‘বাংলাদেশের বিশাল গ্রামজীবনের বাস্তবতায় বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সংকট ও দ্বন্দ্ব- সংঘাত এমন জীবন্তভাবে ফুটে উঠতে খুব কমই দেখা যায়।’-----আহমাদ মাযহার (আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ সম্পর্কে মন্তব্য)
আবেদীন কাদের
অধিকাংশ ‘বড় মানুষ’কে, হোক সে রাজনীতির, সংস্কৃতির বা সাহিত্যের বা শিল্পের, তাঁদের সবাইকে সম্ভবত ‘বড়’র মতো দেখায়, আসলে কেউ খুব একটা বড় নয়! এই ‘বড়’র সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কে যাওয়ার আগে সত্যিই ভাবনার বিষয়, বড়র মাপকাঠি আসলে কী! আমি নিজে এই মাপকাঠি ঠিক করার কেউ নই, কেউ কেউ ‘সফলতা’ দিয়ে বড়র বিচার করেন, কেউ চূড়ান্ত প্রতিকূল সময়ে বিপক্ষে থাকা মানুষকে হৃদয় বা মানবিকতা দিয়ে বিচার করার ক্ষমতাকে ‘বড়’র সবচেয়ে বড়ত্বের মাপকাঠি ধরেন। অনেকদিন আগে একবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিরিজ বিজয়ী হওয়া ঘোষণা হয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেল শেষ বলটি ‘নো বল’ ছিলো ধরিয়ে দিয়ে নিজের দলের পরাজয় নিজেই স্বীকার করে নিলেন, কিন্তু ইতিহাসে হয়ে রইলেন নৈতিকতার চিহ্ন হয়ে! মোহন দাশ গান্ধী নিজের অহিংস আন্দোলনে নিজেরই সমর্থকদের সহিংস হয়ে ওঠার প্রতিবাদ ও নিজের ভুল ও পরাজয় মেনে নিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ডাক দিলেন, উত্তোলন করে নিলেন কর্মসূচি! এও এক ধরণের পরাজয়, নিজের সমর্থকদের বুঝতে না পারা!
কিন্তু রাজনীতির নৈতিকতার ‘চিহ্ন’ হয়ে রইলেন ইতিহাসে। দেশভাগ মেনে না নিতে পেরে গান্ধি নিজের আত্মার পরাজয় মেনে উপবাসে গেলেন নিজের শুদ্ধিকরণে! এই আদর্শের সঙ্গে রাজনীতির চালাক বা ‘সফল’ মানুষরা একমত হবেন না হয়তো, কিন্তু অহিংসতাকে যিনি নিজের অন্তর্গত জীবনদর্শন ভেবেছেন, তাঁর মহত্ত্ব বা ‘বড়ত্বকে’ সহজে বোঝা একটু কঠিন। আমাদের বাংলার মুসলমান সমাজে তেমন বড় মানুষ সৃষ্টি হয় নি ইতিহাসে। গত প্রায় দুই দশক আমাদেরই একজন আন্তর্জাতিকভাবে ‘সন্মানীয়’ মানুষকে আমরা ‘বড়’ মানুষ হিশেবে ভেবে আসছিলাম। কিন্তু তিনিও যখন লিটমাস টেস্টের সামনে পড়লেন, নিজেকে ভীষণ ‘ছোট’ ব্যবসায়ী মানুষ বা লাভের অন্বেষণী একজন সাধারণ তেজারতি মানুষ হিশেবেই প্রমাণ করলেন। একটি জাতি বা রাষ্ট্রকে এর অগোছালো অরাজক অবস্থা থেকে নিজের নৈতিক ধীশক্তি দিয়ে তুলে মহত্তর আধুনিক গণতান্ত্রিক ও নৈতিক সমাজ হিশেবে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক অন্তর্গত শক্তি যে তাঁর নেই তাই বার বার প্রমাণ করে যাচ্ছেন!
