আজ বৃহস্পতিবার, ১৬ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২রা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমার কবিতা

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৫, ২০২৫, ০৬:০৩ অপরাহ্ণ
আমার কবিতা

Sharing is caring!

 

মজিদ মাহমুদ

এই কবিতাগুলোই আমি। আমার সময়। আমার দেশ ও মহাকাল। আমার মায়ের মৃত্যু ও পিতার অনুশাসন। প্রথম কন্যার জন্ম ও অসুস্থ সন্তানের শিয়রে বসে থাকা। কৈশোর পেরোবার কালে কোনো এক মানবী ডেকেছিল দ্ব্যর্থ ইশারায়।

এগুলো অবলম্বন করে জেগে আছে সোমপুর বিহারের সিদ্ধাচর্যগণ, গৌরাঙ্গকে ঘিরে বৈষ্ণব পদকর্তাগণ, রোসাং রাজদরবারের পুঁথি হাতে বাঙালি কবিগণ, সেন-দরবারে জয়দেব-বোধায়ন, রেড়ির প্রদীপ জ্বেলে মনসার ভাসান রচয়িতা বিজয়গুপ্ত। এই কবিতাগুলো মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে না-আসা সন্তানের অপেক্ষায় থাকা মা, নুহের প্লাবনে ডুবে যাওয়া কেনান, ক্রুশবিদ্ধ যিশু, তীক্ষ্ন ছুরির নিচে হাজেরার পুত্র, পিতার অনুগত কাসাবিয়ানকা, যুদ্ধে পরাস্ত সৈনিক, প্রমত্ত দামোদরে সন্তরণরত ঈশ্বর শর্মা।
এই কবিতাগুলো সেজদারত অসংখ্য ফেরেশতার মাঝে একাকী আদম; ইন্দ্রের সভায় নৃত্যরত বেহুলা, মৃতের জগত থেকে ফিরে না আসা গিলগামেস, ছয়দিনে জগত নির্মাণ। এই কবিতাগুলো শিকার যুগ থেকে কৃষিযুগ, পলিলিথিক থেকে নিওলিথিক, ককেশাসের পর্বতশৃঙ্গে বন্দি প্রমিথিউস, বরফের নিচে চাপাপড়া খনিশ্রমিক। এই কবিতাগুলো পুত্রহন্তা একিলিসের কাছে প্রার্থনারত প্রায়াম, থেয়ানেস পর্বতে লেয়াসের পুত্র, নিয়তিতাড়িত জোকাস্টা। এই কবিগুলো ভলতেয়ারের কাদিদ, গেটের ফাউস্ট, শেক্সপিয়রের হ্যামলেট। এই কবিগুলো আধুনিক কবিতা থেকে বাদপড়া শব্দ ও ক্রিয়াপদসমূহ। এই কবিতাগুলো ক্ষত-বিক্ষত অর্ফিউসের শরীর থেকে জন্ম নেয়া নাইটিঙ্গেল।
এই কবিতাগুলো সেই সব মানব- যারা আলতামিরার গুহায় নিজেদের শিকারের অভিজ্ঞতা এঁকেছিলেন, চেয়েছিলেন মহিষ-দেবতার কৃপা, খাবার আনতে গিয়ে যারা নিজেরাই হয়েছিলেন খাবার। এই কবিতাগুলো দুগ্ধপানরত সিংহশাবক, গৌতমের গৃহত্যাগ, পায়েসের ভাণ্ড হাতে সুজাতা, ব্যাঘ্রের থাবা থেকে পলায়নরত মৃগশিশু। এই কবিতাগুলো অন্ধ হোমারের গান, অন্ধ মিল্টনের স্বর্গচ্যুতি, পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া ঈশপ, ঊষরপ্রান্তর থেকে রেলিং ভেঙে পড়ে-যাওয়া এলিয়ট। এই কবিতাগুলো রত্নাকর মুনির আশ্রমে কুশ ও লবের কণ্ঠে উপেক্ষিত সীতা, পাশার মঞ্চে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, মহারণ কুরুক্ষেত্র।
এই কবিতাগুলো বিক্রমাদিত্যের রজসভায় কালীদাস, মালবিকার সন্ধানে মেঘদূত, গুরুগৃহে কচ ও দেবযানির মাল্যবদল। এই কবিতাগুলো হিরোসিমা-নাগাসাকির জ্বলন্ত আগুনে গলে-পড়া মানুষের শরীর, আউৎসভিসের গ্যসচুল্লিতে ইহুদি নিধন, বুকে বোমাবাঁধা ফিলিস্তিনি বালক, ইন্ডিয়ানার তামাক ক্ষেতে যক্ষ্মায় ধুঁকেমরা আরব ক্রীতদাস। এই কবিতাগুলো আসিরিয়-ব্যবিলনিয় মৃৎপাত্রের নিদর্শন, এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার রাজনৈতিক প্রণয়, হারানো যোশেপের কেনানে ফিরে আসা, লেবুর বদলে ললনাদের আঙুল কেটে ফেলা। এই কবিতাগুলো বুশ ও লাদেন, চেঙ্গিস ও তৈমুর, শাদা ও কালোর যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য প্রাণ।
