আজ রবিবার, ৯ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রথী: মাটি ও মানুষের গান গাওয়া মৌলভীবাজারের এক নাগরিক বাউল

editor
প্রকাশিত মার্চ ৮, ২০২৫, ০৫:১৩ অপরাহ্ণ
রথী: মাটি ও মানুষের গান গাওয়া মৌলভীবাজারের এক নাগরিক বাউল

Sharing is caring!

 

সুনীল শৈশব

মানুষ জন্মগতভাবে বাউল। আমাদের সবার ভেতরই এক বাউল সত্তা বাস করে। কেউ সেই সত্তাকে আগলে রাখি, কেউ মেরে ফেলি, আবার কেউবা সমাজের নিয়ম, ধর্মের শৃঙ্খল কিংবা আধুনিকতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখি। কিন্তু রথী সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি নাগরিক ব্যস্ততার মাঝেও নিজের বাউল সত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

মৌলভীবাজার জেলা সদর—সবুজ পাহাড়, চা বাগান আর নদীর সুরেলা কলতানের এক আবাসভূমি। এখানেই বেড়ে উঠেছেন রথী, একজন নাগরিক বাউল। তবে ‘নাগরিক’ শব্দটি তাকে ঠিক সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। কারণ, রথীর অস্তিত্বে মিশে আছে লোকসংগীতের বুনন, মাটির গন্ধ আর সহজ-সরল জীবনের রঙ।

রথীর গান শহরের ইট-কাঠের দেয়ালে বন্দী নয়, তার কণ্ঠস্বর মিশে যায় গ্রামীণ হাটে, নদীর ঘাটে, মেঠোপথের ধুলায়। তার সুরে ধরা পড়ে জীবনের সহজ-সুন্দর দর্শন, যাপিত জীবনের দুঃখ-বেদনা আর আত্মার মুক্তির আকুতি।

রথী মৌলভীবাজার জেলা সদরের একজন খাঁটি বাউল গায়ক। শহরের ইট-পাথরের পরিবেশে থেকেও তিনি মাটি ও মানুষের গান করেন। তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে লালনের বাণী, শাহ আব্দুল করিমের ভাব, আর জীবনের গভীর দর্শন। তিনি গেয়ে চলেন জীবনের কথা, প্রেমের কথা, দেহতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতা আর সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গান।

শিকড়ের টান: বাউল রথীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা

মৌলভীবাজারের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম রথীর। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার এক অপার ভালোবাসা। পাড়ার মেলায়, হাটে-বাজারে, গ্রাম্য জলসায় বাউলদের গান শুনে তার কিশোর মন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠত। তখন থেকেই মনে স্বপ্ন—একদিন সেও গাইবে, সুরে সুর মিলিয়ে বলবে মাটি ও মানুষের কথা।

বাউল গান তার রক্তের ভেতরে মিশে গেলেও, জীবন বাস্তবতার টানাপোড়েনে তাকে পা রাখতে হয়েছে সমাজের নিয়মতান্ত্রিক পথে। সংসার জীবনের ভার কাঁধে নিয়েও তিনি নিজের সুরকে হারিয়ে যেতে দেননি।

সংসার ও সুরের সহাবস্থান

রথী শুধুমাত্র এক জন শিল্পী নন, তিনি একজন স্বামী, একজন বাবা, একজন কর্মজীবী মানুষ। জীবিকার জন্য তাকে নানান কাজ করতে হয়, কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই তিনি ফিরে যান তার প্রকৃত জগতে—সুরের রাজ্যে। হাতে তুলে নেন দোতারা, কণ্ঠে বয়ে যায় তার আত্মার গান।

রথী প্রমাণ করে দিয়েছেন, বাউল হওয়া মানে সংসার-বিমুখ হওয়া নয়। বরং প্রকৃত বাউলরা সংসারের মাঝেই প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান পান, জীবন দর্শনকে উপলব্ধি করেন এবং মানুষের কথা গান করে যান। তিনি যেমন তার পরিবারকে আগলে রেখেছেন, তেমনি গানকেও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরে রেখেছেন।

