আলমগীর শাহরিয়ার
ইরানের শিরাজ শহরে জন্ম নেওয়া মহাকবি হাফিজের আসল নাম ছিল শামসুদ্দীন মোহাম্মদ। তিনি কোরআনের হাফেজ ছিলেন বলে তার আসল নামটি ঢাকা পড়ে যায়। হাফিজ নামেই জগতবাসী তাঁকে এখন চেনে। ইরানের মানুষ, পৃথিবীর কাব্যানুরাগী মানুষ— ভালোবেসে তাকে ডাকে বুলবুল-ই-শিরাজ।
শিরাজ শহর প্রতি বছর পৃথিবীর লাখো মানুষের কাছে তীর্থভূমি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হাফিজের গভীর অনুরাগী ছিলেন। তাদের পারিবারিক লাইব্রেরি সমৃদ্ধ ছিল হাফিজের রচনায়। তাদের পারিবারিক সাহিত্য আলোচনায়ও অবশ্যপাঠ্য ছিল হাফিজের রচনা। একবার নাতনী সরলা দেবীর কণ্ঠে হাফিজের গজল শুনে মুগ্ধ হয়ে এক হাজার টাকার সোনার গয়না উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ সালে তাঁর জীবনের শেষ কোনো বিদেশ সফরে বের হন। ইরাকের পূর্বে ইরানে রাষ্ট্রীয় সফরে যান এবং শিরাজ শহরে এক রাজকীয় সংবর্ধনা লাভ করেন। উপস্থিত সুধী সমাজের উদ্দেশ্যে সেখানে বলতে ভুলেননি, “বঙ্গাধিপতি সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ কবি বুলবুল-ই-শিরাজ মহাকবি হাফিজকে বাংলায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তিনি যেতে পারেননি। তবে সাড়া দিয়ে কবিতা রচনা করে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আজম শাহের বাংলা মুলক থেকে আজ আমি এসেছি।” বাংলায় সুলতানী শাসনামলের ইলিয়াস শাহী রাজবংশের তৃতীয় সুলতানের সমাধি আজও সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত। সেই সোনারগাঁওয়ে আরেকজন কবি জন্মেছিলেন তাঁর নাম গোলাম মওলা শাহজাদা। হাসান হাফিজ লেখকনামে আড়াল হয়ে গেছে তাঁর আসল নাম। হাসান হাফিজসহ বাংলা সাহিত্যে আরও দুজন হাফিজ রয়েছেন।
তাদের একজন হাসান হাফিজুর রহমান। যিনি আমাদের গৌরবের এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের দলিল সম্পাদনার জন্য ইতিহাসে খ্যাতনামা। আরেকজন সদ্যপ্রয়াত কবি হেলাল হাফিজ। স্বাধীনতার পটভূমি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়”— ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের একটি কবিতা, “যে জলে আগুন জ্বলে” একটি কাব্যগ্রন্থ যাকে ইতিহাসে অমরত্ব দিয়েছে, কিংবদন্তি করে রেখেছে।
যাকে ঘিরে আজকের আলোচনা সেই হাসান হাফিজ (জাতীয় প্রেস ক্লাবের বর্তমান সভাপতি) এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক। হাসান হাফিজ ভাইয়ের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "এখন যৌবন যার"। হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রভাবিত হয়ে এমন নামকরণ কিনা ঠিক জানা নেই। তবে এই দুজনকেই নামের মিলের জন্য অনেকে ভাবতেন সহোদর। দুজনের জীবনের একটা বড় অন্তরঙ্গ সময় কেটেছে জাতীয় প্রেসক্লাবে। যেন প্রেসক্লাবই তাদের ঘরবসতি। হাসান হাফিজের মুক্তিযুদ্ধ, রম্যরচনা এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়েও তাঁর অনেক উল্লেখযোগ্য লেখা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিয়েও তাঁর সম্পাদিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে।
হাসান হাফিজ ভাই আমাকে একবার চমকে দিয়েছিলেন। ইত্তেফাকের “অনন্যা” ম্যাগাজিনে আমার একটি রোমান্টিক কবিতা প্রকাশ পায়। “বানের জলে ভাসলে গাঙ”— শিরোনামের কবিতাটি তাঁর সম্পাদিত "১০০ কবির প্রেমের কবিতা" স্থান দেন। সেখানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমানের মতো দিকপাল, সাহিত্যের প্রাচীন বটবৃক্ষের সঙ্গে আছেন সমকালীন সব জনপ্রিয় অগ্রজ কবি।
হাসান হাফিজ ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বইটি হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, আপনার “বানের জলে ভাসলে গাঙ" কবিতাটি প্রেমের এক সার্থক কবিতা। বাঙলা ভাষার শক্তি তার আঞ্চলিক ভাষার কুশলী প্রয়োগে। আপনি আপনার এই ছোট্ট কবিতায় তা সার্থকভাবে রূপায়ণ করেছেন। তাই একশো কবির প্রেমের কবিতায় আপনার কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত না করে পারলাম না। হাসান ভাই আপনার এই অযাচিত, অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার কাছে চিরঋণী। হাসান হাফিজ ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নিয়মিত আসতেন। সায়ীদ স্যার তাঁকে বিশেষ পছন্দ করতেন। নানা কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একবার বহুদিন আসেন না। দেখা নাই। তাকে লিখলাম ভাই অনেকদিন যে আপনাকে দেখছিনা। অগ্রজপ্রতীম হাসান ভাই আমাদের অকালপ্রয়াত কবি আবুল হাসানকে উদ্ধৃত করে জবাব দিলেন, "যতদূর থাকো ফের দেখা হবে/ কেননা মানুষ যদিও বিরহকামী/ কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।"
২০১৬ সালে হাসান হাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের "আলোর ইশকুল"-এ সদস্য বাছাইয়ে একটি ইন্টারভিউ বোর্ডে বসেছি। হাসান ভাই প্রশ্ন করছেন সাহিত্য সম্পর্কিত নানা বিষয়াদি। আমিও উপস্থিত সদস্যকে একটা প্রশ্ন করলাম। আমরা সকলেই জানি ফারসি সাহিত্যের হাফিজ জগৎ বিখ্যাত। বাংলা সাহিত্যেও দুইজন হাফিজ আছেন? তাদের কাউকে চেনেন কিনা? ইন্টারভিউ বোর্ডে আকস্মিক এমন প্রশ্নের জন্য উপস্থিত সদস্য যেন মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। আমি এই অপ্রস্তুত নীরবতা কাটাতে দ্রুত মুচকি হেসে বললাম, একজন হাফিজ আজকে আপনার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন।
আলমগীর শাহরিয়ার ॥ বার্মিংহাম, ইংল্যান্ড
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2024 RED TIMES. All rights reserved.