এই কবিতাগগুলো লেখা হয়েছিল ভূর্জপত্রে, পশুর চামড়ায়, পোর্চমেন্ট ও প্যপিরাস স্ক্রৌলে। এই কবিতাগুলো শীতের পাখিরা পশ্চিম থেকে পুবে বয়ে নিয়ে আসে, ডিমে তা দেয়ার সময়, অঙ্কুরোদ্গমের সময় তাদের মায়েরা এই কবিতাগুলো আবৃত্তি করে বাচ্চাদের পৃথিবীর পথে আহ্বানের জন্য। এই কবিতাগুলো অহিংস চরকা, সহিংস মেঘনদ, প্রশান্তির গীতবিতান, অশান্তির অগ্নিবীণা, ধূসর-পাণ্ডুলিপি। এই কবিতাগুলো কমিউনিস্ট মেনিফোস্টো, শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম আকাঙ্ক্ষা, উদ্বৃত্ত মুনাফার বণ্টন।
এই কবিতাগুলো লেখা হচ্ছিল মাতৃগর্ভ থেকে, পিতার ঔরস থেকে, যখন একজন পুরুষ ও নারী ভাগাভাগি করে আমাকে বহন করছিল। এই কবিতাগুলো লেখা হচ্ছিল পিতার পিতাদের জন্মের আগে, মাইটোসিস মেয়োসিস বিভাজনের আগে, মুরগি ও ডিম আলাদা হওয়ার আগে, ভাষা নির্মাণের আগে, এমনকি-সমুদ্রের শেওলা ও পানি নির্মাণের আগে। এই কবিতাগুলো লেখা হচ্ছিল-যখন সমগ্র সৌরজগৎ সূর্যের চুল্লিতে রান্না হচ্ছিল, যখন সকল ছায়াপথ ও গ্যালাক্সিমণ্ডলী, ব্ল্যাকহোল ও নক্ষত্র-নিচয় ঈশ্বর কণার সঙ্গে ছিল।
এই কবিতাগুলো লেখা হচ্ছিল-যখন মায়ের প্লাসেন্টোর অন্ধকার গর্ভ থেকে দাইমারা ধরাধরি করে আমাকে বের করে আনছিল, আবার কিছুদিন পর ধরাধরি করে কবরে শুইয়ে দিচ্ছিল। এই কবিতাগুলো আমাদের ভূতজীবনের কাহিনি; হাড় থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন করার কাহিনি, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জীবনের কাহিনি; প্রবল জোছনায় পদ্মপুকুরে নৃত্যরত জলপরীদের অব্যক্ত কান্নার গান।
এই কবিতাগুলো বর্ণ ও শব্দ-প্রতীকে লেখা হয়েছে, দুটি শব্দের মাঝখানে খালি জায়গায় লেখা হয়েছে, একটি অক্ষরের পেটের ভেতর লেখা হয়েছে, শব্দ ও বাক্যের অর্থ আলাদা করে লেখা হয়েছে। এই কবিতাগুলো প্রকৃতপক্ষে এখনো লেখা হয়নি, যারা এখনো এগুলো পড়েনি কিংবা কখনো পড়বে না-তাদের হৃদয়ে যে কবিতার জন্ম হচ্ছে, এগুলো তারই প্রাকপ্রস্তুতি। এই কবিতাগুলো হারিয়ে গিয়েছিল মানবজন্মের প্রাক্কালে, জীব ও জড় বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে, দ্বিপদী ও চতুষ্পদী আলাদা হওয়ার আগে, সরীসৃপ ও মেরুদণ্ডীর গোলযোগপূর্ণ সময়ে। পৃথিবীর সকল মানুষের দুঃখ এই কবিতাগুলোর মধ্যে নীরবে কাঁদতে থাকে, লুকিয়ে থাকে মরণশীল মানুষের অমরতার মন্ত্র।
এই কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল সপ্ত-আকাশের উপরে, এই কবিতাগুলো পতিত হয়েছিল সহস্র পাতালের নিচে, এই কবিতাগুলো ধূলোয় লুটোপুটি খাচ্ছিল নেংটো শিশুদের হাতে, এই কবিতাগুলো নিজেই লিখিত হয়েছিল, এই কবিতাগুলো সবাই মিলে রচনা করেছিল। এই কবিতাগুলো কেউ শুরু করে নাই, এই কবিতাগুলো কেউ শেষ করতে পারবে না। এই কবিতাগুলো ছাড়াই এই কবিতাগুলো পাঠ করা যাবে, যা লেখা হয়েছে সেগুলোও এই কবিতার অংশ, যা লেখা হবে সেগুলোও, এমনকি-যা লেখা হয় নি, সেগুলোও এই কবিতার অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
এই কবিতাগুলো কোনো মরণশীল পড়তে পারবে না, এই কবিতাগুলো দ্বিতীয় মৃত্যুর অধীনস্তরা পড়তে পারবে না; এই কবিতাগুলো চিতায় দাহ করার আগে, সমুদ্রে বিমানধসের আগে, মৃতদের আত্মা মহাকাশে উত্থিত হওয়ার আগে, গ্যাংরেপে হারিয়ে যাওয়ার আগে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আগে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগে, প্রেম-প্রবঞ্চার আগে-স্বয়ং ধ্বনিত হয়ে উঠবে।

মজিদ মাহমুদ ঃ কবি