Sharing is caring!
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও সংযোজন বিয়োজন করা হয়েছে নানা তথ্য উপাত্ত। এখন আর গরুর রচনা শেখানো হয় না। অন্নেষণ করা হয় শিক্ষার্থীর সৃজনশীল মেধার। চেষ্টা করা হয় দক্ষ, কর্মট, মানবীর মুল্যবোধের মানব তৈরী করার। এ কারণে নতুন পাঠ্য বইয়ে, সিলেবাসে, শিখন সামগ্রীতে নিত্য নতুন ধারনা যুগোপযোগী বিষয়াবলী প্রর্বতন করা হয়েছে। তবে প্রবর্তিত শিক্ষানীতি,সিলেবাস, পাঠ্যবইয়ের বিষয়াবলী নিয়ে রয়েছে নানাবিধ তর্কবিতর্ক। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে অনাকাঙ্খিত ভুল ভ্রান্তির কাটা ছ্যাঁড়া।
এক এক সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের দলীয় ভাবধারা ও মতাদর্শ প্রয়োগ করতে চায়। এই হবে তো সেই হবে না।ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক, মেধাবী,স্বপ্ন দ্রষ্ট্রা, কমর্ট তরুণ প্রজন্ম গড়ে ওঠার পরিবর্তে দলীয় লেজুর ভিত্তিক ধ্যান ধারনার শিক্ষার্থীর জন্ম হয়। তাদের মস্তিস্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ভুল তথ্য। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কোনটা সত্য বা অসত্য।
যেমন স্বাধীনতার ঘোষক কে ছিলেন — বঙ্গবন্ধু না জিয়াউর রহমান।এ নিয়ে পাঠ্য বইয়ে বিভিন্ন বিতর্ক ছিলো। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সপ্তম শ্রেণির একটি পাঠ্য বইয়ে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে পরিচিত করে দেয়া হয়েছিলো।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমানকে উধাও করা হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক।এখানেই শেষ নয় — ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে ‘ স্বাধীন বাংলা বেতার ‘ অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে ‘ ২৬ শে মার্চ দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। অথচ ইতিহাস বলে জিয়াউর রহমান প্রথম বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেছিলে। এখানেও রয়েছে ঘোষণা পত্রটি পাঠ করা নিয়ে বিতর্ক।কোমলমতি শিশুরা কোনটিকে সত্য বলে মেনে নিবে।
অবাক হয়ে যাই পাঠ্য পুস্তক প্রণেতারা চৌর্যবৃত্তি করে কি করে? ২০২৩ সালে সপ্তম শ্রেণির বিঞ্জান বইয়ে “অনুসন্ধানী পাঠ ” এর একটি অংশ ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক এডুকেশান্যাল সাইট থেকে হুবহু চুরি করে অনুবাদ করা হয়,যা চৌর্যবৃত্তি তুল্য অপরাধ।ব্যাপক আলোচনার পর এই অংশটুকু প্রত্যাহার করা হয়।
মাঝ মাঝে ফেইজ বুকে চিৎকার করে অভিবাককে বলতে দেখি — আজকাল সিলেবাস অনুযায়ী বই পত্র থেকে পড়াশোনা করার পর্ব উধাও হয়ে গেছে। এখনকার শিক্ষা হয়েছে কচিং নির্ভর। বর্তমান শিক্ষা পণ্য সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। যে অভিভাবক যত বেশী কোচিং খাতে বিনিয়োগ করবে, তার সন্তান তত ভালো ফলাফল করবে। গরীবের সন্তান অতি মেধাবী না হলে পড়াশোনায় স্বাক্ষর রাখতে পারবে না।এই কোচিং শিক্ষা ওঠানোর জন্য অতীতে বহু উদ্যাগ নেয়া হয়েছে।কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রের এই ভাইরাসটিকে নির্মূল করা যাচ্ছে না,বরং গ্রহনযোগ্যতা বাড়ছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার একমুখী শিক্ষানীতি চালু করতে চেয়েছিল।কবির চৌধুরীর প্রণীত এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তক দলগুলো বিরুধীতা করে বলে –একমুখী শিক্ষা বাস্তবায়িত হলে দীনি শিক্ষা বাদ দিয়ে খোদাদ্রোহী শিক্ষা চালু হবে।(প্রথম আলো ৮ আগস্ট ২০০৯)। ফলে প্রচন্ড বিরুধীতার কারণে একমুখী শিক্ষা চালু করা সম্ভব হয়নি।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রাথমিক স্তরের বাংলা বইয়ের একটি ছড়ার পঙক্তি নিয়ে বিঞ্জ মহলে আপত্তি ওঠেছিলো। সেই ছড়ার পঙক্তি দুইটি ছিলো –রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে/ শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।প্রশ্ন ওঠেছিলো , রাখালের সন্তানের কি শিক্ষার অধিকার নেই? সবার শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে পাঠ্য বই থেকে ছড়াটি সরিয়ে ফেলা হয়।
