড়াবো।

ছালেহা তার বান্ধবীদের নিয়ে কালো বোরখা পড়ে স্কুলের মেইন বিল্ডিংয়ের এসেম্বলি পয়েন্টে যায় যেখানে পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকা উড়ছিলো। ছালেহা প্ল্যান করলো পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে সে কালো পতাকা উড়াবে। কিন্তু এখন কালো পতাকা সে কোথায় পাবে? ছালেহার মাথায় বুদ্ধি এলো। স্কুলের পাশেই ছিল টেইলারিং দোকান। সে টেইলার মাস্টার হোসেন ভাইকে ধরে নিয়ে এলো। খুটি থেকে সে চাঁদ তারা পতাকাটি নামিয়ে ফেললো। তারপর তার পরনের কালো বোরখা খুলে হোসেন ভাইকে দিয়ে বলল, এই পতাকার মাপে বোরখা কেটে কালো পতাকা বানিয়ে দিন। টেইলার হোসেন বোরখা কেটে কালো পতাকা বানিয়ে দিলেন। ছালেহা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার জায়গায় তার কালো বোরখা দিয়ে বানানো পতাকা স্কুলে উড়ালো। ছালেহার এই কালো পতাকা ওড়ানোর মাধ্যমে যেন পাকিস্তানের কপালে এক কালো অধ্যায় রচিত হলো যার পরিসমাপ্তি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তানের কালো অধ্যায়ের পাশাপাশি ছালেহার জীবনেও যে এক কালো অধ্যায় রচিত হবে কে জানতো! কে জানতো বায়ান্নর এই সাহসীকতা ও গৌরবের ফসল কলংকের কালিমা হয়ে ছালেহা তার জীবদ্দশার পরবর্তী বায়ান্ন বছর বয়ে বেড়াবে? কে জানতো ছালেহার বড় দুই বোন ভাষা সংগ্রামে অবদান রেখে স্বীকৃতি সম্মাননা পেলেও ছালেহার জন্য অপেক্ষা করছিল অবহেলা লজ্জা আর তিরষ্কার!

সেদিন কালো পতাকা উড়ানোর পর ছালেহা তার বন্ধুবান্ধব সহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে পুরো শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে।
ছালেহার কালো পতাকা উড়ানোর ঘটনায় উত্তেজিত হয় স্কুল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন। জাতীয় পতাকা নামিয়ে কালো পতাকা উড়ানোয় রাষ্ট্রদোহীতার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে যায় ছালেহা বেগম। ছালেহা সরকারি অফিসার এর মেয়ে ও বয়স কম বিবেচনায় জেলে নেয়া হয়নি ও মারধর করেনি। স্কুল প্রিন্সিপাল ও জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ডি কে পাওয়ারের নির্দেশে ছালেহাকে স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙের জন্য কঠিন শাস্তিস্বরূপ তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার তথা রাস্টিকেট করার ঘোষণা দেয়া হয়।
লজ্জায় গ্লানিতে তখন ছালেহা বেগমের মনে হয়েছিল ভাষা শহীদ ভাইদের মত গুলি খেয়ে মরে যাওয়াই ভাল হতো। কালো পতাকা উত্তোলনের দায়ে স্কুল ত্যাগের মত এত বড় লজ্জা মাথা পেতে নিতে হতো না। এই লজ্জা প্রাণত্যাগ এর চেয়েও কষ্টের মনে হয়েছিল ছালেহার।

ছালেহা বেগমকে ২৫ ফেব্রুয়ারী স্কুল ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রম্মপুত্রের জলধারার মত ছালেহার দুচোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়লো। ছালেহা ফিরে যায় বাবা মা’র কাছে। ছালেহার স্কুল থেকে বহিষ্কার পরিবার মেনে নিতে পারেনি। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ছালেহা ভীষণ তিরস্কার পায়। ছালেহার কারণে পরিবারের মুখে যেন চুনকালি পড়লো। যেন সমাজের কাছে তার পরিবারকে ছালেহা কলংকিত করলো। ছালেহার নাম বদলিয়ে বিভিন্ন স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করা হলো কিন্তু কোন লাভ হলো না। কারণ ঐ সময় কয়েকটা পত্রিকায় ছালেহার ঘটনাটি ছাপা হয়ে যায়। এছাড়া ছালেহার বহিষ্কারাদেশ সারাদেশের স্কুলের জন্য প্রযোজ্য ছিল। তাই ছালেহা আর কোন স্কুলেই ভর্তি হতে পারলো না। এদিকে তিন বছর বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে জুনিয়রদের সাথে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মত মনমানসিকতা ও পরিবেশ ছালেহার আর ছিল না। তাই এখানেই ছালেহার শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি হয়ে যায়।

