Sharing is caring!
টাইমস নিউজ
অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে দু’দফা বাংলাদেশে আসে জাতিসংঘের তদন্ত দল। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর সরকারি বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে। তবে সরকারের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য না পাওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে তারা প্রতিবেদন দিতে পারেনি বলে জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের জন্য তাদের আমন্ত্রণ জানায়। বিষয়টি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার বলা হলেও অপরাধ এবং অনেক অপরাধীর তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারগতা লক্ষ্য করা গেছে, যা মোটেও কাম্য নয়। এ কারণে তথ্যানুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদন শেষ করতে পারছে না। অবশ্য নতুন করে জানুয়ারির মধ্যভাগে প্রতিবেদন শেষ করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় প্রতিবেদনও অসম্পন্ন হবে বলে জানান তিনি।
চাহিদা অনুযায়ী জাতিসংঘকে তথ্য দিতে কিছুটা দেরি হয়েছে স্বীকার করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগের মহাপরিচালক ও মুখপাত্র তৌফিক হাসান। তিনি বলেন, ‘তথ্যানুসন্ধান মিশনের চাহিদার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগ থেকে যেসব তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, সেগুলো জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন কার্যালয়ে দেওয়া হয়েছে।’
জানা যায়, তথ্যানুসন্ধানী দল জাতিসংঘের স্বীকৃত পদ্ধতি মেনে তদন্ত কার্যক্রম চালায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়াও অনুসরণ করে। যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করবে, তার সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে। বাংলাদেশে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নৃশংস ঘটনার মূল উৎস বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সুপারিশ করে ডিসেম্বরের শুরুতে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে চেয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধি দল। কিন্তু তা হয়নি। এখন তারা জানুয়ারির মাঝামাঝি প্রতিবেদন জমার লক্ষ্যে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের আমন্ত্রণে আগস্টের শেষ দিকে প্রাথমিক অনুসন্ধানে ঢাকায় আসেন মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের তিন সদস্য। তারা কীভাবে কাজ করবেন, কী সহযোগিতা লাগবে– তা সরকারকে জানান। একই সঙ্গে বাংলাদেশের চাহিদা সম্পর্কে জেনে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা সারে। এর পর মূল তদন্ত দল ঢাকায় আসে সেপ্টেম্বরে। চার সপ্তাহ বিভিন্ন জেলা সফর করে মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ফিরে যায়।
তথ্যানুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার পক্ষ থেকে তদন্তের স্বার্থে সব ধরনের নথি যাচাই করার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাহিদা অনুযায়ী নথি মেলেনি। বাংলাদেশ সরকার তথ্য দিয়েছে ঠিক, তবে তা আংশিক। জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়ে তথ্য চেয়ে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।
গত ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তথ্য-উপাত্ত চায়। প্রথমবার ১২ সেপ্টেম্বর তথ্যানুসন্ধান দল সরকারকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তথ্য দিতে বলেছিল। কিন্তু সরকার তা পারেনি। পরে অক্টোবরে আবারও চিঠিতে ৪ নভেম্বর সময় বেঁধে দেয়। এবারও ব্যর্থ হয় সরকার। অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, সম্প্রতি তারা জাতিসংঘকে তথ্য দিয়েছে। কিন্তু কবে, তা বলতে রাজি হননি সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার পাশাপাশি একটি ভিতের ওপর টিকে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে বাহিনীগুলো যে ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তা নিজ দেশের নাগরিকদের প্রতি সম্ভব ছিল না। ফলে সরবরাহ করা তথ্য বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সরকার মনে করছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের তথ্য গেলে যেমন দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে, তেমনই বাহিনীগুলো বিশ্বে নানা সমালোচনা ও হয়রানির মুখে পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন করে দেশকে গড়ে তোলার কাজ ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একাধিকবার জাতিসংঘ দল অনুরোধ জানালেও সাড়া মেলেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশের কাছে ১৬ ধরনের তথ্য চেয়েছিল জাতিসংঘের তদন্ত দল। এর মধ্যে অন্যতম হলো, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কতজন নিহত ও আহত হয়েছেন– এর তথ্য নাম, তারিখসহ শহর, লিঙ্গ, বয়স ও ধর্ম অনুযায়ী দিতে হবে। মৃত্যুর কারণও জানতে চায় তারা। নিরাপত্তা বাহিনীর কতজন সদস্য এ সময়ের মধ্যে নিহত ও আহত হয়েছেন, তাও জানতে চেয়েছে তথ্যানুসন্ধান দল।
জুলাই-আগস্টে সামরিক, আধাসামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য চেয়েছে প্রতিনিধি দল। কোন শহরে কোন বাহিনী, বাহিনীর ইউনিট, কারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সে বিষয়ে নথিসহ তথ্য চায়। এর পাশাপাশি কোন কোন ধরনের অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করা হয়েছে, ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার, গাড়িসহ প্রধান সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে, কোথায় এগুলো মোতায়েন করা হয়, তাও চেয়েছে।
ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অভিযান পরিকল্পনা, বল প্রয়োগের মাত্রা এবং রুলস অব এনগেইজমেন্টের লিখিত, এসএমএস অথবা মৌখিক নির্দেশের তথ্য চেয়েছে। কী পরিস্থিতিতে অস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তারও তথ্য চেয়েছে। ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের কোথায় রাখা হয়েছিল, কারা আটক করেছিল, আটক জায়গার দায়িত্বে কারা ছিলেন, তাও চেয়েছে জাতিসংঘ।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল এবং তার সত্যতা ও আইনি ভিত্তি জানতে চেয়েছে তথ্যানুসন্ধান দল। গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে এবং গ্রেপ্তারের পর কী ধরনের নির্দেশনা ছিল, আহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের জন্য কী নির্দেশনা ছিল, চিকিৎসকদের মৃত্যু সনদ দেওয়াসহ ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে কী নির্দেশনা ছিল, জানতে চায় জাতিসংঘ।
জুলাই-আগস্টের অপরাধকে কেন্দ্র করে বর্তমানে কী ধরনের ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও জানতে চাওয়া হয়। কারা নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল, সহিংসতার নির্দেশ দিয়েছে কারা, তারও তথ্য চেয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবেদনও চায় তথ্যানুসন্ধান দল। এ ছাড়া কারফিউ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, নারী-শিশুসহ যৌন নিপীড়ন, আন্দোলনকারী, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি, হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর তথ্যের বিস্তারিত চেয়েছে জাতিসংঘ।