গত প্রায় তিন মাস ধরে যে কোন আড্ডা, বা বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কথাবার্তায়, এমনকি একাকী নীরবে বসে ভাবনায়ও আমরা কিছুতেই নিজের দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বাইরে কোনকিছুকেই চিন্তায় স্থান দিতে পারছি না, এও এক অসহায়ত্ব! তবে একটা বিষয় নিজের মনের কাছে একেবারে পরিষ্কার হয়ে উঠছে, সেটা হলো আমার শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজনের কথা আমি রাজনীতি নিয়ে ভাবলে কিছুতেই ভুলতে পারি না। তাঁদের প্রায় সবাই নিউ স্কুলের। গত মাস তিনেক ধরে দ্রুত সময় বদলাচ্ছে, নাকি দ্রুত সময়ের ছবিগুলো চোখের সামনে তার রূপ বদলে নিচ্ছে, তাই আমি ভাবি। আমার যখন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার রাজনীতি বিষয়ে বুঝতে খুব ধোঁয়াটে অবস্থা মনে হয় নিজের কাছে, তখনই ভাবি অধ্যাপক এনড্রু এরাটোর কথা। অধ্যাপক এরাটো নেপালের শাসনতন্ত্র, বিশেষ করে রাজতন্ত্র চলে যাওয়ার পর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এই দেশটিতে যখন গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরি হয়, তখন জাতিসংঘ ও মার্কিন স্টেট ডিপার্টম্যানটের আমন্ত্রণে একজন বিশেষজ্ঞ হিশেবে এই শাসনতন্ত্রের উপদেষ্টা হিশেবে কিছুদিন কাজ করেছেন। এছাড়া আফ্রিকার দুটি দেশ, ও তুরস্কর সর্বশেষ শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের সময় একাডেমিক উপদেষ্টা হিশেবে কাজ করেছেন।
এসব অভিজ্ঞতার প্রায় সবগুলোই তিনি তাঁর ক্লাসে পড়ানোর সময় আলোচনা করতেন, কারণ প্রায় আড়াই দশক আগে শাসনতন্ত্র রচনা (Constitution Making) বিষয়ে তিনি দুটি কম্প্রিহেন্সিভ কোর্স আমাদের পড়িয়েছেন। আমি সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয়েছিলাম নেপালের শাসনতন্ত্র বিষয়ে। কিন্তু নেপালের গণতান্ত্রিক প্রতিকূলতা কিছুটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের প্রতিকূলতার কাছাকাছি। আমার উৎসাহের এটাই ছিলো মূল কারণ। কিন্তু অধ্যাপক এরাটো ভাবতেন নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্র-সমস্যার তেমন মিল নেই, বরং অনেক বেশি মিল মিসরের গণতন্ত্রহীন সমাজব্যবস্থার। কিছুটা বা তুরস্কের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও যে মিসর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারছে না, সেটার মূল প্রতিবন্ধকতা যেমন সে-দেশের সেনাবাহিনী, তেমনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সমস্যা প্রায় কাছাকাছি।
যদিও ইন্দোনেশিয়া অত্যন্ত প্রাকৃতিক সম্পদসম্পন্ন দেশ বলে তার কিছুটা অনুকূল অবস্থা রয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান বা বাংলাদেশের বা আফ্রিকার কয়েকটি প্রাক্তন উপনিবেশিক দেশের পক্ষে গণতন্ত্র বা আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ভিন্ন কারণে কঠিন। আমি এ বিষয়ে ছাত্রজীবনে বছরের পর বছর অধ্যাপক এরাটোর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে তক্কাতক্কি করেছি, বরং আমার অনেক বেশি কাছাকাছি ভাবনা রয়েছে নিউ স্কুলের আরেক অধ্যাপকের মন্তব্যের সঙ্গে। তিনি অধ্যাপক এলেন টোরেন। অধ্যাপক টোরেন আমাদের দুই সেমিস্টার পড়িয়েছিলেন ২০০১/২০০২-এ, তিনি সে সময় বেশ বয়সী অধ্যাপক, প্রায় সাতাত্তর বছর ছুঁয়েছেন। ফ্রান্স থেকে এসে অতিথি অধ্যাপক আমাদের। পড়াতেন পলিটিকেল থিওরি। বিশেষ করে সোশ্যাল মুভম্যানট ও সোশ্যাল রেভুলিউশন । এর প্রায় পঁচিশ বছর আগে তিনি জগৎ বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, ফরাসি বিখ্যাত ইকোল নরমেলে পড়াতেন, সোরবোর্ণে দীর্ঘদিন পড়িয়েছেন, বার দুয়েক বিশ্ব সমাজবিজ্ঞান সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। সোশ্যাল মুভম্যানট পড়ানোর সময় বার বার অধ্যাপক থিডা স্ককপলের কথা বলতেন। অধ্যাপক স্ককপলের বিপ্লব বিষয়ে আঁকর গ্রন্থ আমাদের আগেই পড়া, আমি তাঁর অনুরাগী পাঠক। অধ্যাপক টোরেন একদিন ক্লাসের বাইরে বিভাগের ছোট কিচেন রুমে কথা বলতে বলতে কফি বানাচ্ছিলেন, আমি তাঁকে সাহায্য করছিলাম, তিনি আমাকে হঠাৎ বললেন, ‘The notion of social movement, like most notions in the social sciences, does not describe part of ‘reality’ but is an element of a specific mode of constructing social reality.’ কেন তিনি সামাজিক আন্দোলনকে সামাজিক ‘সৃষ্ট বাস্তবতার’ অংশ মনে করেন তা বুঝতে পারিনি। আমি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, ‘বাস্তবতাকে’ তিনি ‘সৃষ্ট’ বলছেন কেন!
এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে অধ্যাপক টোরেন বরং আমাকেই কিছুটা কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি বাস্তবতাকে ঈশ্বর সৃষ্ট বা প্রদত্ত ‘অবস্থা’ মনে করো কিনা!’ আমি একটু বিহবল হলাম, কী উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না। আমি জানি অধ্যাপক টোরেন ডুরখেমিয়ান নন। তাহলে সবকিছু সমাজ নির্দিষ্ট ‘প্রতাপ’ সৃষ্ট এটা বিশ্বাস করতেও আমার মন সায় দেয়নি তখনও। আমি জানতাম যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলন বা যে কোন রাজনৈতিক সংঘাতকে এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের অংশ হিশেবে বিচার করা হতো। আড্ডায় আহমাদ মাযহার, কবি শামস আল মমীন ও লেখক আদনান সৈয়দের সঙ্গে তক্কাতক্কি করার ফাঁকে ফাঁকে আমি শুধু অধ্যাপক টোরেনের সেই প্রায় দুই দশকের বেশি আগে বলা কথাগুলোকেই মনে করছিলাম। আমার বন্ধুদের অনেকেই সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনকে একটা নির্দিষ্ট সমাজাদর্শের অংশ হিশেবে দেখেন, তারা কেউ কেউ মনে করেন সামাজিক বা রাজনৈতিক স্থিরতা বা প্রলম্বিত উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের জন্য আন্দোলন বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু অধ্যাপক টোরেন ভীষণভাবে প্রাগমেটিষ্ট, তাই তিনি যে কোন সমাজচিত্র বা সমাজবাস্তবতাকেই ‘প্রতাপ সৃষ্ট’ অবস্থা মনে করেন, কোন ইলুসরি বা কল্পিত অবস্থা ভাবেন না! কেন