পরিবারের পক্ষ থেকে ছালেহার এই গৌরবোজ্জ্বল অবদানকে হেয় করা এবং আত্মীয় স্বজনদের কটুকথা ও প্রশ্নের বানে দিন দিন ছালেহার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠলো। ‘সবাই পড়াশোনা করছে তুমি করছো না’, এরকম কথার তীর প্রতিদিন ছালেহার বুকে এসে বিঁধতো। কোন আত্মীয় ছালেহাদের বাড়ি বেড়াতে এলে ছালেহা ধানের ডোলের ভিতর লুকিয়ে থাকতো। আত্মীয়দের বলা হতো ছালেহা স্কুলে। আত্মীয়রা বিদায় না নেয়া পর্যন্ত সন্ধ্যা অব্দি না খেয়ে ডোলের ভিতর পড়ে থাকতো ছালেহা। আত্মীয়রা চলে যাওয়ার পর বের হয়ে আসতো। একধরনের শারীরিক ও মানসিক ট্রমার মধ্যে ছালেহার দিন কাটতে লাগলো।

পরিবার থেকে ছালেহাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও ছালেহা বোনেদের মধ্যে ছোট। পরিবার চাচ্ছে আপদ বিদায় হোক। ছালেহাকে বিদায় না করলে তার বড় দুই বোনের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে! তার আগে ছালেহার বড় বোন সহ পরিবার ছালেহাকে কোরআন শরীফ ছুঁইয়ে শপথ পড়ান যে আজকের পর থেকে ছালেহা তার স্কুলে ঘটে যাওয়া এই লজ্জাজনক ও কলংকময় ঘটনা ভুলে যাবে, জীবনেও কারো সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা বলবে না। সে যেন তার বহিষ্কারাদেশ, কালো পতাকা ওড়ানো ইত্যাদি বিষয়গুলো তার বুকের ভেতর কবর দিয়ে ফেলে। পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে ছালেহা কারো কাছে তার এই ঐতিহাসিক গৌরাবোজ্জ্বল অবদানের কথা আর কোনদিন প্রকাশ করেনি। অথচ ছালেহার বড় দুই বোনেরও ভাষা সংগ্রামে অবদান ছিল কিন্তু তারা তাদের ছোট বোনকে তার অবদানের জন্য মোটেও মূল্যায়ন করেননি। পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়ায় ছালেহা একধরনের অবিচারের শিকার হয়।

ছালেহা বেগমের বিয়ে হয়ে যায় কিশোরগঞ্জের সৈয়দ আবদুল আহাদ মশকুর এর সাথে। আব্দুল আহাদ পেশায় ছিলেন চলচ্চিত্র গবেষক, সাংবাদিক ও লেখক। ছালেহার স্বামীর পরিবারও কিশোরগঞ্জের অন্যতম পরিবারগুলোর একটি। সৈয়দ আব্দুল আহাদ ছিলেন হযরত শাহজালাল (রা) এর ৩৬০ আউলিয়াখ্যাত আউলিয়া হযরত সৈয়দ হামজা (রা) এর বংশধর। কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত পাগলা মসজিদ যার নামে হয়েছে সেই দেওয়ান জিলকর দাদ খান ওরফে পাগলা সাহেব ছালেহার স্বামীর পূর্বপুরুষ। কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠও ছালেহার স্বামীর পূর্বপুরুষের দান কৃত জায়গা।
বিয়ের পর ছালেহা চলে যান স্বামীর কর্মস্থল উত্তরবঙ্গে। উনার দিন কাটে রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া সহ স্বামীর মায়ের বাড়ি কিশোরগগঞ্জের হয়বৎ নগর দেওয়ান বাড়িতে। বাবার বাড়ি কুলাউড়ায় যাওয়া আসা করতেন প্রায়ই। বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, বৃদ্ধ মা ও ছোট ভাইদের দেখাশোনাও করতেন ছালেহা। সংসার জীবনে ছালেহা চুপ করে থাকলেও মন থেকে তার সেই ময়মনসিংহের গৌরবময় ঘটনা মুছতে পারেন না। সেই কথা মনে হলেই চুপিচুপি কাঁদতেন।

