Sharing is caring!

সুদেব চক্রবর্তী
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের কারণ ও সমাধানের পথ খুঁজতে হলে পেছনে যেতে হবে। কীভাবে সৃষ্টি হলো ইহুদী জাতি, কীভাবে তারা একটি রাষ্ট্র গঠন করলো এসব না জানলে বিভ্রান্তি রয়ে যাবে।
আরব ভূখণ্ডের একটি আধা যাযাবর জাতি ছিল- সেমাইট। তাদের ভাষা ছিল আক্কাডাইন, কানানাইট, অ্যারামাইক, আরবী, ইথিওপীয় প্রভূতি। কানানাইট ভাষার মধ্যে ছিল আদি কানানাইট, ফিনিশিয়ান, পিউনিক, হিব্রু ইত্যাদি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে এই হিব্রুভাষী ইহুদীরা সেমাইটভুক্ত জাতিসত্তা।
এদের জীবিকার মধ্যে ছিল পশুচারণ। এরপর এরা কৃষিকাজও শুরু করে। তারপর যুক্ত হয় ব্যবসা-বানিজ্যের সাথে। বানিজ্যের সূত্র ধরে তারা মেসোপোটেমিয়ায় বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাদের একজন বিখ্যাত রাজা ছিল- হাম্বুরাবি। তিনি মূলত বিখ্যাত ছিলেন বিশ্বের প্রথম আইন সংহিতা (Law Code) এর রচয়িতা হিসেবে। এটা অ্যারামাইক ভাষায় রচিত ছিল। এইসব ঘটনা খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২০০০ এর সময়কালের।
এই সময়ের দিকেই আব্রাহামের জন্ম। বিশ্বের প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম আব্রাহামের হাত ধরেই জন্মলাভ করে৷ আবার বিশ্বের তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্ম (ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম) আব্রাহামকে নবী হিসেবে মান্য করে। এদের সবারই জাতির পিতা আব্রাহাম। ফলে বলা যায় আজকে পর্যন্ত যা ঘটছে তা একই পিতার সন্তানদের ভেতর সংঘাত, ভাতৃঘাতি সংঘাত। বলা বাহুল্য, খ্রিস্ট ধর্ম আলাদা কোনো ধারা থেকে আসেনি৷ বরং যীশু জন্মসূত্রে স্বয়ং ইহুদী ছিলেন। উনি কেবল ইহুদী ধর্মের সংস্কার করে নতুন মতবাদ সৃষ্টি করেন।
সংক্ষেপে আব্রাহামের বংশধারাটা দেখা যাক- আব্রাহামের স্ত্রীর নাম ছিল সারা। সারার কোনো সন্তান হতো না বলে সারা নিজের দাসী হাজেরাকে উপপত্নী হিসেবে আব্রাহামকে প্রদান করেন। হাজেরার গর্ভে জন্ম হয় ইসমাইলের। কিন্তু পরবর্তীতে সারাও গর্ভবতী হন। তার গর্ভে জন্ম হয় আইজ্যাকের। মুসলিমদের কাছে আইজাক হলো ইসহাক। এরপর একদিন পারিবারিক দ্বন্দ্বের ফলে হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাইলকে সৌদি আরবের মক্কায় নির্বাসিত করা হয়। আব্রাহামের বংশের দুটি ধারা তৈরি হলো- আইজাক এবং ইসমাইল। আইজাকের ছেলে জ্যাকব বা ইসরাইল। এটাই ইহুদী ধারা৷ এই ধারাটাই আজকে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করেছে। অপরদিকে ইসমাইলের ধারা মিলিত হয় মক্কার কোরায়েশ বংশের বনি হাশেম গোত্রের সাথে। এই গোত্রেই জন্ম নেন নবী মোহাম্মদ, যার হাত ধরে সৃষ্টি হয় ইসলামপন্থী মুসলিমদের ধারা।
খ্রিস্টপূর্ব ১৯ শতকের দিকে আব্রাহাম কানানে আসেন। এই কানানই বর্তমানের ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন। এখানে বসতি স্থাপনের পর জ্যাকব বা ইসরাইল তার বারো সন্তানের জন্য বারোটি জনপদ গড়ে তোলেন। কানানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তারা মিশরে চলে যান। পরে ফিরে আসেন। কিন্তু আবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে পুনরায় মিশরে যেতে হয়। কিন্তু মিশরের ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে ইসরাইলিদের উপর নেমে আসে বিপর্যয়। তারা ক্রীতদাসে পরিণত হয়। সাড়ে চারশো বছর তাদের দাসত্বের জীবন চলে।
