Sharing is caring!

এইচ বি রিতা
‘মাই বার্থ’ চিত্রকর্মটি আঁকা হয়েছিল ১৯৩২ সালে। সে সময় দিয়েগো রিভেরা, ফ্রিদার প্রিয় স্বামী তাঁকে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো চিত্রিত করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন, এটি তার ই একটি সৃষ্টিকর্ম। চিত্রটি নিয়ে ফ্রিদা মন্তব্য করেছিলেন, ‘যেভাবে আমি জন্মেছিলাম বলে ভাবতাম।’
ফ্রিদা তাঁর ডায়রিতেও লিখেছিলেন যে, এই চিত্রটি তার নিজের জন্ম দেওয়ার মুহূর্তের চিত্রকল্প।
চিত্রকর্মটি অত্যন্ত গ্রাফিক। চিত্রকর্মে, ফ্রিদার মাথা বড় আকারের যা সাধারণত নবযাতক শিশুর মাথার আকারের চাইতে কিছুটা বড়। জরায়ু দিয়ে মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসছে সে। জরায়ু ও মাথার নিচে বিছানায় রক্ত ছড়িয়ে আছে। মায়ের মুখ একটি চাদর দিয়ে ঢাকা। জন্মের বিছানার উপরে একটি ছবি ঝুলছে। যদিও এই চিত্রকর্মটি “এক্স-ভোটো রেটাব্লো” (ex-voto retablo) শৈলীতে আঁকা হয়েছিল, তবুও নিচের স্ক্রলটিতে কোনো লেখা নেই। হয়তো ফ্রিদা অনুভব করেছিলেন যে, একেক মায়ের জন্মদানের অভিজ্ঞতা একেক রকম, গর্ভধারণের কোনো একটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার অনুভূতিগুলো যথাযথভাবে বর্ণনা করতে পারবেন না। কারো কারো ধারণা এই চিত্রকর্মটি সম্ভবত সিক্সটিন্থ শতকের আজটেক দেবী ত্লাজোলতেয়ল্ট (Tlazolteotl)-এর একটি ভাস্কর্য থেকে প্রভাবিত হয়েছিল, যেখানে দেবী ত্লাজোলতেয়ল্ট একজন পুরুষ যোদ্ধাকে জন্ম দিচ্ছেন।
এই চিত্রটিকে আরও বাস্তবসম্মত করে তোলে শিশুর জন্মের পরে মা-এর চারপাশে রক্তাক্ত বিছানাপত্র, যা হয়তো একটি ট্রমাটিক জন্মের ইঙ্গিত দেয়। এই ধারণাটি আরও জোরালো হয় যখন আমরা দেখি, মা জন্মের দৃশ্য দেখছেন না, কারণ তার মুখ একটি চাদর দিয়ে ঢাকা এবং তিনি ঘটনাটি থেকে প্রায় দূরে সরে যাচ্ছেন।
১৯৩২ সালে ফ্রিদা যখন এই চিত্রকর্মটি আঁকেন, তখন সেটি ছিল তার জীবনের এক গভীর বেদনাময় সময়। ওই বছর তিনি ডেট্রয়েট, মিশিগানে একটি মুরাল প্রকল্পে কাজ করছিলেন এবং সে সময় তার গর্ভপাত হয়। এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তিনি তার চিত্রকর্ম “Henry Ford Hospital”-এ চিত্রিত করেছিলেন, যা গর্ভপাতের মানসিক আঘাত এবং যন্ত্রণাকে তুলে ধরে। একই বছর, ১৫ সেপ্টেম্বর, ফ্রিদার মা ম্যাটিল্ডে ক্যালডেরন ডে কাহলো স্তন ক্যান্সার ও পিত্তরসের পাথরের জটিলতায় মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর ফ্রিদা চরম মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই চিত্রকর্মে ফ্রিদা তাঁর অনুভূতি এবং আবেগকে একটি রহস্যময়ভাবে শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন। যেহেতু ফ্রিদার মা এ সময় মারা যান এবং ফ্রিদার চিত্রকর্মের নাম ‘মাই বার্থ’, সেই সাথে মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা মাথাটি ফ্রিদার, তাই এটি তাঁর ই জন্মের অনুভূতি বলা যায়। বিছানায় রক্তপাত তাঁর মায়ের জন্মদানের চিত্র, যেখানে একটি সন্তান মায়ের জরাযু দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় প্রাকৃতিকভাবে ঘটে। আর চাদরে মায়ের মুখ ঢাকা-হতে পারে তার সদ্য মৃত মায়ের প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। মূলত ‘মাই বার্থ’ চিত্রকর্মটিকে এভাবেই অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন।
