টাইমস নিউজ
শুরু হয়েছে চা উৎপাদনের মৌসুম। কিন্তু বৃষ্টি নেই। তীব্র দাবদাহ । প্রখর রোদে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা-বাগানের চা-গাছ বিবর্ণ হয়ে পাতা পুড়ে যাচ্ছে। নদ-নদী, ছড়া, জলাশয় ও লেক শুকিয়ে যাওয়ায় চাহিদামতো সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।
এভাবে রোদ পড়তে থাকলে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।
চা-চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃষ্টি না হওয়ায় নতুন কুঁড়ি আসছে না চা-গাছে। ফলে চায়ের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা আছে। তাপপ্রবাহের কারণে লাল মাকড়ের আক্রমণসহ নানা প্রকার পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। বেশিরভাগ চাষিই চা-বাগান নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে জানালেন চাষিরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশিরভাগ চা-বাগানে আসছে না নতুন কুঁড়ি। কোনও কোনও চা-বাগানের গাছ জ্বলে গেছে। অনেক গাছ শুকিয়ে গেছে। চাষিরা দিনরাত বাগানে পানি ছিটাচ্ছেন। তবু কাজ হচ্ছে না।
চাষিরা বলছেন, চা-বাগানে প্রতি বছর দুবার সার প্রয়োগ করতে হয়। এ ছাড়া খরার মৌসুমে ১৫ দিন পরপর পানি সেচ দিতে হয়। সেই সঙ্গে বছরে সর্বনিম্ন ছয়বার কীটনাশক ছিটাতে হয়। তবে পোকামাকড়ের আক্রমণ অনুযায়ী এটি কমবেশি হতে পারে। টাকার অভাবে চা-বাগানের পেছনে এই নিয়মিত বিনিয়োগ ও পরিচর্যা করতে না পারায় এবার চা-গাছে লাল মাকড়ের আক্রমণসহ নানা প্রকার পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। এর সঙ্গে টানা তাপপ্রবাহ যোগ হয়ে সমতলের চা-চাষিদের এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা।
চায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে সেচের পাশাপাশি প্রতি চারাগাছের মধ্যে মাটি গর্ত করে পচা গোবরের সঙ্গে কিছু টিএসপি মিশিয়ে আবার মাটিতে মিলিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চা-বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলায় ৯৩টি চা-বাগান রয়েছে। এর মধ্যে অনেক চায়ের টিলা শুকিয়ে গেছে। তাপদাহ আর অনাবৃষ্টির কারণে আসছে না নতুন কুঁড়ি। আসছে না নতুন পাতাও। খরায় নতুন সৃজিত চায়ের ৪০ শতাংশ চারাগাছ ও ১০ শতাংশ পুরাতন চায়ের গাছ পুড়ে গেছে। চা-বাগান কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু টিলায় নিয়মিত সেচ দিয়ে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না।
চা শ্রমিকরা জানিয়েছেন, অনাবৃষ্টির কারণে চা-বাগানের নতুন গজানো গাছের পাতা রোদে পুড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে পোকামাকড় ও ফড়িংয়ের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। শীত মৌসুমে বাগানগুলোর পুরাতন গাছ উপড়ে ফেলে সেখানে নতুন করে চারাগাছ লাগানো হয়। আগাছা ছেঁটে দেওয়া হয়। এরপর সেচ দেওয়া হয়।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) মাধবপুর চা-বাগানের ব্যবস্থাপক দিপন কুমার সিংহ বলেন, ‘এখন চা-পাতা তোলার মৌসুম। কিন্তু যে হারে পাতা চয়ন করার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। প্রখর রোদের কারণে গাছগুলো মারা যাচ্ছে। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে স্বাভাবিক হবে গাছগুলো। এছাড়া উপায় নেই।’
চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চা-গাছ রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েও পানির অভাবে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। এমনিতেই চা রফতানি আগের তুলনায় কমেছে। এরপর যদি উৎপাদন কম হয়, তাহলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে।’
বাংলাদেশ টি এস্টেট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান বলেন, ‘বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখন কোনও উৎপাদন নেই বললেই চলে। তবে দু-একটি বাগানে পাতা চয়ন শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি অনুকূল নয়। বর্তমানে প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদনে খরচ হয় ২২০ টাকা আর বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। কেজিতে ৪০ টাকা ঘাটতি দিয়ে চা-শিল্প কতদিন টিকে থাকবে, তা ভাবনার বিষয়।’
ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) পাত্রখোলা চা-বাগানের ব্যবস্থাপক আকতার হোসেন বলেন, ‘বৃষ্টি ও সহনীয় তাপমাত্রা চা উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি। বৃষ্টি না হওয়ায় আমরা কৃত্রিমভাবে পানির ব্যবস্থা করে চা-গাছে ছিটাচ্ছি। কিন্তু সব জায়গায় ইরিগেশন করা সম্ভব হচ্ছে না। চা-গাছের জন্য বৃষ্টি খুবই প্রয়োজন।’
চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, ‘চায়ের জন্য ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আদর্শ। তবে সর্বোচ্চ ২৯ ডিগ্রি পর্যন্ত চা গাছ সহ্য করতে পারে। এর ওপরে গেলেই খরায় পুড়ে যাবে। পানির সংকট দেখা দিতেই নতুন কুঁড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাগানে যথেষ্ট পরিমাণ ছায়া প্রদানকারী গাছ থাকলে ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহনীয় থাকে। জেলায় এখন তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি আবার কখনও তা বেড়ে ৩৬ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করছে। মূলত এজন্য গাছ পুড়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে নতুন কুঁড়ি আসছে না চা গাছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার মৌসুমের প্রথম দিক থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে না। এই বৃষ্টি চা-গাছের জন্য খুবই উপকারী ছিল। বৃষ্টি না হওয়ায় ছাঁটাই করা গাছগুলোতে নতুন পাতা আসছে না। বড় বাগানে সেচ, টিউবওয়েল আছে। কিন্তু ছোট বাগানে এই ব্যবস্থা নেই। এখন বৃষ্টি না এলে বাগানের ক্ষতির শঙ্কা বেশি।’
ন্যাশনাল টি কোম্পানির পরিচালক ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. মহসিন মিয়া মধু বলেন, ‘চায়ের উৎপাদন খরচ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। যা বাগান মালিকদের জন্য অস্বস্তিকর। বৃষ্টি যদি না হয়, চা শিল্পের জন্য বিরাট ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে।’
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘এই সময়ে চা অঞ্চলে ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গত বছরের মার্চ মাসে ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। অথচ চলতি বছরের মার্চে এসে মাত্র ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুধু তাই নয়, গেলো পাঁচ মাসে এই অঞ্চলে কোনও বৃষ্টিপাত হয়নি। জেলার সবকটি চা বাগান খরার কবলে পড়েছে।’
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2025 RED TIMES. All rights reserved.