ছালেহার লেখাপড়া দশম শ্রেণীতে বন্ধ হয়ে গেলেও আমরা জেনেছি ছালেহা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বুকে শত বেদনা বয়ে নিয়েও সেই মেধাকে কাজে লাগাতে ছালেহা কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চার বছর বিনা বেতনে পড়িয়েছেন। কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি তখন ছালেহার দাদাবাড়ির সামনের বৈঠকখানায় অস্থায়ীভাবে শুরু হয়। ছালেহা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে আসতেন। এদিকে কুষ্টিয়া থাকাকালীন কুষ্টিয়া চাঁদ সুলতানা হাই স্কুলেও ছালেহা দুই বছর চাকুরী করেছেন। মেট্রিক সার্টিফিকেট না থাকায় সেই চাকুরীটি আর স্থায়ী হয়নি। অন্যদিকে পারিবারিক বিভিন্ন মামলা মকদ্দমা করতে করতে আইনি বিষয়েও ছালেহা পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এছাড়া কিশোরগঞ্জে খরমপট্রি এলাকায় কিশোরগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাতেমা ইসলামের বাসার বৈঠকখানা ও বারান্দা ব্যবহার করে ছালেহা বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলেন যেখানে বিনা বেতনে এলাকার মহিলারা পড়তে আসতেন। পাশাপাশি নারীদের নিয়ে হস্তশিল্প, পোশাক তৈরী ও সেলাইয়ের কাজও করতেন।

ষাট এর দশকে কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের খোলা জায়গাটিতে বাজার বসানোর সিদ্ধান্তে অন্যান্য অনেকের সাথে ছালেহা বেগমও তার প্রতিবাদ করেন। ছালেহা চিন্তা করলেন এখানে বাজার বসলে বিভিন্ন মানুষের সমাগমে স্কুলের মেয়েদের ক্লাস করতে অসুবিদা এবং প্রাইভেসি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ছালেহা তার বোন সহ কুলাউড়ার অনেক শিক্ষানুরাগী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে সিলেটের তৎকালীন স্কুল ইন্সপেক্ট্রেস শামসি খানমের সাথে কথা বলেন। শামসি খানম ছিলেন সিলেটের অন্যতম ব্যক্তিত্ব বেগম সিরাজুন্নেসার পুত্রবধূ ও রাজনীতিবিদ হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর ভাই কায়সার রশিদ চৌধুরীর স্ত্রী। শামসি খানমের হস্তক্ষেপে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের সেই খোলা জায়গাটি বাজারের পরিবর্তে ছেলেদের ফুটবল খেলার জন্য এনসি হাই স্কুলের মাঠ হিসেবে বরাদ্ধ হয়। এখন পর্যন্ত এই মাঠটি কুলাউড়া শহরের একমাত্র খেলার মাঠ।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছালেহা ভুমিকা পালন করেন। যুদ্ধের সময় ছালেহা ছিলেন বাবার বাড়ি কুলাউড়ায়। সেই সময় পাকিস্তানি আর্মিকে হটিয়ে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প করে কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছালেহা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খিচুড়ি রান্না করে পাঠাতেন। গাছের ফলমূল এবং পিতলের কলস ও জগ ভর্তি পানি ছোট ভাইকে দিয়ে পাঠাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

