আজ রবিবার, ৯ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল আন্দালুসের পতন এবং মব তোমার পরিণতি কী?

editor
প্রকাশিত মার্চ ৬, ২০২৫, ০৫:০৯ অপরাহ্ণ
আল আন্দালুসের পতন এবং মব তোমার পরিণতি কী?

Sharing is caring!

 

ফারুক ওয়াসিফ

সাড়ে সাত শতকের দিকে সিরিয়ার নাম ছিল দার আল-ইসলাম বা ‘হাউস অব ইসলাম’। আব্বাসীয়রা সেই ইসলামের ঘর থেকে উমাইয়াদের উচ্ছেদ করে। সেই উচ্ছেদ থেকে পালাতে পারে কেবল এক তরুণ: আব্‌দ আল রাহমান।

সিরিয়া থেকে পালিয়ে মরুভূমি দিয়ে পৌঁছায় উত্তর আফ্রিকার মরক্কোয়। মরক্কোর বারবার সম্প্রদায়ের মেয়ে ছিল তার মা। সেই তরুণই মাতৃকূলের বারবার বাহিনী সাথে নিয়ে অষ্টম শতকে স্পেনের কর্ডোভায় প্রথম মুসলিম সমাজ স্থাপন করে। তাঁর সময়ে আন্দালুসিয়া জ্ঞানে, সভ্যতায়, সহনশীলতায় চরম শিখরে পৌঁছে। আল হামরা প্রাসাদ আর গ্রানাডার লাইব্রেরি তার প্রতীক। এই সভ্যতা বিপুল আরবী কেতাব রচনা করেনি, হিব্রু ও লাতিন ভাষাকেও নতুন জীবন দিয়েছিল। ঠিক যেমন ভারতবর্ষে মুঘলরা করেছিল সংস্কৃত ভাষার বেলায়।
স্পেনের উর্বর মাটিতে ইসলামের প্রসারে নেতৃত্ব দিয়েছিল দুই গোষ্ঠী: আরব আর বারবার। কিন্তু সভ্যতা কায়েমের পর আরবরা হয়ে পড়ে এলিট আর বারবারদের দেওয়া হয় কঠিন সব কাজ। এই বৈষম্য থেকে বারবারদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়। তারা শুরু করে চরমপন্থী আন্দোলন। তাদের থেকে আসা ‘মব’ গ্রানাডা, কর্ডোবা প্রভৃতি বড় শহরের শান্তি নষ্ট করে। তাদের অসহনশীলতায় শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়। উমাইয়া খলিফা অসহায় বোধ করেন। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য বারবারদের অসন্তোষে দুর্বল হয়ে গেলে সুযোগ পান খ্রিস্টিয় উগ্রপন্থী রাণী ইসাবেলা ও রাজা ফার্দিনান্দ।
ভেতরের অন্তর্ঘাতে দুর্বল ‘দুনিয়ার অলংকার’ খ্যাত আল আন্দালুস যখন অরক্ষিত তখন পোপের সমর্থনে ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের বাহিনী মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করে। আরব ও বারবাররা উভয়েই কচুকাটা হয় কিংবা বিতাড়িত হয়। গণহত্যা চলে ইহুদীদের ওপরও। গ্রানাডার বিখ্যাত লাইব্রেরি ধ্বংস করে আগ্রাসী খ্রিস্টান বাহিনী। স্পেনের উপদ্বীপে ইসলাম, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অপূর্ব সুন্দর সহাবস্থানের স্বর্ণযুগের অবসান হয়।
অথচ এই অবসানের শুরুটা হয়েছিল নিজেদের লোকের হাতে, বারবারদের ‘হিংসাত্মক’ আক্রোশে। ইসাবেলারা পারতো না আব্দ আল রাহমানের সাজানো বাগান তছনছ করতে। পেরেছিল বারবার মবের নৈরাজ্যের কারণে।
বাংলাদেশে যারা নিজের মন মোতাবেক জোশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন, তারা তো ফ্যাসিস্টদের কিছু করছেন না, তারা কমজোরি করছেন ফ্যাসিস্টদের কবল থেকে কেবলই দম ফিরে পাওয়া দেশটাকে। আপনারা দেশ বোঝেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে, কিন্তু রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্টতা দিয়ে জোরদার হয় না, হয় আইনের শাসন দিয়ে, রাজনৈতিক ঐক্য দিয়ে, পারস্পরিক রহম ও ইনসাফ দিয়ে। ন্যারেটিভ গলার জোরে তৈরি হয় না, তৈরি হয় বাজার ও বিচারের ন্যায্যতা দিয়ে।
রাষ্ট্রকে আপনারা স্পেনের বারবারদের কায়দায় অরক্ষিত করলে ফ্যাসিস্ট এবং তাদের মুরুব্বিদের কাজ সহজ হয়ে যাবে। স্পেনের বারবারদের মনে বঞ্চনা ছিল। সরকারের উচিত বাংলাদেশি বিশুদ্ধতাবাদী ‘মবের’ মন বুঝে তাদের সাথে সংলাপে বসা। ন্যায়কে সমর্থন করা এবং অন্যায়কে কঠোর হাতে দমন করা। অন্যায় দমনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। মনে রাখবেন, রাষ্ট্র না থাকলে দ্বীনও বাঁচাতে পারবেন না। মবের মুল্লুক বাংলাদেশ হতে পারে না। এদেশের অধিকাংশ মানুষ সহনশীল ও মানবিক। আমাদের আর কিছু না থাকুক একটা সুন্দর সমমনা জনগণ আছে। ভাল কাজে ডাক পেলে তারা কাতারে কাতারে জীবন দিতে পারে। পুলিশ ছাড়াও তারাও ডাকাত তাড়াতে পারে, উৎপাদন ও যোগাযোগ চালু রাখতে পারে। কিন্তু মবের বিরুদ্ধে তারা বিব্রত ও ভীত। এই জনগণ কিন্তু নেতৃত্ব ভুল করলে মাফ করে না। তখন তারা আবার একা ও স্বার্থপর হয়ে যায় বাঁচার তাগিদে। এই জনগণকে সাথে নিয়ে দেশটাকে দঙ্গলমুক্ত করুন। দঙ্গলের নেতাদের হুশ ফিরুক। অথবা ইতিহাসের লানৎ তাদের ওপরও নেমে আসবে। সীমালংঘনকারীরা কখনোই পার পাবে না।
মবের উন্মাদনায়ে আল আন্দালুস ধ্বংস ও লুট হয়েছে। সেই লূটের টাকায় রানী ইসাবেলা কলম্বাসকে ফান্ড করেছেন ভারতপথ তথা আমেরিকা আবিষ্কারে। পরের ইতিহাস পাশ্চাত্যের আধিপত্য আর সমৃদ্ধির ইতিহাস। আর মরক্কো বা লিবিয়ায় যারা যান তারা দেখবেন, বারবার সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখনো ঘোড়ায় টানা গাড়ি ঠেলে।
বারবার প্রজাতির মব নিজের দেশ, জাতি ও ধর্মের জন্য কোনো বরকত বয়ে আনে নাই।

ফারুক ওয়াসিফ : মহাপরিচালক, পি আই বি