আমরা জানি ইতিহাসের ‘গ্রেট এক্সোডাস’ এর কথা৷ মোজেস ইসরাইলিদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে সদলবলে মিশর ত্যাগ করেন। এর আগে বহু বছর তারা সিনাই পর্বতে বাস্তুহারা হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এরপর ইসরাইলিরা ঘুরে দাঁড়ায়। সওলের নেতৃত্বে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমরা এবার নজর দিতে চাই এই ইসরাইলিদের উপর নির্যাতন ও বৈষম্যের দিকে। কেননা, পৃথিবীতে সবচেয়ে নিপীড়িত ও নির্যাতিত জাতি হচ্ছে ইহুদীরা৷ সবচেয়ে বেশি ঘৃণার শিকার হয়েছে তারা। যেসবের প্রতিক্রিয়ায় তারা মূলতঃ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলো।
তারা যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তা আক্রমন করে নেবুচাঁদনেজার ও ব্যাবিলনিয়ানরা। ইহুদীদেরকে ধরে ধরে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর আলেকজান্ডারের গ্রিক শাসন শুরু হয়। এরপর রোমানরা দখল নেয় জেরুজালেমের। এই সময়েই যীশুর জন্ম। যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে রোমান শাসকেরা। কিন্তু নেপথ্য দায় চাপানো হয় ইহুদীদের উপর। এর কারণ ছিল। ইহুদীরা যীশুর ধর্ম সংস্কার মেনে নেয়নি। ইহুদীদের যে ধর্ম বিশ্বাস ও আচার প্রতিষ্ঠিত ছিল তা থেকে সরে আসার কথা তারা চিন্তা করতো না, যাকে বলে ধর্মীয় কট্টরপন্থা। যাহোক, যীশুকে হত্যার পর খ্রিস্টানদের তরফ থেকেও শুরু হয় ইহুদীবিদ্বেষ। সেই সময়ে সাহিত্যেও প্রচুর ইহুদী বিরোধী লেখা শুরু হয়। ইহুদীদের ধর্মীয় আচার (পুরুষের খৎনা, সাব্বাথ পালন প্রভৃতি) গ্রিক বা রোমানদের সাথে না মেলার কারণেও ইহুদীরা নিগৃহীত হতো। আলেকজান্দ্রিয়ায় তো ইহুদী বিরোধী দাঙাও হয়েছে।
ইউরোপজুড়ে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সময় মার্টিন লুথার কিং প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তন করেন। এই লুথারও ইহুদীদের ধ্বংস করার পক্ষে প্রচার চালান৷
সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে ইসলামের আবির্ভাব। নবী মোহাম্মদ ছিলেন বনি ইসমাইলদের বংশধর৷ তাদের ভাষা আরবীতে ঈশ্বরের নাম প্রথমে ‘এল’, পরে ‘এলাহিম’, সর্বশেষ আল্লাহ হয়। বলা বাহুল্য, আল্লাহ শব্দটি ইহুদীদের ঈশ্বর যিহোবার আরবী নামান্তর।
প্রথমদিকে নবী মোহাম্মদের সাথে ইহুদীদের সদ্ভাব বজায় থাকলেও ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে ওহুদের যুদ্ধের পর থেকে শুরু হয় সংঘাত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযোগে শুরু হয় ইহুদী বিতাড়ন, হত্যা। বলা চলে তখন মুসলিম ও ইহুদীরা পরস্পরেরর শত্রু হয়ে পড়ে।
ইউরোপে ইহুদীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়। স্পেন, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বহু দেশে শুধুমাত্র ইহুদী হবার কারণে তারা নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস সব কেড়ে নেয়া হয়, বাজেয়াপ্ত করা হয়, তাড়িয়ে দেয়া হয়। সবখানেই ইহুদীরা হয়ে পড়ে দেশহীন, উপহাসের পাত্র, মন্দভাগ্য ও ঘৃণিত।
