আজ শনিবার, ১লা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুড়িগ্রামের দারিদ্র বিমোচন ও জীবন মান উন্নয়নে চর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাবি

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৫, ০৩:১০ অপরাহ্ণ
কুড়িগ্রামের দারিদ্র বিমোচন ও জীবন মান উন্নয়নে চর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাবি

Sharing is caring!

মোঃ মশিউর রহমান বিপুল, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ

আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকার উত্তর জনপদের জেলা কৃড়িগ্রামের মানুষ। এর ফলে দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত জেলার তকমা পেয়েছে কুড়িগ্রাম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, জেলায় দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলছে,জেলায় অতিদরিদ্রদের হার ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ হলো নদী ভাঙ্গন এবং চরে বসবাস কারী মানুষের অনিশ্চিত জীবনযাপন।

এ পরিপ্রেক্ষিতে এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য)বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে উন্নয়ন বঞ্চিত হয়ে চর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাবী উঠেছে তৃনমূল থেকে। সম্প্রতি কুড়িগামে অনুষ্ঠিত এক নাগরিক সংলাপ থেকে জোড়ালো দাবী জানানো হয়েছে। এটির আয়োজন করে কুড়িগ্রাম জেলা চর উন্নয়ন কমিটি।

চর উন্নয়ন কমিটি কুড়িগ্রাম জেলার আহ্বায়ক অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন, কুড়িগ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ২৪লাখ। জেলাটির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে  ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমারসহ ১৬টি নদ-নদী। এগুলোর অববাহিকায় রয়েছে সাড়ে চার শতাধিক চর। প্রায় সাড়ে ৮০০ বর্গ কিলামিটার চরে বসবাস করেন সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। এসব চরে বসবাসকারী মানুষের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি।

ভৌগলিকভাবে নদী ও চরবেষ্টিত জেলা হওয়ায় অন্যান্য জেলার চেয়ে এ জেলার সমস্যাগুলো অনেকটা ভিন্ন ধরনের। এছাড়াও এ জেলার অধিকাংশ চর স্বাধীনতার পর হতে এখন পর্যন্ত উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের আওতায় আসেনি, যে কারণে চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তনও হয়নি। যেগাযোগ, স্বাস্থ্য ,শিক্ষাসহ সব দিক থেকেই রয়েছেন পিছিয়ে।

স্বাধীনতার পর থেকে জেলার চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অনেক এনজিও কাজ করছে। সরকারিভাবেও অনেক বরাদ্দ এসেছে। কিন্তু উন্নতি রয়েছে সেই তিমিরেই। চরের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া কন্যা সন্তানদের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে। বাল্য বিবাহ, অপুষ্টিসহ নান করণে প্রতিবন্দী মানুষ বেড়েই চলছে। বর্তমানে জেলায় ৯১ হাজার ৬৭২জন প্রতিবন্ধী রয়েছে। দরিদ্র্য সূচকে দেশের সবোর্চ্চ অবস্থান এই জেলার। কুড়িগ্রামসহ চরের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের বিকল্প নেই। পাহারীদের জন্য যদি আলাদা মন্ত্রণালয় থাকতে পারে। তাহলে দেশের পশ্চাৎপদ এই চরের জনগোষ্ঠীর জন্য কেন হবে না?

সূত্র আরো জানায়, কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে ভারতের প্রায় ১৪টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া আরোও দুটি আন্তঃসীমান্ত নদী এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি৭০ ভাগ পানি বহনকারী ব্রহ্মপুত্র নদও কুড়িগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে জেলাটি। নদী দিয়ে বেষ্টিত হওয়ায় প্রতি বছর প্রায় সবগুলো উপজেলা বছরে ৩-৪ বার বন্যায় আক্রান্ত হয়। এ বছর জেলার নদী তীরবর্তী ৪১ ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। দুর্যোগ কবলিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার জন। প্রতিবার বন্যায় যে পরিমাণ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তা প্রয়োজনের অত্যন্ত অপ্রতুল। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না থাকায় বন্যা সমস্যার কোন টেকসই সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। আরো আছে, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর উভয় তীর তীব্র ভাঙ্গন। এর ফলে উভয় তীরবর্তী এলাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এতে অনেক মানুষ ভূমিহীন ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি ও জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জেলার ৯টি উপজেলার প্রায় ২ হাজার পরিবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে। প্রতিবছর এমন ভাঙ্গন যেন চরবাসীর নিয়াতি। নদীভাঙ্গনের কারণে একটি তুলনামূলক স্বচ্ছল পরিবারও সহায় সম্বলহীন হয়ে অতি দরিদ্র হয়ে পড়ছে।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৬৬ শতাংশ। কুড়িগ্রামে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। অর্থাৎ  প্রায় ৭৮ শতাংশ। জেলায় বাল্যবিয়ের পেছনে পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থান অন্যতম দায়ী। দরিদদ্রতা,সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, নারীর সম্ভ্রমহানির ভীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষার সুযোগ না থাকাসহ নানা কারণে চরগুলোতে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। কুড়িগ্রাম জেলায় মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৯১ হাজার ৬৭২ জন, প্রতিবন্ধীতার হার ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধিতার হার ২ দশমিক ১৪ শতাংশ থেকে বেশি। অসচেতনতা, বাল্যবিবাহ গর্ভবর্তী মায়ের পুষ্টির অভাব, প্রসবকালীন জটিলতা, প্রসবকালীন সময়ে প্রত্যন্ত চরাঞ্চল হতে যথাসময়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন না হতে পারার কারণে অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে অনিরাপদ ডেলিভারি, দারিদ্রতা ও সামাজিক কুসংস্কার প্রতিবন্ধিতার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।

সংশি­ষ্টরা বলছেন, কুড়িগ্রাম জেলার ১ হাজার ২৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চরাঞ্চলে রয়েছে ১৬৯টি বিদ্যালয় রয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই বললেই চলে। অথচ চরাঞ্চলের মানুষের শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি চরে কমপক্ষে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকা অপরিহার্য। পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে সবচেয়ে বেশি শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার দুর্গম চরাঞ্চলগুলোয়। এ কারণে চর এলাকার ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হতে পারে না।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা জানান, চরের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে সরকার বদ্ধপরিকর। পৃথক চর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গঠনে গুরুত্ব নিয়ে ইতিমধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।