Sharing is caring!

সালেহ আহমদ (স’লিপক):
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অপ্রাপ্তবয়স্ক এক ছাত্রীকে অপহরণের দায়ে থানায় একটি মামলার প্রেক্ষিতে আসামী প্রবাসী রাজুসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের বক্তব্য উঠে আসায় সরেজমিনে অনুসন্ধান করে ছাত্রী অপহরণের ঘটনার সাথে বিভিন্ন অসঙ্গতি ও চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।
ঘটনাটি শ্রীমঙ্গল উপজেলার ২নং ভুনবীর ইউনিয়নের শাসন এলাকার আতকাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বর্তমানে উপজেলা শহরের দেব বাড়ি রোডে বসবাসকারী ইব্রাহীম পিতা মৃত মুসলিম মিয়ার ছেলে ইব্রাহীম মিয়ার। তিনি ৩ ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। সবার ছোট মেয়ে তার নাম ইমা আক্তার। সে সাতগাঁও হাই স্কুলের সদ্য ভর্তিকৃত নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ৩ ছেলের পর এক মেয়ে নিয়ে তাদের ছিল বুক ভরা স্বপ্ন। মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করতে গ্রাম থেকে পারি দিয়েছেন উপজেলা শহরে কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না। মেয়েকে হাঁরিয়ে মায়ের (আমেনা বেগম) শারীরিক অবস্থা করুণ। ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগ আক্রান্ত তিনি। যে কোন সময় বড় ধরনের শারীরিক অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ইমার বাবা ইব্রাহীম মিয়া।
এব্যাপারে ইমা আক্তারের মা আমেনা বেগমের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি কান্নার কারণে স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারছেন না। তবে তিনি মূল বিষয়ে বলেন, মেয়ে জন্ম দিলাম আমি, লালন পালন করে বড় করলাম আমি, আমি আমার মেয়ের বয়স জানিনা, যারা অপহরণ করে নিয়ে গেছে তারা কি আমার মেয়ের বয়স জানে? আমি প্রশাসনের কাছে আমার মেয়েকে উদ্ধার করে এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আর যেন কোন লম্পট কোন পরিবারের ইজ্জত লুটতে না পারে।
অপহৃত ইমার বাবা ইব্রাহিম মিয়াও বাকরুদ্ধ। তিনি বলেন, তিন ছেলের পর একমাত্র মেয়ে জন্ম হওয়ার পর তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। মেয়েকে লেখাপড়া করানোর জন্য শহরে আসছিলাম কিন্তু আজ রাজু ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা আমাদের সেই স্বপ্ন নষ্ট করে দিলো। আজ আমার মেয়ে বেঁচে আছে কি নেই তাও জানিনা, মেয়ের জন্য আমার স্ত্রী মৃত্যুর মুখোমুখি।
মামলার বিবরণ ও পারিবারিক অভিযোগ থেকে আরো জানা যায়, ১৬ বছর বয়সী ইমা আক্তারকে গত ১৮ মার্চ থেকে খুঁজে না পাওয়ার পর শ্রীমঙ্গল থানায় একটি জিডি দায়ের করার সূত্র ধরে শুরু হয় অভিযান, গ্রেপ্তার ও তদন্ত। এ সময় আটক করা হয় তিনজন। এখনো আটককৃতরা বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে কারাগারে রয়েছেন।
অনলাইনে প্রচারিত ভিডিওর সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, ইমা আক্তার এর জন্ম ২০০৮ সালের ১৫ জুনে।
পর্যবেক্ষণে আরো দেখা যায়, জেএসসি ২০২৪ এর অষ্টম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন কার্ডে এবং গত ৩ মে ২০১৬ইং সালে রেজিস্ট্রিকৃত জন্ম নিবন্ধনেও একই জন্ম তারিখ বিদ্যমান।
অথচ ১৬ বছর বয়সী ঐ কিশোরীর বয়স এক লাফে ২ বছর বাড়িয়ে একটি জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখিয়ে (ভিডিও সূত্র হতে) অন্যের শিখানো মতে নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক বলে দাবী করেছে ওই কিশোরী।