জার্মানির কথা সবাই জানে। ভাগ্যাহত ইহুদীরা তারপরও আবার ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। ছোট ছোট পুঁজি সংগ্রহ করে তারা ব্যবসা বানিজ্য করে উন্নতি করতে থাকে। ফলে তাদের হাতে চলে আসে জার্মান অর্থনীতি৷ ফলে জার্মানদের কাছে ইহুদীরা প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। এই সময়েই বেড়ে ওঠে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রভাব৷ যার শিকার হয় ইহুদীরা। হিটলার কর্তৃক তথাকথিত আর্য সভ্যতা নির্মাণের লক্ষ্যে ষাট লক্ষ ইহুদী হত্যা করা হয়৷ এই হলোকাস্টের কারণেই হিটলার কুখ্যাত হয়ে আছে। অপরদিকে ইহুদী বিদ্বেষীদের কাছে এই হলোকাস্টের কারণে হিটলার আজও সমাদৃত!
যাহোক, ইহুদীরা এভাবে হাজার বছর ধরে কেবল মার খেয়েছে। তাই তারা চেয়েছিল নিজেদের একটি দেশ হোক। জেনেসিসে বর্ণিত যিহোবা প্রদত্ত প্রতিশ্রুত ভূমিতে তারা ফিরতে চেয়েছে, যেখান থেকে তারা নির্বাসিত হয়েছিল।
এখানেই মূল ভিলেনের আবির্ভাব। ব্রিটিশ শক্তি। দুনিয়া জুড়ে যারা এরকম বহু সমস্যার জন্মদাতা। তখন প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। সেখানে তখন মুসলিমদের বসবাস। কারণ ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ওমর ওই এলাকা দখল নিয়ে মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এর আগে ওখানে মুসলিম ছিল না। ইহুদী এবং খ্রিস্টানরা ছিল। ফলে ইহুদীরা বলছে ওখানে আল আকসা মসজিদ ছিল না, পরে বানানো হয়েছে, কিন্তু মুসলিমরা বলছে মসজিদ আগেই ছিল। যাহোক, বিশ্বযুদ্ধে বৃটেন তিন পক্ষকে ওই এলাকার অধিকার দেবার লোভ দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে নেয়। মক্কা, ফ্রান্স এবং ইহুদীদেরকে। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ওই এলাকা বা প্যালেস্টাইন কেবল বৃটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনে বৃটেন প্রথম ভূমিকা রাখে৷ এভাবেই ইহুদীদের হাজার বছরের চাওয়া নিজেদের রাষ্ট্র গঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদীরা ফিরতে থাকে তাদের আদিভূমিতে। ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্য কেন ওই এলাকাই বেছে নিতে হলো- এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, জেরুজালেম তাদের কাছে পবিত্র নগরী। তাছাড়া ওটা তাদের আদিভূমি। আরেকটি কারণ হলো সেখানে ব্যাপক ফাঁকা জায়গা ছিল।
এটাই আরব বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিমরা অস্তিত্ব সংকটে ভোগে। সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হলো জেরুজালেম। এটাকেই উভয়ে দখল করতে চায়। ফলে একাধিকবার আরব বিশ্ব ইসরায়েলকে হামলা করেছে। কিন্তু এতদিনে ইহুদীরা সব দিক দিয়ে উন্নত। সামরিক ক্ষেত্রেও। ফলে ইসরায়েলের সামনে কেউই টিকতে পারেনি বেশিদিন। প্রথম বার যখন ইসরাইল আক্রমনের শিকার হয়েছে, তখন জান-প্রাণ দিয়ে লড়েছে। তারা মনে করেছে দুনিয়ার সবখানে তারা নিগৃহীত। আজ যদি হেরে যায় তাহলে আর দাঁড়াতে পারবে না। আজও ইসরাইলের সামনে গোটা পৃথিবী একসাথে লড়াই করার কথা চিন্তাও করে না।
