আবু মকসুদ
সৌমিত্র দেব টিটো আমার শৈশব এবং কৈশোরের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে লেখালেখির জগতে পা রেখেছিলাম, তখন আমাদের ভেতরে ছিল নবীন উদ্যম আর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের সুর। আমাদের ছোটবেলার দিনগুলো যেন কাটত সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক নির্মল হাওয়ার মতো।
স্কুলের পর আমরা প্রায়ই বই হাতে বসে যেতাম কবিতার ছন্দ নিয়ে খেলতে। একসঙ্গে স্বপ্ন দেখতাম, একদিন আমাদের লেখালেখি সমাজকে বদলাবে। কিন্তু আজ লজ্জা হলেও সত্য, লেখালেখি শব্দটা অনেক আগেই আমাকে ছেড়ে গেছে। আর সৌমিত্র থেমে না থেকে একের পর এক সাফল্য অর্জন করেছে। মৌলভীবাজার, সিলেট হয়ে ঢাকায় পৌঁছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সে। তার নাম এখন দেশের এক নামী কবি এবং সাংবাদিকের তালিকায় উঠে এসেছে। আর আমি? আমি হয়তো সেই সাফল্যের কাছে পৌঁছাতেও পারিনি।
একদিন লন্ডনে কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে এক আড্ডায় কথা হচ্ছিল। সিলেটের কিছু উল্লেখযোগ্য কবির নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি প্রথম যে নামটি বললেন, সেটা ছিল সৌমিত্র দেব। আমি শুনে আনন্দিতও হলাম, আবার কোথাও যেন মনের ভেতর নিজের ব্যর্থতার গ্লানি অনুভব করলাম। সৌমিত্র ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। যদিও আমি সরাসরি সেই রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না, তবু মাঝে মাঝে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতাম। আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তেমন ফারাক ছিল না, তবে সৌমিত্র ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি থাকায় সরাসরি সমালোচনা থেকে দূরে থাকত। আর আমার তেমন কোনো বাধা ছিল না, তাই অন্যায় দেখলে আমি চুপ করে থাকতে পারতাম না।
আমাদের মধ্যে একটি জিনিস বরাবরই অটুট ছিল—বাকস্বাধীনতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা। আমরা বিশ্বাস করতাম যে, মানুষকে তার মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে, সেটা যে কোনো সরকারের অধীনে থাকুক না কেন। বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন সেই বাকস্বাধীনতার মূল ভিত্তিকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। দেশের ক্ষমতায় বসেছে কিছু নাবালক এবং অবসরপ্রাপ্ত, যাদের মুখে বড় বড় আদর্শের কথা, কিন্তু ভেতরে তারা শূন্য। তারা প্রতিনিয়ত তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে জাতীয় অর্জনগুলো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা কথায় বলে যে মানুষের বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে, অথচ বাস্তবতায় তারা মানুষের কণ্ঠ চেপে ধরছে।
আমাদের মধ্যে তখন থেকেই রাজনৈতিক মতভেদ খুব বেশি না থাকলেও, সৌমিত্রের ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি থাকা, এবং আমার নিজস্ব ভাবনায় স্বাধীনভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার ইচ্ছা, আমাদের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা তৈরি করেছিল। সৌমিত্র সাংবাদিকতা এবং কবিতার জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকলেও, কখনো কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ বা নেতিবাচক মন্তব্য করেনি আমার বিষয়ে। এটি আমার প্রতি তার ভেতরের সম্মান এবং সততার একটি প্রতিচ্ছবি ছিল।
আজকের এই ক্ষমতাসীন নাবালক সরকার, যারা নিজেদের ন্যায়পরায়ণ হিসেবে প্রচার করতে চায়, তারা আসলে এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আমার বন্ধু সৌমিত্র যখন তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিল, তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। সে কেবল নিজের কণ্ঠের মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়েছিল, কিন্তু তথাকথিত বৈষম্যবিরোধী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। এটা কি সত্যিকার অর্থে বাকস্বাধীনতা?
এই বৈষম্যবিরোধী নামধারী সরকার আসলে বৈষম্যেরই ধারক-বাহক। তারা মুখে বলে বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার কথা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের কাজই হচ্ছে মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া। আজ তাদের হেলমেট বাহিনী নেই, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের হয়ে কাজ করছে। সেই শক্তি কি কোনো মুখোশধারী ক্ষমতাসীন? আজ যারা নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষক দাবি করছে, তারা আসলে এক ভয়ংকর দানব, যারা মুক্ত কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
সময় কাউকে ক্ষমা করে না। হাসিনা সরকার যেমন শেষ পর্যন্ত জনগণের অসন্তোষের মুখে পড়েছে, ঠিক তেমনি এই নব্য সরকারও পড়বে। তাদেরও পতন আসন্ন। যারা আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেয় না, তাদের একদিন মুখ বন্ধ হবে ইতিহাসের কঠিন বিচারে। মানুষের কণ্ঠ কখনো চিরতরে থামানো যায় না। সত্য কথা সব সময়ই ফিরে ফিরে আসে, এবং সেই সত্যের সামনে সব অন্যায়, সব স্বৈরাচারী শক্তি ভেঙে পড়ে।
সৌমিত্রের ওপর হামলা শুধু তার একার ওপর নয়, এটি একটি জাতির কণ্ঠস্বরকে চেপে ধরার প্রচেষ্টা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, কেউ কখনো মানুষের কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করতে পারেনি।
আবু মকসুদ ঃ লেখক, সম্পাদক , বর্তমানে বিলেত প্রবাসী
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2024 RED TIMES. All rights reserved.