তবে এটি অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যা করা যায়-যেহেতু জন্মদাত্রী মা তার সন্তান জন্মের সময় চাদরে মুখ ঢেকে রেখেছেন, সে অর্থে বলা যায়, ফ্রিদা এখানে নিজেকে কেন্দ্রে রেখে নিজের গর্ভপাতের প্রতীকী চিত্র ব্যবহার করেছেন– চাদরে মুখ ঢাকা নারী ফ্রিদা নিজেই যিন গর্ভপাত এবং সেই সময়কার মানসিক যন্ত্রণাকে অনুভব করেছেন।
অর্থাৎ এই চিত্রকর্মে ফ্রিদা নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তার নিজের জন্ম ও গর্ভপাতের বাস্তব মুহূর্ত-দুটোই ধারণ করেছেন। চিত্রকর্মটি প্রচলিত উপস্থাপনার সীমানাকে চ্যালেঞ্জ করে। এমন একটি যুগে যেখানে নারীরা শিল্পে জড়িত থাকলেও তাদের কথা কম শোনা যেত, তখন ফ্রিদা সাহসীভাবে নিজেকে আত্ম প্রতিকৃতিতে জন্মের দৃশ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন। এই পদক্ষেপ, সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলো চ্যালেঞ্জ করে নারীদের কাহিনির শক্তিকে শিল্পে প্রতিষ্ঠিত করতে যথষ্ট ছিল।
তবে এই চিত্রকর্মটির বিশেষত্ব হল শিল্পীর সাহসী সিদ্ধান্ত যে নিজেকে সন্তানের জন্মের কঠিন মুহূর্তে উপস্থাপন করেছেন। চিত্রে আমরা একটি জরায়ু খোলার দৃশ্য দেখতে পাই, যা নারীত্ব এবং মাতৃত্বের মূল সত্তার প্রতি একটি প্রতীকী সন্মান। ফ্রিদা, যিনি সবসময় অগ্রগামী ছিলেন, ঐতিহ্যবাহী ক্যানভাস ত্যাগ করে ধাতুতে আঁকার সিদ্ধান্ত নেন যা প্রচলিত ক্যানভাসের পরিবর্তে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে – এবং
এই অপ্রচলিত সিদ্ধান্ত চিত্রকর্মের আবেগ ও শারীরিক দিকগুলির ওপর অতিরিক্ত গভীরতা যোগ করেছে।
‘মাই বার্থ’ চিত্রকর্মটি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হলে, আমাদের ফ্রিদার কল্পনার জটিলতায় প্রবেশ করতে হবে। চিত্রকর্মটি শুধু একটি মুহূর্তের চিত্র নয়; এটি জন্ম, জীবন এবং মৃত্যুর গভীর রহস্যের একটি ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধান। ছবির সুরিয়্যাল উপাদানগুলো আমাদের দৈনন্দিন জগতের সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, আমাদের প্রশ্ন করতে, চিন্তা করতে এবং অস্তিত্বের স্পন্দন অনুভব করতে প্ররোচিত করে। যখন আমরা চিত্রটি দেখি, তখন ফ্রিদার নিজের জন্মের ভালনেরেভিলিটি-তে তাকে স্থাপন করার সাহসিকতা একটি বিবৃতি হয়ে ওঠে – যানজীবন, শিল্প এবং শিল্পীর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ঘোষণা দেয়। ফ্রিদা যেন আমাদেরকে সৃষ্টির কাঁচা সৌন্দর্য দেখানোর জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, যা সময় এবং সামাজিক প্রত্যাশার সীমানা অতিক্রম করে।
চিত্রকর্মের মধ্যে শোকের অনুভূতি আরও গভীর হয় একটি চিত্রের মাধ্যমে, যা প্রসবের বিছানার ওপরে ঝুলছে। এটি হল ‘ভার্জিন অফ সরোজ( Virgin of Sorrows)’-এর প্রতিকৃতি, যেখানে মাতা মেরি দৃশ্যটি দেখছেন কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। তিনি সাহায্য করতে বা সান্ত্বনার কোনো শব্দ বলতেও অক্ষম।
‘মাই বার্থ’ চিত্রকর্মটি শিল্প সমালোচকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। অনেকেই এটি পছন্দ করেননি।