যে জন্ম নিবন্ধনটি ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইং সালে অনলাইনে রেজিস্ট্রি করা রয়েছে তা জেএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড এর সাথে কোন মিল নেই। অথচ তার পূর্বে ৩ মে ২০১৬ইং সালে অনলাইনে রেজিস্ট্রিকৃত জন্ম নিবন্ধনটিতে ১৫ জুন ২০০৮ইং সালের জন্ম তারিখ রয়েছে। এ নিবন্ধন থাকার পরেও এক লাফে দুই বছর বাড়িয়ে আরেকটি সনদ কিভাবে তৈরি হয়েছে বা কে করেছে কোথায় করেছে? এ নিয়ে অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, অপহরণের পরিকল্পনা করতে গিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে জালিয়াতি করে তৈরি করা জন্ম সনদে শুধুমাত্র ২০০৮ এর স্থলে ২০০৬ এবং ইমা আক্তারের স্থলে ইমা বেগম দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ের সুযোগটিকে ব্যবহার করে অবৈধ পন্থায় তৈরি করা হয়েছে সর্বশেষ জন্ম নিবন্ধনটি। ইমা আক্তার এর বাবা দাবি করেন আমার মেয়ের দু’টি জন্মদিন হতে পারে না। এমন যদি হয়ে থাকে, কেহ করে থাকে, তাহলে ভূয়া তারিখে জন্ম নিবন্ধনটি বাতিল করার জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানান।
এব্যাপারে ২নং ভুনবীর ইউপি সচিব রবীন্দ্র বলেন, ৩ মে ২০১৬ইং সালে ইসুকৃত জন্ম সনদটি স্কুল রেজিস্ট্রেশন কার্ডের সাথে সম্পৃক্ত আছে। পরবর্তীতে যেটি দেখা যাচ্ছে এটি কিভাবে করা হয়েছে তা বিস্তারিত না জেনে এখন বলতে পারছি না।
সাতগাঁও হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষককে না পেয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক মলয় চন্দ্র দাসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ইব্রাহিম মিয়ার মেয়ে ইমা আক্তার ২০২৪ সালে জেএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে সুতরাং তার বয়স তো ১৮ হওয়ার সুযোগ নেই।
অপহরণের শিকার ছাত্রীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিও রেকর্ড থেকে বুঝা যায়, কোন একজন লোক তাকে বারবার শিখিয়ে দিচ্ছে এবং শেখানো ওই ভিডিওতে সে নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপহরণ হয়নি বলে ৯ মিনিটের একটি ভিডিওতে দাবি করতে শোনা যায়। এছাড়াও ইমা তার প্রবাসে থাকা তিন ভাইকেও ধৃত আসামি রাজু মিয়াকে নির্যাতনের অভিযোগ করেন, অথচ সরে জমিন তদন্তে জানা যায়, ইমার তিন ভাই এই ঘটনার সময় বাড়িতে ছিল না তারা পূর্ব থেকেই প্রবাসে রয়েছে।
এর জের ধরে মামলার বিবাদীদের (প্রবাসী রাজু ও তার পরিবারের লোকজন) সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে এবং মামলার আসামি রাজু মিয়ার মায়ের ব্যবহৃত একটি মোবাইল নাম্বারে বারবার যোগাযোগ করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
মামলাটি তদন্ত করছেন এসআই তৌকির আহমেদ, এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রয়েছেন, বিশেষ করে ওসি স্যার (অফিসার ইনচার্জ) রয়েছেন। উনার সাথে কথা বলুন বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যাবেন।
এ ব্যাপারে অফিসার ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম বলেন, গত মার্চে ছাত্রী নিখোঁজের একটি জিডির প্রেক্ষিতে কিশোরীকে খুঁজতে গিয়ে প্রাপ্ত সূত্র মতে নিজেরা সামাজিকভাবে সমাধান করার অনুরোধ করলেও প্রবাসী রাজুর পরিবারের লোকজন কালক্ষেপণ করেছে। অপরদিকে মেয়ের বাবা অসহায়ের মতো সারাদিন থানার গেটে বসে থাকেন। লোকটির পক্ষে কোন লোক তদবিরও করতে দেখা যায়নি, যা অন্যদের বেলায় দেখা যায়। নিখোঁজের সন্ধান শুধু মানবিক কারণ নয়, আইনি প্রক্রিয়ায়ও। আপনারা জানেন, অপ্রাপ্তবয়সী কেউ যদি কারো প্ররোচনায় গোপন স্থানে অবস্থান করে, তাকে অপহরণ হিসেবে পরিগণিত করা হয। নিখোঁজ ডায়েরি ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। প্রবাসী রাজুকে গোপন সংবাদের প্রেক্ষিতে পালানোর সময় গ্রেপ্তার করি। সে বিয়ে করেছে বলে দাবি করেছে। আমরা কাগজপত্র নিয়ে মেয়েকে হাজির করার কথা বললেও সেটি তারা করেনি। অপরদিকে মেয়েটিকে না পেয়ে তার অসুস্থ মা মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। ইতিমধ্যে মেয়েটি ভুল তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকগুলো অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছেন। এ ঘটনায় প্রবাসী রাজু সহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে জেলে রয়েছে। মেয়েটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলছে। মামলার ব্যাপারে বিজ্ঞ আদালত সিদ্ধান্ত নিবে।