আজ বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উপ বা ক্ষুদ্র নয় , সকল জাতির মর্যাদা দিতে হবে

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১৪, ২০২৪, ০৬:১০ অপরাহ্ণ
উপ বা ক্ষুদ্র নয় , সকল জাতির মর্যাদা দিতে হবে

Sharing is caring!

 

সৌমিত্র দেব

আদিবাসী শব্দটি অধিপতি বাঙালি জাতির অনেকের গায়ে জ্বালা ধরায় । এ ব্যাপারে বাঙালি বাংলাদেশী দুই জাতীয়তাবাদের অবস্থান এক । শব্দটি আপেক্ষিক ও বটে । Indigenous শব্দের বাংলা পরিভাষা হলো আদিবাসী। আদিবাসী শব্দটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে।

বিভিন্ন কারণে সরকারি ভাবে ২০০৭ সালের পর থেকে তাদেরকে আর আদিবাসী বলা হচ্ছে না । এক সময় এই সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে উপজাতি বলা হতো । এখন বলা হয় ক্ষুদ্র নৃ গোষ্টি । ব্যাপারটা খুব হাস্যকর এবং বৈষম্যমূলক । জাতি কখনো উপ হয় না। কোন গোষ্টিকেও ক্ষুদ্র বলা যায় না। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু বাঙালি ব্রিটেনে হয়ে যায় এথনিক মাইনরিটি । তাকে উপজাতি বললে সেখানে শুনতে কেমন লাগবে । ব্রিটিশ আমলে এদেশে এসেছে মণিপুরীরা । তাদেরকে আমরা উপজাতি বলছি , কিন্তু ভারতে মণিপুর রাজ্যে তো তারাই সংখ্যাগুরু। সেখানেও অনেক আগে থেকেই বাঙালিরা বসতি করেছেন । তাদেরকেও যদি সেখানকার মণিপুরিরা উপজাতি বলে , শুনতে আপনার কেমন লাগবে?

পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকৃত ভিন্ন সংস্কৃতির নৃ-গোষ্ঠী যারা রয়েছে তারা কেন নিজেদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বললে কেন অপমানিত বোধ করে সে বিষয়ে জানা যাক। সেখানেও একই ব্যাপার। পার্বত্য ত্রিপুরা জাতিকে আমরা উপজাতি বলছি, কিন্তু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে তো তারাই প্রধান জাতি ।

এবার কথা বলতেই হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে।

ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো যেমন কোনকালেই ভারতের অংশ ছিলো না, তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামও বাংলার অংশ ছিল না। যদিও জিও পলিটিক্যালি এগুলো উপমহাদেসের অংশ ছিল । অনেক সময় বাংলার মানুষ তাদের রাজ্য জয় করেছে । আবার কখনো সেই সব রাজ্যের রাজারাও বাংলার অংশ বিশেষ দখল করেছেন । যেমন কুমিল্লা , ফেনী , হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার অনেক অংশ ত্রিপুরার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশরা ক্ষমতায় এসে বার্মাসহ এই পাহাড়ি অঞ্চলগুলো ব্রিটিশ ভারতের করায়ত্বে আনে। পরে ভারত বিভাগ ও ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময় বার্মা ( বর্তমানে মিয়ানমার) পৃথক করলেও থেকে যায় এই পার্বত্য অঞ্চলগুলো। উল্লেখ্য যে স্মরণাতীত কাল থেকে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্রিপুরা রাজ্যের তথা আধুনিক ধারণায় সেভেন সিস্টার এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। দূর্গম ও প্রান্তিক এলাকা হওয়ায় এ অঞ্চলে কোন বসতি ছিল না। চাকমা জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বসবাস করার ফলে এটি Chacomas নামে পরিচিত হয় যা ষোড়শ শতাব্দীর(১৪৯৬-১৫৭০) একটি পর্তুগিজ মানচিত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।

৯৫৩ সালে আরাকানের এক রাজা বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম দখল করেন। পরবর্তীতে ১২৪০ সালে ত্রিপুরার রাজা এই অঞ্চল আবারও দখল করলেও, আরাকানের রাজা চট্টগ্রাম পুনরায় দখল করে নেন। মুঘলরা ১৬৬৬ থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে, এই সময়ে চট্টগ্রাম এলাকায় গৌড়বঙ্গ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাঙালির আগমন ঘটে, চট্টগ্রাম জেলার নামান্তর তাদেরই করা।