কুলাউড়া উছলাপাড়ায় ছালেহাদের পৈতৃক বাড়ি

ছালেহার চার সন্তান। দুই ছেলে দুই মেয়ে। ছালেহা তাঁর মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। দু:খের বিষয় ছালেহা তার জীবদ্দশায় ছেলেমেয়েদেরও তার জীবনের সেই গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা বলেননি কখনো।ছালেহার ছেলেমেয়েরা জানতো তাদের খালা ভাষা সৈনিক ছিলেন। তারা তাদের খালাকে নিয়ে গর্ব করতো। অথচ তাদের মা ছালেহা বেগমও যে একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন সেই তথ্যটি তাদের কাছে গোপনই রয়ে গেল। ঘরোয়া পারিবারিক আলাপে অনেক সময় তাদের মা এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তাদের খালা ছালেহা বেগমকে চুপ করিয়ে দিতেন। তখন ছালেহা বেগমের ছেলেমেয়েরা অতটা বুঝতো না যে কেন মাকে চুপ করিয়ে রাখা হচ্ছে। ছালেহা বেগমের ছেলেমেয়েরা যখন কোন সিনেমা দেখতে যেত তখন ছালেহা বেগম তাদের বলতেন, তোরা কি আর সিনেমা দেখবি, আমার জীবনটাই তো একটা সিনেমা। একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে ছেলে মেয়েরা দেখতো ছালেহা বেগম একা একা ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যাচ্ছেন। কাউকে সঙ্গে করে নিতেন না। পরিবার ছালেহা বেগমকে যে শপথ করিয়েছিলেন সে শপথ ছালেহা বেগম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন। এমনকি তার ছেলেমেয়েদের কাছেও তিনি কখনো প্রকাশ করেননি যে তিনি ভাষা আন্দোলনে অবদান রেখেছিলেন।

২০০৪ সাল। বায়ান্ন বছর ধরে বুকে কবর দেয়া ছালেহা বেগমের সেই গৌরব উজ্জ্বল ভাষা সংগ্রামের অবদান যা তার জীবনে কলঙ্কের রূপ ধারন করেছিল, তা তার বুকের ভিতরে রেখেই ছালেহা তাঁর বাবার বাড়ি কুলাউড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্বামীর ইচ্ছায় কিশোরগঞ্জে তাদের পাঁচশো বছর পুরনো মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে ছালেহা বেগমকে কবর দেয়া হয়। দু:খের বিষয় ছালেহা বেগমের মৃত্যুর পরও তার সন্তানদের ছালেহার সেই ভাষা সংগ্রামের কথা পরিবারের কেউ কখনো বলেনি।

২০১৯ সাল। ছালেহা বেগমের মৃত্যুর পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে। ছালেহা বেগমের বড় বোন ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু এ বছর মারা যান। রওশন আরা বাচ্চুর মৃত্যু পরবর্তী জন্মদিন উৎসব আয়োজন হয় ঢাকার মিরপুরের বাসায়। সেখানে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সহ পরিবার আত্মীয়স্বজন, ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ছালেহার বড় ছেলে শাকিল ও ছোট মেয়ে ফরিদা। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে রওশন আরা বাচ্চুর মেয়ে তুনা তার মা সম্মন্ধে বলতে গিয়ে একটি কথা বললেন ‘আমার মা খালারা তিনজনই ভাষা সৈনিক ছিলেন’। কথাটি শুনে ছালেহার বড় ছেলে শাকিলের মনে একটা ধাক্কা লাগলো। শাকিল চিন্তা করলো আমার খালাতো বোন এ কথা কেন বললো! অনুষ্ঠান শেষে শাকিল ও ফরিদা তাদের খালাতো বোন তুনার কাছে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে তুনা বললেন আমি তো ভেবেছি তোমরা তোমাদের আম্মার বিষয়ে সবকিছু জানো। তুনা শাকিল এর হাতে কয়েকটি কাগজ ধরিয়ে দেন। কাগজগুলো একটি বইয়ের ফটোকপি ছিল। কাগজগুলো দিয়ে তুনা বললেন এই নাও শাকিল এই কাগজগুলোতে আমার খালা তথা ছালেহা বেগমের ভাষা সংগ্রামের বিস্তারিত রয়েছে। দেখো তোমরা তোমাদের আম্মার জন্য পারলে কিছু একটা করো। শাকিল আর তার বোন কাগজগুলো পড়ে তাদের মা ছালেহা বেগমকে নতুন রূপে আবিষ্কার করলো। কাগজগুলোতে লেখা ছিল কিভাবে তাদের মা ছালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুল থেকে ভাষা সংগ্রামে নিজের বোরখা কেটে কালো পতাকা উড়িয়ে স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন এবং সেই অপবাদ সারা জীবন লুকিয়ে রেখে, নীজের জীবনের সব স্বপ্নকে কবর দিয়ে একা একা কষ্ট পেয়েছেন।

শাকিল আর ফরিদা তাদের খালার বাসা থেকে সিএনজি করে আসার সময় সারা রাস্তা দুজনে কেঁদেছে। তাদের মা সারা জীবন এত কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু মুখ ফুটে কখনো কিছুই বলেননি। মায়ের জীবনে এত বড় অবদান ছিল! অথচ এই গৌরবোজ্জ্বল অবদানকে কলংকের বোঝা স্বরুপ মা সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। ফরিদা বলল ভাইয়া তুমি তো লেখালেখি করো, তুমি আম্মাকে নিয়ে লেখো। পরদিন থেকে শাকিল ও ফরিদা তাদের মা ছালেহা বেগমের ব্যাপারে তত্ত্ব-উপাত্ত ও ইতিহাস খোঁজাখুঁজি শুরু করতে লাগলেন।

খালাতো বোন তুনা যে কয়টি কাগজ শাকিলকে দিয়েছিলেন তা ছিল গবেষক লেখক তাজুল মোহাম্মদ এর ‘সংগ্রামী সাত নারী’ বইয়ের। শাকিল তাজুল মোহাম্মদ এর সাথে যোগাযোগ করে আরও অনেক লেখক, গবেষক ও বইয়ের সন্ধান পান যেখানে ছালেহা বেগমের ভাষা সংগ্রামের কথা লেখা রয়েছে যার মধ্যে প্রফেসর আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার ও মৃদুল রায় এর ‘ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’, তুষার আব্দুল্লাহ এর ‘ভাষাকন্যা’, গবেষক সুপা সাদিয়ার লেখা সহ আরও অনেক বই ও জার্নাল। এদিকে ভারতের জারকান্দ ইউনিভার্সিটিতে কানিজ ফাতেমা নামে এক স্টুডেন্ট তার পিএইচডি রিসার্চে ছালেহা বেগমের স্টোরি দিয়ে স্কলারশিপ পায়। অনলাইনে সার্চ দিয়েও শাকিল তার মায়ের অনেক তথ্য পেলেন। শাকিল চিন্তা করলেন তার মা ছালেহা বেগমকে নিয়ে কত গবেষক, কত লেখকের বই বেরিয়েছে অথচ আমরা তার সন্তানেরা মা এর এই অবদান সম্মন্ধে কিছুই জানি না! শাকিল ও ফরিদা পণ করলেন যেভাবেই হোক ছালেহা বেগমের সেই স্কুলের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করাবেন এবং মরনোত্তর হলেও তাদের মা’কে সেই অপবাদ থেকে কলংক মুক্ত করবেন। তারা তাদের আম্মার অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আবেদন জানাবেন।

সকল তথ্য উপাত্ত ও বইপত্র নিয়ে শাকিল ও ফরিদা ছুটে গেলেন ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে। প্রধান শিক্ষকের সাথে বিস্তারিত কথা বললেন। তারা প্রধান শিক্ষকের কাছে থেকে ছালেহা বেগমের রেকর্ড ও নথিপত্র চাইলেন এবং বললেন স্কুল থেকে যেন ছালেহা বেগমের নামে একটি প্রত্যয়ন পত্র দেয়া হয় যেখানে লেখা থাকবে ‘ভাষা সংগ্রামে অংশগ্রহণ ও কালো পতাকা ওড়ানোর দায়ে ছালেহা বেগমকে ১৯৫২ সালে স্কুল থেকে যে বহিষ্কারাদেশ দেয়া হয় তা স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করে নিলো’।
প্রধান শিক্ষক বললেন হ্যা আমরা সবাই শুনেছি আপনাদের আম্মার ঘটনা কিন্তু স্কুলে ছালেহা বেগমের কোন রেকর্ড নেই। পুরনো নথিপত্র সব উইপোকা খেয়ে ফেলেছে এবং অবশিষ্ট আমরা পুড়িয়ে ফেলেছি ১৯৮৪ সালের দিকে। তবে আমরা চেষ্টা করব উনার ব্যাপারে কোন তথ্য খুঁজে পাই কিনা। আর যেহেতু এই বহিষ্কারাদেশ জেলা প্রশাসক কর্তৃক ইস্যু হয়েছিল, তাই আপনারা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে একটি অনুমতিপত্র নিয়ে আসেন।

শাকিল ও ফরিদা ছুটে গেলেন জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক বললেন আমরা আমাদের নথিপত্র খুঁজে দেখবো এবং ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি তদন্তাধীন থাকবে তবে আপনারা যদি কোন চাক্ষুস সাক্ষী বা প্রমাণ নিয়ে আসেন তাহলে আমদের জন্য কাজটি করা আরও সহজ হবে।

ছালেহার সন্তানেরা সাক্ষী প্রমাণ যোগাড়ে নেমে পড়লেন। তারা খুঁজে বের করলেন সেই সময়কার মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে পড়ুয়া প্রাক্তন ছাত্রীদের। ১৯৫২ সালে নবম শ্রেণিতে পড়তেন এবং পরবর্তীতে মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব মকবুল হোসেন। উনার কাছে ১৯৫২ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক তথ্য রয়েছে যা ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরী মারফত জানতে পারেন ছালেহার ছেলে। মকবুল হোসেন ঐ সময় ছালেহার ঘটনা জানতেন। উনার শিক্ষকতা জীবনেও স্কুলে ছালেহা বেগমকে নিয়ে উনার সময়কালে প্রধান শিক্ষক ভাষা সৈনিক সুফিয়া খান সহ অনেকের মুখে বহু আলাপ আলোচনাও শুনেছেন। মকবুল হোসেন ছালেহার ব্যাপারে লিখিত স্টেটমেন্ট ও ভিডিও বক্তব্য ধারণ করে দিলেন। তা ছাড়া ভাষা সৈনিক আহমেদ রফিকের স্টেটমেন্ট সহ অনেক ভাষা সংগ্রামীদের ইন্টারভিউ এবং ময়মনসিংহ শহরের অনেক পুরনো মানুষের সাক্ষী প্রমাণ যোগাড় করলেন ছালেহার সন্তানেরা।

মকবুল হোসেনের দেয়া লিখিত প্রমাণটি মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক দেখে সত্যায়িতও করে দেন। সব তথ্য ও প্রমাণাদি নিয়ে ছালেহার সন্তানেরা আবার গেলেন জেলা প্রশাসকের অফিসে। জেলা প্রশাসক সব দেখেশুনে বললেন আমরা দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবো তবে আমাদের উপরে বিভাগীয় কমিশনার রয়েছেন, উনার কাছে যান, উনাকেও বিষয়টি জানান। সেই মোতাবেক ছালেহার ছেলে মেয়ে ছুটে গেলেন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে। সব তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণ সহ বিভাগীয় কমিশনার বরাবর স্বারকলিপি দিলেন। সব দেখেশুনে বিভাগীয় কমিশনার ব্যাবস্থা নিলেন। বিভাগীয় কমিশনার মুসলিম গার্লস হাই স্কুল বরাবর চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন যেন স্কুল কর্তৃপক্ষ ছালেহার এই বহিষ্কারাদেশ উত্তোলনে আইনি ব্যাবস্থা নেয়। চিঠির একটি কপি ছালেহার সন্তানদেরও দিলেন।
বিভাগীয় কমিশনারের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে ছালেহার সন্তানেরা আবার ছুটে গেলেন ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে। প্রধান শিক্ষক জানালেন আমরাও চিঠি পেয়েছি বিভাগীয় কমিশনারের কাছ থেকে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ বাতিলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সেই দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়াটা আজ পর্যন্ত হয়নি। এতটা বছর ধরে ছালেহার সন্তানেরা তাদের মায়ের সেই বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে দ্বারেদ্বারে ঘুরছে যার অবসান কবে হবে কেউ জানেনা। ছালেহার সন্তানদের কেবল একটিই চাওয়া- তাদের মা বাংলা ভাষা রক্ষার অপরাধে যে বহিষ্কারাদেশ পেয়েছিলেন, যে ভাষার জন্য তাদের মা তার ছাত্রজীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তা যেন বাতিল হয় আর ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে পুরনো ছাত্রীদের তালিকায় যেন ছালেহা বেগমের নাম থাকে।
সব প্রমাণাদি এবং ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারের ব্যবস্থাপত্র পাওয়ার পরও স্কুল কর্তৃপক্ষ দেখছি, দেখবো, দ্রুত করে দেব ইত্যাদি বলে বলে বছরের পর বছর কালক্ষেপণ করেই যাচ্ছেন। কখনো অনুষ্ঠান আয়োজন করে করবেন বলেন, কখনো বলেন স্কুলের খরচের টাকা নেই ইত্যাদি। অথচ স্কুলের প্যাডেই যে কোন সময় ছালেহার বহিষ্কারাদেশ বাতিলের প্রত্যয়ন পত্রটি লিখে দিতে পারে স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুল কর্তৃপক্ষের এই অনীহা কি এজন্য যে ছালেহা ময়মনসিংহের মেয়ে না, সিলেট অঞ্চলের মেয়ে? না-কি স্কুল কর্তৃপক্ষ এই প্রত্যয়ন পত্র দেয়ার বিপরীতে কোন বিনিময় চাচ্ছেন?

