Sharing is caring!

তাপস দাশ, শ্রীমঙ্গল:
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের সবুজবাগ আবাসিক এলাকার সার্বজনীন শ্মশানঘাট সংলগ্ন মাঠ আজ পরিণত হয়েছিল রঙের এক উৎসবমুখর মিলনমেলায়। ফাগুনের শেষ প্রহরে প্রকৃতি যখন রঙিন, তখনই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে স্মরণ করে মেতেছিলেন দোল উৎসবে।
আজ ১৪ মার্চ (শুক্রবার) সবুজবাগ সার্বজনীন দোল উদযাপন পরিষদের আয়োজনে এ মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা এবছর পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করল।
সকাল থেকেই ভক্তদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে শ্মশানঘাট সংলগ্ন মাঠ। বিশাল প্যান্ডেলের একপাশে রাধাকৃষ্ণের প্রতিমা স্থাপন করে শুরু হয় পূজা-অর্চনা। গন্ধরাজ ধূপের সুগন্ধে, শঙ্খের ধ্বনি আর কীর্তনের সুরে ভরে ওঠে চারপাশ। ভক্তরা দুপুর ১২টার দিকে পরম শ্রদ্ধায় অঞ্জলি নিবেদন করেন, প্রার্থনা করেন মঙ্গল ও শান্তির জন্য। এরপর প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। এর ঠিক পর মুহূর্তেই শুরু হয় রঙের উচ্ছ্বাস—হাড়ি ভাঙার সনাতনী আচার সম্পন্ন হতেই চারপাশ রঙে রঙিন হয়ে ওঠে, আনন্দে মেতে ওঠে সবাই।
দোলযাত্রা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক মহাসম্মিলনের দিন। তাই পূজার পরপরই সবুজবাগ এলাকায় আয়োজিত হয় নগরকীর্তন। ঢাক-ঢোল, করতাল আর কীর্তনের ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠেন এই আনন্দযাত্রায়। নগরকীর্তনের পরপরই শুরু হয় রঙ খেলার পালা। লাল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি—বিভিন্ন রঙ ও আবিরে একে অপরকে রাঙিয়ে দিয়ে উদযাপন করা হয় বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর সম্প্রীতির এ উৎসব।
এ উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য পিয়াস দাশ বলেন, “আমাদের এ আয়োজন পাঁচ বছরে পা দিল। প্রতিবছর আমরা চেষ্টা করি আরও সুন্দরভাবে দোলযাত্রা উদযাপন করতে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আমাদের সম্প্রীতির প্রতীক।আমরা চাই সবাই মিলেমিশে আনন্দ করুক। সবার সহযোগিতা পেলে আগামী বছর আরও বড় পরিসরে এ আয়োজন করব।”
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, “এমন একটি বর্ণিল ও আনন্দঘন দোল উৎসবে উপস্থিত হতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। এ মহতী আয়োজনের জন্য আয়োজকদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রতিটি উৎসবই মানুষকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানায়, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। এ ধরনের আয়োজন কেবল আনন্দই ছড়িয়ে দেয় না, বরং সমাজে ঐক্য, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে অনন্য ভূমিকা রাখে। আমাদের সমাজকে সুন্দর ও সুস্থভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ ধরনের আয়োজন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।”
দোলযাত্রার ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুসারে, এই দিনে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে গোপিনীদের সঙ্গে রঙ খেলায় মেতেছিলেন। সেই থেকেই দোল উৎসবের প্রচলন। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে বৈষ্ণব সমাজে একে গৌরপূর্ণিমাও বলা হয়।
শ্রীমঙ্গলের দোল উৎসব কেবল ভক্তি আর আনন্দেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিরও প্রতিফলন। রঙের ছোঁয়ায় ধুন্ধুমার উল্লাস শেষে বিকেলে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
রঙ, ভক্তি, কীর্তন, উচ্ছ্বাস আর সাংস্কৃতিক পরিবেশনার অপূর্ব সমন্বয়ে সম্পন্ন হলো এবারের দোলযাত্রা। বিদায়বেলায় রঙে রঙিন মানুষগুলো যেন হৃদয়ে একটাই অনুভূতি নিয়ে ফিরলেন—”রঙ শুধু আনন্দের নয়, রঙ মিলনের, রঙ ভালোবাসার, রঙ সম্প্রীতির।”