চার্লস অ্যালেন, যিনি ১৯০০ সালে চিটাগং সার্ভে ও সেটেলমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করেছেন, এই অঞ্চলের নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রথমে উদ্ধৃত করেছেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভাষ্য, চৈতকিয়াং কিংবা চৈতাগ্রাম, চৈতার অর্থ হলো বুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম চট্টগ্রাম। মৌর্য সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২) কর্তৃক স্থাপিত ৮৪ হাজার বৌদ্ধ ধাতু চৈত্যের মধ্যে রামুর চৈত্যটি অন্যতম, আরাকানি শাসনামলে এই চৈত অনুসারে চৈতকিয়াং বা চা-টি-কিয়াং থেকে মুঘল আমলে বাঙালিদের আগমনের পর এই নামটির চট্টগ্রাম নামান্তর হয়। ইংরেজ শাসনামলে চট্টগ্রামকে চিটাগাং নামকরণ করে এবং চিটাগাং ও চাকোমাসকে পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলসহ চিটাগাং হিল ট্রাক্টস নামকরণ করে। অর্থাৎ ইংরেজদের আগমনের আগেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রামের অংশ ছিল না।

একটি রাজ্য ক্ষমতাবলে অধিকার করা এবং ঐ রাজ্যের আদি বাসিন্দাদের মাইনরিটি বা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ট্যাগ লাগিয়ে দিয়ে সংখ্যাগুরুরা ঐ অঞ্চলের আদিবাসী দাবি করা নেহাত ক্ষমতার অপপ্রয়োগ।

আদিবাসী যুক্তির বিপক্ষে অনেকেই বলে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। থাকলেও চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি ভিন্ন সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী যারা পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করছে তারা এদেশের আদিবাসী না, বাঙালিরাই এদেশের আদিবাসী। এটার বিপক্ষে স্পষ্ট বিবৃতি হলো পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকৃত বিভিন্ন গোষ্ঠী যারা রয়েছে তারা পার্বত্য অঞ্চলেরই আদিবাসী। খুলনা, বরিশাল কিংবা ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলের আদিবাসী দাবি করছে না। এখন পার্বত্য অঞ্চল কি বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার বাইরে? অবশ্যই নয়।

এখন প্রশ্ন হলো সরকার তাহলে কেন আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে নারাজ?

-১৯৭২ সালে Indigenous and Tribal Population Convention 1957,Convention 107 of 1957 অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ সরকার। আশির দশকে জাতিসংঘে লিখিতভাবে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে যে আদিবাসী রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতেও এটি বলা হয়েছে। এমনি গত কয়েক সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে প্রধানমন্ত্রীরা যে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছেন সেখানেও আদিবাসী বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
তাহলে এখন সমস্যাটি কোন জায়গায়?

সমস্যা দেখা দিয়েছে ২০১০ সালের পর। ২০০৭ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬১ তম অধিবেশনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। সেখানে ১৪৪ টি দেশ এর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সহ আরো ১৩ টি ভোটদান থেকে বিরত ছিল। কারণ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করা মানে এটি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রতি দেওয়ার একটি বাধ্যবাধকতা থেকে যায়। এছাড়া কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এই চারটি দেশ এর বিপক্ষে ভোট দিলেও পরবর্তীতে তারা এই ঘোষনাপত্রকে সমর্থন দেয়।

জাতিসংঘে আদিবাসীদের অধিকারসংক্রান্ত ঘোষণাপত্র (UNDRIP) ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ বৃহস্পতিবার সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়।

আইএলও-১ কনভেনশনের (b) ছাড়াও আদিবাসীদের অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র (UNDRIP) বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছিল। পক্ষে ১৪৪টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা, বিপক্ষে ৪টি ভোট (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ১১ প্রতিনিধি বিরত (আজারবাইজান, বাংলাদেশ, ভুটান, বুরুন্ডি, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়ান ফেডারেশন, সামোয়া ও ইউক্রেন) ছিল। সেই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য অনেকগুলো অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. ভূমির অধিকার, ২. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, ৩. স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, ৪. জাতীয়তা লাভের অধিকার, ৫. জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ।