আজ রবিবার, ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশে উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে যে সব কারণে

editor
প্রকাশিত এপ্রিল ১১, ২০২৫, ০২:৩৭ পূর্বাহ্ণ
দেশে উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে যে সব কারণে

Sharing is caring!

টাইমস নিউজ  

দেশে উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে । সম্প্রতি বিভিন্ন আন্দোলন ও মিছিলে আন্তর্জাতিক ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে পরিচিতি আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও আল কায়েদার পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখা যাচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নতুন করে উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। উগ্রবাদীরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর পতাকা বহন করছে, তাদের নেতাদের ‘বীর’ হিসেবেও আখ্যায়িত করছে। সবশেষ ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে গত সোমবার (৭ এপ্রিল) ঢাকার মিছিলেও আইএসের পতাকা ও আল-কায়েদার সাবেক প্রধান ওসামা বিন লাদেনের ছবি দেখা গেছে।

উগ্রবাদী নিত্য-নতুন সংগঠন গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে তারা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তারা যোগাযোগের বড় মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার জঙ্গিরা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। আর এসব নতুন উগ্রবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠায় কলকাঠি নাড়ছে জামিনে কারামুক্ত জঙ্গিরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একের পর এক ঘটনায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর পতাকা ও ছবি ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এসব ঘটনার মাধ্যমে উগ্রবাদী কার্যক্রমকে ‘নরমালাইজ’ করার চেষ্টা চলছে। এভাবে চলতে থাকলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাগরিকদের আরও বেশি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হবে। এমনিতেই বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক এসব সন্ত্রাসী সংগঠনে অনেক বাংলাদেশি নাগরিকদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে স্পর্শকাতর এই বিষয়টি নিয়ে নির্বিকার আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যারা আইএস বা আল-কায়েদার পতাকা হাতে বিভিন্ন মিছিলে মহড়া দিচ্ছে, তাদের শনাক্ত বা গ্রেফতারের বিষয়ে কোনও উদ্যোগও নেই। জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘যারা আইএস-আল কায়েদার পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করেছে, তাদের নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া উগ্রবাদী তৎপরতার বিষয়েও বাংলাদেশ পুলিশ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। কোনোভাবেই উগ্রবাদী তৎপরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এ নিয়ে নিয়ে কাজ করছে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্রবাদী সংগঠনগুলো সক্রিয় হওয়া শুরু করেছে। একইসঙ্গে এ সময়ে বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের দেড় শতাধিক সদস্য জামিনে বের হয়েছে। এছাড়া কারাগার থেকে অনেক জঙ্গি সদস্য পালিয়েও গিয়েছে। জামিনে এবং পলাতক থাকা অবস্থাতেই তারা নতুন করে নিজ নিজ সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। নতুন সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি আর্থিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহের চেষ্টাও করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পরপরই প্রকাশ্য তৎপরতায় নামে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীর। তারা প্রথমে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মিছিল, প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনসহ পল্টন এলাকাতেও মিছিল করে। প্রথম দিকে নিষিদ্ধ এই সংগঠনের তৎপরতা নিয়ে সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গা-ছাড়া ভাব থাকলেও গত ৭ মার্চ থেকে তারা কিছুটা কঠোর হয়।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হচ্ছে—উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার একটা পরিষ্কার প্রবণতা। এগুলো প্রতিহত করতে আমরা যে দক্ষতা বা সক্ষমতা তৈরি করেছিলাম, সেগুলো পুরোপুরি কাজ করছে না। অর্থাৎ যে বিশেষায়িত ইউনিটগুলো রয়েছে, সেগুলো এদিকে যথাযথ নজর দিচ্ছে না। পুলিশের যে ধরনের কর্মদক্ষতা থাকা প্রয়োজন, সেই দক্ষতা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কাজেই দুই দিক থেকেই যে ধরনের বিপরীতধর্মী পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়েছি, সেটা বড় ধরনের একটি নাজুক পরিস্থিতি এবং এখান থেকে অন্য কোনও কিছু হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থেকে যায়।’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই মেজর জেনারেল বলেন, ‘যে ধরনের শিথিলতা আসছে, সেখানে এই ধরনের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাটা খুবই একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা বড় আশঙ্কার ব্যাপার। এখান থেকে নেগেটিভ দিকে যেতে পারে। সেখান থেকে বড় ধরনের কোনও কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।’