আমার বার বার অধ্যাপক টোরেনের কথাগুলো মনে পড়ছিলো, সেটা আমি জানি, কারণ সম্ভবত আমাদের দেশের গত তিন মাসের রাজনৈতিক এবং সমাজবাস্তবতা নিয়ে ভাবতে গিয়ে ভীষণ দ্রুত গতিতে আমাদের চিন্তাসূত্র ও ধারণার বিবর্তন হচ্ছে। প্রায় দুচারদিন পর পরই আমাদের ধারণা ঠিক আগের মুহূর্তের ধারণা থেকে ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে! হয়তো আমাদের মন নিজেদের অজান্তেই খুব নাইভ ও ইলুসরি হয়ে উঠছে, কিছুতেই কঠোর ও তেতো সত্যের বাস্তবতাকে বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে না। অন্ধকারে মানুষ যখন ভয় পায়, তখন নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য মানুষ নিজেকেই যেমন শাসায় ও নিজের কণ্ঠস্বর উঁচুতে নিয়ে গিয়ে আবোল তাবোল বলতে থাকে, আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা যখন নিজেদের চিন্তার সঙ্গে মিলে না, তখন আমরা ভাবতে শুরু করি যে আমরা ভুল করছি না, বরং সমাজ ঠিকভাবে কোন এক অজ্ঞাত কারণে কাজ করছে না। আর সেই অজ্ঞাত কারণও আমরা ঠিক বুঝতেও পারছি না।
এরপর আমাদের আড্ডাটা আমরা প্রায় জোর করে নাকি নিজেদের উদ্বেগ ভুলে থাকার জন্য সাহিত্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, সেটা না বুঝেই আমরা সাহিত্য বিষয়ে কথা তুলি। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বন্ধু অধ্যাপক ডঃ ফারজানা সিদ্দিকার লেখা ‘নারীর সৃষ্টিঃ নারীর দ্বন্দ্ব’ বইটি নিয়ে কিছু কথা বলতে। এই বইটি আমি পড়া শুরু করি কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁর লেখা অভিসন্দর্ভ ‘নারীর উপন্যাসে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণঃ দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ’ পড়া শেষ করে। দুটি বই নিয়েই কিছু কথা বলার জমা হয়েছে। কিন্তু মাযহার কথা বলছিলেন কথাশিল্পী আবু ইসহাকের লেখা প্রসঙ্গে। আমি তখন ফারজানা সিদ্দিকার লেখা বিষয়ে পরে কথা বলবো ভেবে মাযহারের কথা শোনায় বেশি আগ্রহী হই। আবু ইসহাঁক শুধু আমার প্রিয় লেখক সেজন্য নয়, তিনি আমার প্রায় প্রতিবেশী, যেখানে আমি জন্মেছিলাম সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরেই একটি গ্রামে জন্মেছিলেন কথাশিল্পী আবু ইসহাক। মাযহার জানালেন তিনি একটি সংক্ষিপ্ত লেখা লিখেছেন তাঁর সম্পর্কে, আমরা তাঁকে অনুরোধ করলাম লেখাটা পড়তে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমাদের আড্ডায় বদরুন নাহার বা স্বপন বিশ্বাস এই দুই কথাশিল্পীও আজকাল সাহিত্য ছেড়ে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনায় যোগ দেন। সত্যি বলতে একেবারে নির্জলা নন্দন নিয়ে ভাবা আমরা প্রায় ভুলেই গেছি গত কয়েক মাস। চিত্রকলা, ধ্রুপদী সঙ্গীত বা সাহিত্য বিষয়ে গভীর আলোচনা ভুলে যেতে বসেছি আমরা। একাকী থাকলে বার বার মনে হতে থাকে, আসলে আমাদের মন কি সত্যিই শিল্পকলা নিয়ে নিমগ্ন থাকতে চায়, নাকি আমরা যাই বলি না কেন, দেশের রাজনীতি বা সমাজভাবনাই আমাদেরকে দীর্ণ করে সবচেয়ে বেশি!