প্যালেস্টাইনে ওয়েস্ট ব্যাংক এরিয়ার চেয়ে গাজায় বেশি সহিংসতা। এর কারণ হামাস। হামাসের জন্ম তাদের বিরোধিতা থেকেই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ইসরায়েলের সাথে আপোষ বা শান্তিচুক্তির। সেই শান্তি চুক্তি, অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে এতো রক্তপাত ঘটতো না। অসলো চুক্তির কারণেই ইয়াসির আরাফাত নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সেক্যুলার। এ কারণেই তার বিরোধিতা করে উত্থান ঘটেছিলো জঙ্গি সংগঠন হামাসের। তাই ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন বলা যায় পিএলওকে, হামাসকে নয়। কেননা হামাস উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন। ধারণা করা হয়- আইএস, আলকায়েদা’র মতো এটাও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সৃষ্টি। ফলে সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখেছি খোদ ফিলিস্তিনিরা হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও করেছে।
হামাস ভার্সেস ইসরায়েল এই যুদ্ধ খেলা চলছে বহুদিন ধরে। এবারও তাই৷ কিন্তু প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ ফিলিস্তিনীদের। নিষ্পাপ শিশুরা নির্মমভাবে এই সহিংসতার শিকার হচ্ছে। হামাসসহ মুসলিম বিশ্ব চাইছে ইসরাইলকে ধ্বংস করা, ইহুদীদেরকে সমূলে বিনাশ করা। যদিও মুসলিম বিশ্ব এই ইস্যুতে নিরব থেকেছে। কিন্তু সেই পুরনো ইহুদীবিদ্বেষ মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। আর ইসরায়েলও আত্মরক্ষার নামে কিংবা শত্রু দমনের নামে চড়াও হচ্ছে বার বার। এতে করে লাভ ইসরায়েলেরই হয়েছে। কেননা, প্রতিবার আক্রমনের জবাব শেষে ইসরাইল নতুন করে জায়গা দখল করে তার সীমানা বাড়িয়েছে। এর ফলে বহু ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়েছে। এইসব ঘটনা ইসরাইলকে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ করছে। তবে মূল সাম্রাজ্যবাদী দেশটি হলো যুক্তরাষ্ট্র, যারা ইসরায়েলকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই অতীতে রাশিয়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে ঢোকার কারণে, রাশিয়া ইসরায়েলের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।
এবারের সংকট বা গাজায় ইসরায়েলি হামলার উস্কানিটা প্রথম দিয়েছিলো হামাস। ৫০ বছরের আগের ঘটনা স্মরণ করা যাক। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট অভিযান চালিয়েছিলো ইসরায়েলে। তার ফল স্বরূপ যে যুদ্ধ হয়েছিলো সেটি ১৯৭৩ ‘আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ’, ‘অক্টোবর যুদ্ধ’, ‘রমজান যুদ্ধ’, ‘ ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ’ প্রভৃতি নামে পরিচিত।
১৯৭৩ সালের ৬ থেকে ২৫ অক্টোবরের সেই যুদ্ধের পরিণতি কী হয়েছিলো তা আমরা জানি। তার ৫০ বছর পরে, ২০২৪ সালের সেই অক্টোবরেই হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা ও জিম্মি করে সংকটটাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এরপর ইসরায়েল প্রতিশোধ মিশনে নামে এবং সম্প্রতি হামাস নির্মূলের সংকল্পে যুদ্ধ বিরতি ভেঙে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
এখন কথা হলো- সমাধানের পথ কী? আর কত ফিলিস্তিনী নিরীহ মানুষ মরবে? আর কত ইহুদী বিদ্বেষ চলবে? মুসলিম বিশ্ব বা হামাস এটাকে ক্রুসেড মনে করছে। এটাই সমস্যা। কিন্তু সমস্যাটা ভূ-রাজনৈতিক। যারাই সমাধানের জন্য আপোষের পথ তৈরি করেছে তাদের সবাইকেই দালাল আখ্যা দেয়া হয়েছে, কাউকে কট্টরপন্থীরা হত্যা করেছে। আবার মুসলিম বিশ্বও বিভক্ত হয়ে পড়েছে এই ইস্যুতে। আর জাতিসংঘ তো যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ঠুঁটোজগন্নাথ!