ছালেহা বেগম কি তাহলে মরার পরেও কলংকমুক্ত হতে পারবেন না? ছালেহাকে প্রথমে পাকিস্তান রাষ্ট্র শাস্তি দিলো, তারপর সারাজীবন শাস্তি দিলো তার পরিবার আর এখন মৃত্যুর পর শাস্তি দিচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার প্রশাসন। ছালেহার এ শাস্তি কি শেষ হবার নয়? ছালেহার এই শাস্তিতে বাংলা ভাষায় যে দাগ পড়েছে সেই দাগ কি আমরা মুছতে পারবো না? ছালেহা কলংক মুক্ত না হলে বাংলা ভাষাও কলংক মুক্ত হবে না। ছালেহা ভাষার জন্য তার বোরখা কেটে বানানো কালো পতাকা উড়িয়ে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, সেই প্রতিবাদের কালো পতাকা আর কতদিন পর্যন্ত উড়বে? আমরা কি সেই কালো পতাকা নামিয়ে এই লজ্জা থেকে মুক্তি পাবো না? যে বাংলা ভাষায় আজ কথা বলছি, যে ভাষায় আজ এই লেখাটি লিখছি, যে ভাষায় আপনি আজ এই লেখাটি পড়ছেন, সেই ভাষা প্রতিষ্টায় ভাষাকন্যা ছালেহা বেগমের ত্যাগের মূল্য কি আমরা দিবো না?

২০২৫ সাল। ছালেহা বেগমের বহিষ্কারাদেশ এখনো বাতিল করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। ছালেহার ছেলেমেয়েরাও হাল ছাড়েননি। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ছালেহার বড় ছেলে শাকিল তার মা ছালেহা বেগমের মত আরও যারা ভাষা আন্দোলনের নারী সংগ্রামী সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে বই লিখেছেন ‘নারী ভাষা সৈনিক’, যেখানে ছাপ্পান্ন জন ভাষাকন্যাকে শাকিল তার বইয়ে তুলে এনেছেন।

নতুন বছরের ছুটিতে ছালেহা বেগমের বড় ছেলে শাকিল তার ক্লাস এইটে পড়া মেয়ে আমরিনকে নিয়ে আমরিনের দাদি ছালেহা বেগমের পৈতৃক বাড়ি কুলাউড়ায় এসেছেন। শাকিল আমরিনকে তার দাদীর স্কুল দেখাতে নিয়ে গেলেন কুলাউড়া রেলওয়ে প্রাইমারি স্কুলে। এই প্রাইমারী স্কুলে ছালেহা বেগম পড়েছিলেন। স্কুল দেখে ফেরার পথে আমরিন দেখলো কুলাউড়া স্টেশন থেকে একটি ট্রেন ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে। আমরিন তার বাবাকে থামিয়ে ট্রেন দেখতে লাগলো আর ট্রেনের বগি গুনতে লাগলো। এক দুই তিন… বারো তেরো..। ট্রেনের শেষ বগিটি আমরিনকে অতিক্রম করা পর্যন্ত আমরিন দাঁড়িয়ে রইল বাবার হাত ধরে।

-অপু ইসলাম, লন্ডন, যুক্তরাজ্য