মাযহারকে লেখাটা পড়তে অনুরোধ করলে তিনি লেখাটা পড়ে শোনালেন। মাযহারের লেখাটা শুরু হয় বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের একটি অমোঘ আকাঙ্ক্ষা বিষয়ে বর্ণনা দিয়ে। মাযহার লিখেছেন, ‘বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে বাঙালি মুসলমান সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটি বিকাশোন্মুখ স্তরে উপনীত হয়েছিল। সমাজের এই শ্রেণীর একটি অংশের মধ্যে জেগে উঠেছিল আত্মানুসন্ধানের প্রবণতা। পূর্ববাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ একদিকে ছিল মুসলমান প্রধান, অন্যদিকে নদীমেখলা। এই ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের মধ্যে বুর্জোয়া বিকাশ যথেষ্ট লক্ষযোগ্য মাত্রায় না ঘটলেও বুর্জোয়া সমাজের মতোই বাংলার মুসলমান সমাজেও ব্যক্তিসত্তার নানা বিপর্যয় ও সংকট অনুভূত হতে শুরু করে। ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোয় শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ব্যক্তির এই টানাপড়েন অনুভূত হয়েছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। এরই প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির সংকটের চিত্র সে-সময়ের শিল্প-সাহিত্যে উঠে আসতে থাকে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে বাংলার মুসলিম সমাজে অনুভূত ব্যক্তির সংকটকে কথাসাহিত্যের শৈল্পিক আধারে সার্থকভাবে যে দু-একজন লেখক তুলে ধরতে পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে আবু ইসহাক উল্লেখযোগ্য। ...পদ্মানদী সংলগ্ন অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম ও তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। এটি তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালে এবং সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে। এর প্রথম লেখনের অংশ বিশেষ মে ১৯৭৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালব্যাপী বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত উত্তরাধিকার পত্রিকায় মুখর মাটি নামে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র খ্যাতির কারণে হয়তো এর দিকে পাঠক-সমালোচকের তেমন দৃষ্টি পড়ে নি। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষভাগে নদীপ্রধান বাংলাদেশের নদীভাঙন ও জেগে-ওঠা চরদখলের জীবনবাস্তবতার পটভূমিতে কৃষিজীবী মানুষের দ্বন্দ্ব ও সংকটকে ফজল-জরিনা-রূপজান-এর ত্রিভূজ প্রেমের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন তিনি তার যথার্থ বিচার বিশ্লেষণ এখনও সম্পন্ন হয়নি। যথার্থ বিচার পেলে এর শিল্পমান সম্পর্কে হয়তো রুচিমান পাঠকের ধারণাই বদলে যাবে। বাংলাদেশের বিশাল গ্রামজীবনের বাস্তবতায় বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সংকট ও দ্বন্দ্ব- সংঘাত এমন জীবন্তভাবে ফুটে উঠতে খুব কমই দেখা যায়।’
আবু ইসহাকের কথাশিল্প নিয়ে মাযহারের মূল্যায়ন মূল্যবান। আমি ছেলেবেলা থেকে এই লেখকের লেখা পড়েছি আর মুগ্ধ হয়েছি, এর প্রধান কারণ হয়তো ব্যক্তিগত। আমাদের পিছিয়ে থাকা এলাকার মানুষদের কারোরই তেমন বড় কোন অর্জন নেই, না রাজনীতি বা শিল্পসংস্কৃতিতে, তাই আমার বাড়ির কাছের মানুষদের সৃষ্টি বিষয়ে আমার নিজের কিছুটা আবেগ কাজ করতো। কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময়ই আমি তাঁর লেখার সঙ্গে ও জীবনপঞ্জি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাই। সেই থেকে মনের কোণে এই কথাশিল্পীর জন্য আমার ভিন্ন একটা শ্রদ্ধার আসন তৈরি হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন তাঁর উপন্যাস ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্র আকারে দেখি তখন তাঁর প্রতি নতুন করে একটা গর্ববোধের সৃষ্টি হয় মনে। মনে আছে বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম ‘৮০ সালের ডিসেম্বরে পুরানা পল্টনে রইসউদ্দীন ভাইয়ের এডভারটাইজিং ফার্মের অফিসে পরিচালক মসিউদ্দীন শাকেরের সঙ্গে পরিচয় হলে। রইস ভাইয়ের অফিসে ভালো বিদেশি সিগারেট ও পানীয়র বিনিময়ে আমি বিজ্ঞানের ইংরেজি নিবন্ধ ও প্রতিবেদন লিখে দিতাম সে-সব দিনে। হঠাৎ কোন জরুরি লেখার প্রয়োজন হলে রইস ভাই আমাকে বাসা থেকে তাঁর নীল রঙয়ের ফক্সওয়াগানে তুলে নিতেন। সারাদিন ও কোন কোন দিন গভীর রাত অবধি প্রতিবেদন লিখতাম বিজ্ঞাপনী ম্যাগাজিনের। রইস ভাই পূর্বানী হোটেল থেকে ভাল খাবার এনে খাওয়াতেন। অসাধারণ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন রইসউদ্দিন ভাই। তাঁকে নিয়ে লিখেছি আমার একটি স্মৃতিলেখায়। তিনিই আমাকে শাকের ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আবু ইসহাকের লেখা সম্পর্কে আমার অনুরাগ ও মূল্যায়ন শুনে খুশি হয়েছিলেন। তাঁর নির্মাণ করা চলচ্চিত্রটি নিয়েই একটি সংক্ষিপ্ত সমালোচনা নিবন্ধ লিখেছিলাম সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায়। তিনি সেটি পড়েও খুশি হয়েছিলেন। আজ অনেকদিন পর মাযহারের এই নিবন্ধটি শুনে ভাল লাগলো ও পুরনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ে গেলো। আমাদের কথাশিল্পের বিভিন্ন গতিপ্রকৃতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো মাযহার ও লেখক আদনান সৈয়দের সঙ্গে। কিন্তু কেন জানি না হঠাৎ করে আমাদের ‘অনন্যা’র আড্ডার কথা তুললেন আদনান। আড়াই দশকের বেশি আগে আমাদের সেই আড্ডাটা মাঝে মাঝে আদনান মনে করেন এবং আমাদেরকে স্মৃতিভারাক্রান্ত করে দেন। কবি সৈয়দ শহীদ ও আমাদের কয়েকজন বন্ধুর জীবনাদর্শ ও ভাবনা নিয়েও কিছুটা কথা হলো, সেই আড্ডার একজন বন্ধু ভীষণ বদলে গেছেন চিন্তার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি যে আজকাল প্রায়ই বানিয়ে বানিয়ে কল্পনাপ্রসূত অনেক কথা লেখেন, যাতে আমি ও আদনান দুজনেই তাঁর মনোজাগতিক পরিবর্তনের ছায়া লক্ষ করি, তা নিয়েও আমরা কিছুটা আলোচনা করলাম। কিন্তু এর মধ্যেই পাকিস্তানের সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ও মাওলানা ভাসানীর সে সময়ের রাজনীতিতে অবদান নিয়ে কথা ওঠে। ভাসানীর রাজনীতি নিয়ে আমাদের দেশে ইতিহাসবিদরা খুব একটা নির্মোহ মূল্যায়ন করেন নি। এর নানা কারণ থাকতে পারে, তবে সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত আমাদের সমাজে ইতিহাসচর্চা একেবারেই স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে গড়ে ওঠেনি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাসের অধ্যাপকরাই ইতিহাস নিয়ে লেখেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই রাজনীতি-বিবর্জিত স্বাধীন গবেষক নন, তাঁদের মাঝে জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ছিলো, তাই তাঁদের লেখাও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠেনি। এর ব্যতিক্রম নেই তা নয়, তবে সে-লেখা একেবারেই অল্প।
‘৪৭ সালের আগে ভারতীয় রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানী কোন বড় চরিত্র নন, এমনকি অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতেও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মোটেই বড় নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের নেতা। কিন্তু ভারত ভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে তিনি তরুণ বয়স থেকে আন্দোলন করে আসছিলেন জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম লীগ ও খাজা নাজিমুদ্দিন গ্রুপ যখন হোসেন শহীদ সোহরো ওয়ারদীকে রাজনীতি করতে বাধা দেন এবং তাঁকে বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তখন তিনি বাধ্য হন তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নতুন দল গঠন করতে। এই দলে তখন প্রায় সবাই মুসলিম লীগের তরুণ ছাত্রনেতারা যোগ দেন। কলকাতা থেকে সোহরোওয়ারদীর অনুসারী তরুণ নেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্যরা ছিলেন। এই নতুন দলের প্রেসিডেন্ট করার জন্য এমন একজন নেতার প্রয়োজন ছিলো যিনি মুসলিম লীগের পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের কাছে কোন হুমকি ছিলেন না। তাই সোহরোএয়ারদী ও তরুণ নেতারা মাওলানা ভাসানীকে সামনে নিয়ে আসেন এই নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা হিশেবে। মাওলানা সাধারণ মানুষ ও কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় ছিলেন। এছাড়া তিনি