Sharing is caring!
আবির হোসেন, ইবি:
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আবাসিক হলের ডাইনিংয়ে প্রতিনিয়ত বাজারের উচ্ছিষ্ট খাবার খাচ্ছে শিক্ষাথীরা। স্বল্প মূল্যে পঁচা-বাসি সবজি, মাছ এবং নিম্নমানের চাল কিনে এসব রান্না করে নিয়মিত পরিবেশন করছেন ডাইনিং ম্যানেজাররা। একাধিকবার হলের ডাইনিংয়ের ফ্রিজে পঁচা-বাসি সবজি ও মাছ-মাংস মিললেও এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন ডাইনিং ম্যানেজাররা। এদিকে উপায় না পেয়ে এসব খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি আবাসিক হলের অন্তত তিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। ফলে স্বাস্থ্যহানি, বদহজম, ডায়রিয়া, বমির সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগের উপসর্গ নিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছেন অনেক শিক্ষার্থী। এতে তাদের স্বাভাবিক পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া এসব খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত ক্যালরি না পাওয়ায় পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছে না। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে এধরনের খাবার খেলে তা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া প্রভোস্ট কাউন্সিল সদস্যদের উদাসীনতাকে কাজে লাগিয়ে ডাইনিং ম্যানেজাররা দীর্ঘদিন ধরে এমন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। হলের খাবারের মান উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয় না প্রভোস্ট কাউন্সিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে খাবার পরিবেশনের জন্য ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী শেখপাড়া বাজার থেকে নিয়মিত সবজি, মাছ ও চাল কেনেন ডাইনিং ম্যানেজাররা। এসময় তাদের ক্রয় তালিকার শীর্ষে থাকে পঁচা ও বাসি সবজি, মাছ এবং নিম্নমানের চাল। টাটকা তরকারির দাম বেশি হওয়ায় খরচ বাঁচাতে নামমাত্র মূল্যে এসব সবজি কিনে চালিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের পাতে। বাজারে টাটকা সবজি ও দুই-তিন দিনের অবিক্রিত সবজির মধ্যে দামের পার্থক্য ব্যাপক। প্রতিদিন বেঁচাকেনা শেষে অবিক্রিত সবজিগুলো উচ্ছিষ্ট হিসেবে আলাদা করে বস্তায় ভরে রাখে বিক্রেতারা। পরদিন সুবিধামতো সময়ে ডাইনিং ম্যানেজারদের প্রতিনিধি সেগুলো নামমাত্র মূল্যে কিনে আনে। এছাড়া শিক্ষার্থী সমাগম কমলে গভীর রাতে ভ্যানের মাধ্যমে এসব মালামাল বিভিন্ন হলে ঢুকানো হয়। বাজারের উচ্ছিষ্ট এসব সবজি থেকেই রান্না করা তরকারি নিয়মিত পরিবেশন করা হয় হলগুলোতে। আর শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়েই তিনবেলা খাচ্ছে এসব খাবার।
দীর্ঘদিন এসব তরকারি খাওয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সুস্থ শরীর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে দীর্ঘদিন এসব খাবার খেয়ে শরীরে জটিল রোগ নিয়ে বের হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। এমনকি মাঝেমধ্যে এর প্রভাবে মরণব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে কেউ কেউ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগে বিভিন্ন সময় কনজুমার ইয়ুথ বাংলাদেশ (সিওয়াইবি) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যদের অভিযানে হলের ফ্রিজে পঁচা-বাসি সবজি মিলেছে। গত বুধবারও সাদ্দাম হলের ডাইনিংয়ে পঁচা সবজি পাওয়া গেছে। তবুও ডাইনিং ম্যানেজাররা এসব অভিযোগ স্বীকার করতে নারাজ। এদিকে প্রভোস্ট কাউন্সিল এসব বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। হলের খাবারের বিষয়ে তাদের কোনো ধরনের তদারকি নেই বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
শহীদ জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থী আল মাসুদ বলেন, হলের খাবার আমরা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য খাই। স্বাদ কিংবা পুষ্টি কোনো কিছুই নেই এ খাবারে। তবুও আমরা উপায় না পেয়ে এগুলোই খেয়ে বেঁচে আছি। এসব খাবার খেয়ে হলের অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিত অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের তদারকি বাড়ানো দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত চীফ মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, এসব খাবার কোনোভাবেই স্বাস্থ্যকর নয়। নিয়মিত এমন খাবার খেলে একজন শিক্ষার্থীর স্মৃতিশক্তি ক্রমশ কমতে থাকে। শারীরিক স্বাস্থের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থের উপরও চরমভাবে এর প্রভাব পড়ে। এছাড়া নিয়মিত ছোটখাটো সমস্যার পাশাপাশি একসময় জটিল রোগে রূপ নেয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
শেখপাড়া বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিংয়ে বাজারের সবচেয়ে বাসি মালামালগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। এগুলো টাটকা সবজি থেকে তিন-চার গুণ কম দামে পাওয়া যায়। এসব সবজি তখন আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।
আরেক ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, সব মালামালই ভালো মন্দ দুই ধরনের থাকে। হলের জন্য সবসময় কম দামের নরমাল জিনিসগুলোই কেনে। পঁচা ও পোঁকাযুক্ত তরকারি বাঁছাই করে আলাদা করে হলের জন্য রেখে দেয় বিক্রেতারা। সাধারণ ক্রেতারা সেগুলো কখনোই কেনে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডাইনিং ম্যানেজার বলেন, কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা যে ভর্তুকি পাই তাতে হল চালানো সম্ভব হয় না। এজন্য আমাদের কিছুটা সাশ্রয়ের জন্য কম দামের বাসি সবজি কিনতে হয়। সব হলেই কমবেশি এসব মালামাল নেয়। তাছাড়া সবসময় বেশি দাম দিয়ে টাটকা সবজি কিনতে গেলে তো আমাদের কোনো লভ্যাংশ থাকবে না। তবে কর্তৃপক্ষ ভর্তুকি বাড়ালে খাবারের মান বাড়াতে সুবিধা হবে।
এ বিষয়ে কনজুমার ইয়ুথ বাংলাদেশের ইবি শাখার সভাপতি ত্বকি ওয়াসিফ বলেন, বারবার বলা সত্ত্বেও তাদের এই অনিয়ম অত্যন্ত দু:খজনক। এ ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেককে আরও কঠোর হতে হবে। প্রত্যেক হলে অনিয়মগুলো তালিকা করে খুব দ্রুতই প্রভোস্ট কাউন্সিলের সঙ্গে সিওয়াইবির পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করা হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি।
প্রভোস্ট কাউন্সিল সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, তারা যাতে আর হলে এ ধরনের জিনিসপত্র না দেয় সে ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করা হবে। এছাড়া আমি হল প্রভোস্টদের নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন হলে মনিটরিং করবো। আশা করছি, তারা ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজ করবে না।