তবে ফ্রিদার এই চিত্রকর্মটি পপস্টার ম্যাডোনা সংগ্রহ করেছিলেন এবং এটি তার জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নির্বাচন করার মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ভ্যানিটি ফেয়ার-এর একটি সাক্ষাৎকারে ম্যাডোনা বলেছিলেন, ‘যদি কেউ এই চিত্রকর্মটি পছন্দ না করে, তবে আমি জানি তারা আমার বন্ধু হতে পারে না।’
১৪ ইঞ্চি চওড়া এবং ১২ ইঞ্চি লম্বা এই চিত্রকর্মটি ম্যাডোনার শিল্প সংগ্রহে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ফ্রিদা কাহলোর কর্মজীবন সম্পর্কে ম্যাডোনা অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন এবং তাদের উভয়ের সমাজে নারীদের ভূমিকা তুলে ধরার প্রচেষ্টার প্রতি একটি সংযোগ অনুভব করেছিলেন। ম্যাডোনা, ফ্রিদার আরও কয়েকটি চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেন এবং মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য সেগুলো ধার দেন।
তবে, এই ধরনের মূল্যবান শিল্পকর্ম ধার দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ বীমা প্রয়োজন, তা অনেক গ্যালারির পক্ষে মেটানো কঠিন। যুক্তরাজ্যে কাহলোর কর্মজীবন নিয়ে একটি বড় প্রদর্শনীতে এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল, যেখানে টেট গ্যালারির মতো প্রতিষ্ঠান চিত্রকর্ম ধার করেছিল। তারা পূর্বেও লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো এবং ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের মতো শিল্পীদের মূল্যবান শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছে।
ফ্রিদা কাহলোর শিল্প তার ব্যক্তিগত জীবন, মানসিক যন্ত্রণা, শারীরিক সংগ্রাম এবং সমাজের প্রতি সাহসী অবস্থানের গভীর প্রতিচ্ছবি। ‘মাই বার্থ’ চিত্রকর্মটি তার শিল্পীসত্তার একটি শক্তিশালী উদাহরণ, যা জন্ম, মৃত্যু এবং জীবনের গভীর রহস্যকে আবেগ ও বাস্তবতার মিশেলে তুলে ধরেছে।
ফ্রিদা ছিলেন একজন বিপ্লবী শিল্পী, যিনি নারীত্বের প্রতীক হয়ে ওঠেছিলেন।
তাঁর শিল্প আমাদের দেখায় যে যন্ত্রণা এবং শোককেও শিল্পে রূপান্তর করা যায়। তাঁর কাজ শুধু একটি সময় বা ঘটনাকে চিত্রিত করেনি; তাঁর কাজ নারীদের কণ্ঠস্বর, যারা সমাজের বাঁধাধরা ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার সাহস করেছিল।
ফ্রিদার চিত্রকর্ম আমাদের অস্তিত্বের গভীরতায় ডুবিয়ে দেয়, আমাদের ভাবায় এবং চ্যালেঞ্জ জানায়। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে শিল্প শুধু একটি ক্যানভাসে তুলির আঁচড় নয়, এটি শিল্পীর নিজস্ব সত্তার এক অনন্য ভাষা। তাঁর চিত্রকর্মে জীবনের জটিলতা, মানব অভিজ্ঞতার গভীরতা এবং নিজের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
ফ্রিদা কাহলোর শিল্প একাধারে ব্যক্তিগত এবং সার্বজনীন, যা মানুষকে যুগ যুগ ধরে আকর্ষণ করে চলেছে। তিনি যেমন নিজ যন্ত্রণাকে শিল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন, তেমনই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে জীবন ও শিল্পের মধ্যে এক গভীর সংযোগ স্থাপন করতে হয়। ফ্রিদা কাহলো শুধুমাত্র একজন শিল্পী নন, তিনি একজন সাহসী নারী প্রতীক, যার শিল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যন্ত্রণা, শোক, এবং আবেগের গভীরতা থেকেই নতুন সৃষ্টির জন্ম হয়।