উগ্রবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, গত ৭ মার্চ হিযবুতের পূর্ব ঘোষিত একটি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তাদের প্রতিরোধ ও গ্রেফতারের নির্দেশনা আসে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই ওইদিনই পল্টনের কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দেয়। এই কর্মকর্তা আরও জানান, সেসময় হিযবুতের প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

উগ্রবাদী কার্যক্রম নজরদারি করা একাধিক সূত্র জানায়, প্রকাশ্য কর্মসূচির কারণে হিযবুত আলোচনায় এলেও অন্যান্য নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো গোপনেই তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে। বর্তমানে তারা শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন কৌশলে সদস্য সংগ্রহের কাজ করছে।

সূত্রটি বলছে, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হলো আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের (একিউআইএস) অনুসারীরা। বাংলাদেশে যাদের আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম হিসেবে ডাকা হয়। এই সংগঠনের শীর্ষ একজন নেতা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক বহু বছর পর প্রবাসী একজন সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। কৌশলে তিনি উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলো এড়িয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ সামনে এনে সহমর্মিতা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে দায়ের হওয়া মামলা এবং আদালতের দেওয়া দণ্ড মওকুফের জন্য আবেদনও করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে আল-কায়েদার অনুসারীদের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে কাজ করেন মাওলানা ওসমান গণি নামে নরসিংদীর একজন বাসিন্দা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জসিম উদ্দিন রাহমানীকেও আনসার আল ইসলামের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে বলে আসছিলেন। তবে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কারাগার থেকে বের হয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন জসিম উদ্দিন।

উগ্রবাদ প্রতিরোধে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে একিউআইএস-এর নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এর সদস্যরা প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ এবং বেশিরভাগ সদস্যই উচ্চশিক্ষিত। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের সদস্যরা একাধিক টার্গেটেড কিলিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এছাড়া অন্যান্য নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর মধ্যে নিও-জেএমবি ছিল আইএস বা ইসলামিক স্টেটের অনুসারী। ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের খেলাফত হারানোর পর থেকেই এই সংগঠন কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও নতুন করে তারা সক্রিয় হয়ে উঠছে। একই অবস্থা হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ- হুজিবি’র ক্ষেত্রেও। পুরনো জেএমবি বা জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই পলাতক শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন সালেহীনের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে আসছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ আগস্টের আগে নরসিংদী কারাগার এবং ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কাশিমপুর কারাগার ভেঙে অনেক জঙ্গি সদস্য পালিয়ে যায়। এছাড়া জামিনে ছাড়া পাওয়া জঙ্গিরা বিভিন্ন কৌশলে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকেই তৌহিদি জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা বিষয়ে অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার অফিসের সামনে, বইমেলায় একটি স্টলকে কেন্দ্র করে এবং একটি থানার সামনে তৌহিদি জনতার ব্যানারে যে বিক্ষোভ হয়েছিল—সেখানে একই ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন, যাদের মধ্যে অন্তত তিন জনের বিরুদ্ধে আগে উগ্রবাদী তৎপরতার অভিযোগে মামলা ছিল। তারা বিভিন্ন মেয়াদে জেলেও ছিলেন।

উগ্রবাদী তৎপরতার ঘটনাগুলোকে ‘নাটক’ বলে স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন অপরাধ বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। আগের উগ্রবাদবিরোধী অভিযানগুলোকে ঢালাওভাবে যেভাবে ‘নাটক’ বলে প্রচার করা হচ্ছে, এতে উগ্রবাদীদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

উগ্রবাদ প্রতিরোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো এখন ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে কাজ করছে। তাদের উগ্রবাদী কার্যক্রমকে স্বাভাবিক ‘ধর্মীয় কাজ’ বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। এজন্য খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলা, কালেমা লেখা থাকার কথা বলে আইএস বা আল-কায়েদার পতাকা ওড়ানো, অথবা ওসামা বিন লাদেনকে মুসলিম বিশ্বের বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা এই তৎপরতারই অংশ।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘উগ্রবাদবিরোধী অভিযানগুলোকে ঢালাওভাবে নাটক বলাটা সঠিক হচ্ছে না। এগুলোর সত্যতা যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, কাজেই এসব কাজের ওপর যে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা দরকার, সেখানে বড় ধরনের একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। মানুষ এটাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছে না। আর এগুলো শুধু পুলিশের কার্যক্রমে বন্ধ হয় না। এখানে সমাজের এবং মানুষের একটা বড় ভূমিকা থাকে। সেখানে যদি মানুষের মধ্যে এদের কাজের গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন চলে আসে, তাহলে একটা বড় সমস্যা দেখা দেয় এবং সেটি ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে।’

বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদী তৎপরতা শুরু হয়। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটায়। ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর দেশের ৬৩ জেলায় বোমা ফাটিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছিল জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি। প্রথম দিকে গাছাড়া ভাব দেখালেও সিরিজ বোমা হামলার পর নড়েচড়ে বসে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। একে একে জেএমবিসহ অন্যান্য উগ্রবাদী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। ২০০৭ সালে ছয় জন শীর্ষ জঙ্গি নেতার ফাঁসিও কার্যকর করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও প্রথম দিকে উগ্রবাদী তৎপরতা নিয়ে গাছাড়া ভাব ছিল। ২০১৩ সালে ব্লগার হত্যা ও টার্গেটেড কিলিং শুরু হয়। বিদেশি নাগরিক, ভিন্নমতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে অনেক ঘটনার দায় স্বীকারও করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ও আল কায়েদা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলার কয়েক মাস আগেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে গঠন করা হয় উগ্রবাদ প্রতিরোধে বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম-সিটিটিসি ইউনিট। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যাত্রা শুরু করে পুলিশের স্বতন্ত্র ইউনিট অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট-এটিইউ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে উগ্রবাদ প্রতিরোধে সিটিটিসি অনেক সফল অভিযান করায় সংস্থাটি উগ্রবাদী একাধিক গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়। এছাড়া সরকার পরিবর্তনের পর থেকে এই ইউনিটের দক্ষ সব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ইউনিটে বদলি করা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছেন একাধিক দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা। ফলে এখন আর উগ্রবাদ প্রতিরোধ নিয়ে কেউ কাজ করার আগ্রহ পাচ্ছেন না। ওই কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের ৭ মার্চের আগ পর্যন্ত বিশেষায়িত ইউনিটকে উগ্রবাদ প্রতিরোধ সংক্রান্ত কাজের বদলে ট্রেডিশনাল ক্রাইম (চুরি-ছিনতাই) প্রতিরোধে কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৭ মার্চ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেওয়ার পর সরকার কঠোর হতে নির্দেশ দেয়। তখন থেকে হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য একাধিক অভিযান চালিয়েছে সংস্থাটি।

সিটিটিসি’র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মন্তব্য, ‘এই ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন-সিটিআই বিভাগ। সেই বিভাগের ডিসি ও এডিসি’র পদগুলো এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন কেমন কাজ হচ্ছে।’

গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর সিটিটিসি রাজধানীর শাহ আলী এলাকার একটি বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ দুই তরুণকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে তাদের সন্দেহভাজন জঙ্গি বলা হলেও কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গ্রেফতারকৃতদের বিষয়ে ‘জঙ্গি’ নয়, ‘নাশকতাকারী’ বলে সংশোধনী দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সূত্র জানায়, ব্রিটিশ একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ওই তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।

উগ্রবাদ প্রতিরোধে বিশেষায়িত আরেক ইউনিটও গতানুগতিক অপরাধ (ট্রেডিশনাল ক্রাইম) নিয়ে কাজ করছে। পুরো রমজান মাসে তাদের চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধে টহল টিম পরিচালনার পাশাপাশি নির্দিষ্ট একটি এলাকার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের হওয়া ৫০টি হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের।

এটিএউ’র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ট্রেডিশনাল ক্রাইম নিয়ে কাজ করলেও উগ্রবাদ প্রতিরোধে তাদের নিয়মিত নজরদারি চলছে। উগ্রবাদ নিয়ে কাজে তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি। তবে গ্রেফতার অভিযান কমে আসার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মুনীরুজ্জামান বলছেন, ‘বড় কথা হচ্ছে, আমাদের যে দক্ষতা ও সক্ষমতা এবং নজরদারির প্রয়োজনীয়তা ছিল, সেখানে বড় ধরনের দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের দুর্বলতা যখনই দেখা যাবে, তখনই আমরা যা কিছু দেখছি, তার বাইরে আরও অনেক কিছু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেহেতু আমরা আমাদের কার্যক্রম যেভাবে পরিচালনা করার কথা, আমরা সেটা করতে পারছি না। কেন এটা করতে পারছি না, সেটার জন্য কাউকে জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না। এই প্রবণতা বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।’