অবিভক্ত বাংলার শীর্ষ নেতাদের মতো বিলেতে শিক্ষিত বা আইনবিদ ছিলেন না। তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষিত মাওলানা এবং জাগতিক বৈভবের প্রতি নির্লোভ একজন কৃষক- দরদী নেতা হয়ে ওঠেন পূর্ব পাকিস্তানে। এই আওয়ামী মুসলিম লীগ পরে এর নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। এই দলের মূল নেতা ছিলেন বিলেতে শিক্ষিত আইনবিদ ও অবিভক্ত বাংলার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরোওয়ারদী। ‘৪৭ সালের দেশভাগের পর সব প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীদের পদে রাখা হলেও একমাত্র পূর্ব বাংলায় সোহরোওয়ারদীর স্থলে জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীর কারসাজিতে নাজিমুদ্দিনকে প্রধান মন্ত্রী করা হয়। কিন্তু নিজের মেধা ও নেতৃত্বের গুনে সোহরোওয়ারদী পরে পাকিস্তানের আইন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হন এবং স্বাধীনতার নয় বছর পর পাকিস্তানে প্রথম শাসনতন্ত্র রচিত হয় যার রচয়িতা তিনি নিজে, এবং তা পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দ্বারা অনুমোদিত হয়। আমাদের আড্ডায় আলোচিত হয় কী করে বা কী কী কারণে সোহরোওয়ারদী ও ভাসানীর মধ্যে মার্কিন প্রভাব বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেয় এবং আওয়ামী লীগ ছেড়ে ভাসানী নতুন দল গড়েন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ অনেকেই শহীদ সোহওয়ারদীর সঙ্গে আওয়ামী লীগে থেকে যান।
‘৫৪ সালে হক- ভাসানী মিলে পূর্ববাংলায় নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকার গঠন করে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই সরকারকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার বরখাস্ত করে। এর পরের ইতিহাস সেনাবাহিনীর শাসনের ইতিহাস। পাকিস্তান রাজনীতিতে ভাসানী যদিও বিরোধী দলীয় রাজনীতিক হিশেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, কিন্তু আমাদের ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দেন এবং জীবনের শেষদিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে চলে যান। আদনান ও মাযহারের সঙ্গে ভাসানীর রাজনীতি ও জেনারেল জিয়া ও জেনারেল আইয়ুবের প্রতি তাঁর কিছুটা কোমল সমর্থন বিষয়ে আমার তক্কাতক্কি হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে চীন যেহেতু আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাই ভাসানী আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণ সমর্থন দিলেও তাঁর দলীয় অনুসারীরা কিছুটা মতানৈক্যে ভোগে যুদ্ধে যোগ দেয়ার বিষয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাসানীর বিরাট অবদান থাকলেও তাঁর দলটি ও অধিকাংশ অনুসারীরা দুইজন সেনা স্বৈরশাসকের তল্পিবাহক হয়েই রাজনীতি করে কাটায়। ভাসানীর দলের নেতাদের এই রাজনীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের খুব একটা সহায়ক হয়নি। তাই আজ এই দলটি প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেছে। ভাসানীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বাংলাদেশে তাঁর ভূমিকা নিয়ে আমার আড্ডায় অনেকের সঙ্গেই আমার দ্বিমত হয়, কারণ আমার ধারণা তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বাইরে ছিলেন। আমি কখনোই তাঁর রাজনীতির সুস্পষ্ট কোন কর্মসূচি বা লক্ষ বুঝতে পারি না। একদিকে তিনি আইয়ুব বা জিয়ার সেনাশাসনের সমর্থক অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষের জন্যই নিস্বার্থভাবে লড়েছেন। তাই তাঁর রাজনীতিকে আমার কিছুটা ধোঁয়াটেই মনে হয়।
আড্ডায় আমার বন্ধুরা অনেকেই ভাসানীর রাজনীতির সমর্থক না হলেও কিছুটা দুর্বল এই নির্লোভ দেশপ্রেমিক মানুষটির প্রতি। আদনান ও মাযহারের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়েই দীর্ঘক্ষণ আমার তক্কাতক্কি হয়।
রাত গভীর হলে সবাই বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন। আমি নীরবে নিজের টেবিলে কাজে বসি রেকর্ডারে পছন্দের গান ছেড়ে দিয়ে!
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2024 RED TIMES. All rights reserved.