দেখুন, ইসরায়েলের ভেতরে বহু মুসলিম বাস করে৷ তারা কি ইহুদী কিংবা ইসরাইল রাষ্ট্রের কাছে বৈষম্যের শিকার? বরং আপনি অবাক হবেন ইসরাইল তার দেশে থাকা মুয়াজ্জিন ও ইমামদেরকে নিয়মিত বেতন পরিশোধ করে। কয়টা মুসলিম দেশে এমন চিত্র আছে?
তাছাড়া ইসরাইল শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যুদ্ধ কৌশল, অস্ত্র- সবদিক দিয়ে উন্নত। অন্যান্য দেশ দূরে থাক, মুসলিম দেশগুলোও ইসরায়েলকে ছাড়া চলতে পারবে না। ইসরায়েলকে বয়কট করতে হলে নিজেদের যে সক্ষমতা দরকার, তা মুসলিম দেশগুলোর নেই। কোন পন্য বয়কট করবেন? এমনকি যে ফেসবুকে ইহুদী পন্য বয়কট করার ঘোষনা দিচ্ছেন, সেই ফেসবুকও ইহুদী প্রোডাক্ট।
ইসরায়েল নিয়ে মুসলিম বিশ্বের বহু হিপোক্রেসি আছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক আস্ফালন আছে। বিভিন্ন মাধ্যমে ইসরাইল ও ইহুদী নিয়ে বহু মিথ্যাচার আছে। এতে লাভ কী হচ্ছে?
সমাধানের পথ এখন একটাই। মুসলিম বিশ্বের উচিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে মেনে নেয়া। আর ইসরায়েলের উচিত শান্তিপূর্ণ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করা। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
আসলে ধর্ম মারাত্মক জিনিস। বিশ্বে নিরানব্বই ভাগ সংকটের মূলে ধর্ম। এখানেও ধর্মীয় ট্যাবু কাজ করেছে। ইহুদীরা মনে করে ওটা তাদের যিহোভা প্রদত্ত প্রতিশ্রুত ভূমি। তারা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি। ইহুদী ধর্ম এমনিতেই কট্টরপন্থী ধর্ম, ইসলামের মতোই। খ্রিস্টানরাও ইহুদীদেরকে ঈশ্বরের নির্বাচিত মনে করে তাদের পাশে থাকে। যেহেতু খ্রিস্টানরা ইহুদীদেরই সংস্কারের অংশ। আর মুসলিমরা? তাদের কাছে জিহাদ বড় ধর্ম। তারা দাজ্জাল তত্ত্বে বিশ্বাসী।
জমি কাদের ছিল, কারা দখল করেছিল- এইসব পুরনো ক্ষতে নতুন করে আঘাত করলে কেবল রক্তই বের হবে। চোখের বদলে চোখ নেয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকলে পৃথিবীটাই অন্ধ হয়ে যাবে। তাতে রাজনীতি লাভবান হবে, অস্ত্র ব্যবসা বেগবান হবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের লাভ হবে না, বরং ক্ষতিই হবে। শান্তির জন্য উভয়কেই সমঝোতায় আসতে হবে। হামাস আগে হামলা করছে নাকি ইসরাইল আগে হামলা করছে- এসব প্রশ্ন তোলা থাক। কেননা, আমরা দেখছি এতে নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে।
মানুষ কবে বুঝবে- এইসব আগ্রাসনে হিন্দু, মুসলিম, ইহুদী, খ্রিস্টান, মরছে না। মানুষ মরছে। এই মানুষ হত্যার প্রতিবাদ জানাই৷ বন্ধ হোক যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।

সুদেব চক্রবর্তী : লেখক , সাংবাদিক