এ দিকে ধর্ম ও বিঞ্জান নিয়ে রয়েছে পাঠ্য বইয়ে বিপরীত মুখী বিতর্ক। তার প্রধান কারন হলো সৃস্টিতত্ত্ব ও বিবর্তনবাদ। ধর্মীয় ব্যাখ্যা সৃস্টিকর্তার বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল, যা ঈশ্বর বা স্রষ্ট্রার সঙ্গে সংযুক্ত।বিঞ্জান বিশেষ করে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ সৃষ্টিতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বলে যে প্রজাতিরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ অক্টোবর,২০২৪)।আলেমদের বিতর্কের প্রক্ষিতে ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজবিঞ্জান বইয়ের ডারউইনের বিবর্তনবাদ এনসিটিবির নির্দেশে প্রত্যাহার করা হয়।আবার সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিঞ্জান বইয়ের শরীফ বনাম শরীফা গল্পটি নিয়ে ধর্মীয় সমালোচনা থাকায়, সে গল্পটিও প্রত্যাহার করা হয়।
কোমল মতি শিশুদের জন্য প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বর্ণ শেখার কৌশলে ও বর্ণটি দিয়ে ওড়না পরিচয় করানো হয়েছিল। এ ব্যাপারে লিঙ্গ বিষয়ক সংবেদনশীল সমালোচনার ঝড় ওঠে।অ বর্ণে অজ হিসেবে ছাগলের গাছে ওঠার ছবি নিয়েও সমালোচনা হয়েছিলো।
২০১৭ সালে বাংলা পাঠ বই থেকে হিন্দু ও বিধর্মী লেখকদের যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়,কালিদাস রায়,সত্যেন সেন,রণেশ দাস গুপ্ত, হুমায়ুন আজাদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ঞ্জানদাস, ভারতচন্দ্র প্রমুখ লেখকদের লেখা বাদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছিলো(বিডিনিজ, জুলাই ৭, ২০১৭)।এ ভাবেই জিকজাক পথে চলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
এখানে আরো উল্লখ্য করা যায় — গ্রামের কলেজগুলো ও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষিত বেকারের জন্ম দিচ্ছে।তারা না পায় চাকুরী বা না করতে পারে চাষাবাদের মত নিম্ন পর্যায়ের পরিশ্রম।বহু পরিবার এই ধরনের শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে আছে বেকায়দায়।আমার বক্তব্য হলো- সবাইকে উচ্চ শিক্ষা নিতে হবে এমন কথা নেই।বরং ব্যাপক হারে স্কুল পর্যায় থেকে কর্মভিত্তিক শিক্ষার আয়োজন রাখা দরকার। যেমন কে হবে কাঠমেস্তরী,রড় মেস্তরী,রাজ মেস্তরী বা অন্য পেশায় যাবে তার সার্টিফিকেট স্কুল প্রধান দেবে — এমন ধরনের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
খুব নিকটবর্তী বিগত সরকার নবম দশম শ্রেণিতে বিঞ্জান,মানিবক,কমার্স বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে একমুখী নীতি নির্ধারন করেছিল।২০২৪ সালে অন্তবর্তীকালিন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিধিটি প্রত্যাহার করে,আবারও সিলবাসকে তিনটি বিভাগে বিভাজন করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করে অন্তবর্তিকালিন সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের প্রণীত বইগুলো পরিমার্জন ও সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিলো। কিন্তু ধর্মীয় গোষ্ঠীদের বাঁধার মুখে বাতিল করা হয়।
পরিশেষে বলছি — আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে আর কতো কাটাছ্যাড়া,একপ্রিরিমেন্ট চলবে। অথচ গ্লোবাল বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে হলে বিঞ্জান মনস্ক,অস্মপ্রদায়িক চেতনার,আর্ন্তজাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন।এই চিন্তা মাথায় রেখে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা অবশ্যই যুগোপযোগি শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করবেন।
লেখকঃ কবি,প্রাবন্ধিক,গবেষক, সংগঠক,সাবেক সিনেট সদস্য -জাবি,প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।