বাউল গান: শুধু সুর নয়, দর্শনও

রথীর গানের মূল ভাবনা লালন ফকির, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা প্রভৃতির বাউল দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত।

তিনি বলেন,
“বাউল গান শুধুই সুর নয়, এটা মানুষের জীবনচর্চা, আত্মার খোরাক। মানুষ এই জগতে আসে, কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে চলে যায়। কিন্তু কেউ যদি সত্যিকারের আত্মাকে খুঁজে না পায়, তাহলে সে বুঝতেই পারবে না জীবনের মানে কী।”

রথীর গায়কীতে দেহতত্ত্বের গভীরতা পাওয়া যায়, যেখানে দেহ ও আত্মা নিয়ে ভাবনার কথা উঠে আসে। সমাজের রীতিনীতির ভেদাভেদ দূর করে মানবতার জয়গান তার গানে প্রতিধ্বনিত হয়।

সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রতিবাদ

বাউল গান কেবল আধ্যাত্মিকতা আর প্রেমের কথা বলে না, এটা এক শক্তিশালী প্রতিবাদের ভাষাও। রথীর কণ্ঠে সমাজের অন্যায়, শোষণ, বৈষম্য উঠে আসে বাউল সুরের মোড়কে।

তিনি গেয়ে ওঠেন—

“ধনী-গরিব সবই তুমি করলা ভাগ-বাটোয়ারা,
এই ভেদাভেদ রাখবা কত, বলো ওহে সংসারী!”

তার গানের মধ্যে থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ, যা মাটি ও মানুষের মনের কথা বলে।

বাউল সত্তার মুখোশমুক্ত প্রকাশ

অনেকেই আধুনিকতার নামে নিজের শেকড়কে ভুলে যান, আবার কেউ কেউ ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে বাউল গানের চর্চাকে দমিয়ে রাখেন। কিন্তু রথী এই দুই পথের কোনোটিতেই হাঁটেননি। তিনি বিশ্বাস করেন, বাউল হওয়া মানে ধর্মের বাইরে যাওয়া নয়, বরং নিজেকে চেনা, নিজের আত্মার সাথে পরিচিত হওয়া।

তার মতে,
“বাউল গান মানে স্রেফ গান গাওয়া না। এটা এক জীবনধারা, যেখানে তুমি নিজেকে চিনতে পারবে, তোমার ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে পাবে।”

একজন নাগরিক বাউল

শহরে থেকেও রথী যেন মাটির গন্ধ ভুলতে পারেন না। তার কণ্ঠে যখন বাউল গান বাজে, তখন মনে হয়—শহরের কোলাহল থেমে গেছে, আর সময় পেছনে ফিরে গেছে সেই চিরন্তন বাংলার বটতলার মেলায়, যেখানে একদল মানুষ দোতারার সুরে একসাথে গেয়ে উঠেছিল মানুষের কথা।

তিনি প্রমাণ করেছেন, বাউল হওয়ার জন্য আপনাকে নির্জন কোনো গ্রামে থাকতে হবে না, নির্দিষ্ট কোনো পোশাক পরতে হবে না। বরং বাউল হওয়া মানে নিজের আত্মাকে চিনতে পারা, মুক্তির পথে হাঁটা।

 

উপসংহারে রথি

রথী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, মানুষ জন্মগতভাবে বাউল। শুধু কেউ কেউ সেই সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখেন, আর কেউ মেরে ফেলেন। রথী বাঁচিয়ে রেখেছেন, বড় যত্নে, ভালোবাসায়। তার গান, তার জীবন, তার দর্শন আমাদের শেখায়—প্রকৃত অর্থে বাউল হওয়া মানে সত্যিকারের স্বাধীন হওয়া।

রথী শুধু একজন বাউল গায়ক নন, তিনি এক দর্শনের ধারক। তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে জীবনের গভীর উপলব্ধি, সমাজের নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ, প্রেমের গভীরতা এবং আত্মার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

রথী বলেন,
,
“মানুষের জন্য গান গাও, সত্যের পথে থাকো, আর কখনো নিজের আত্মার বাউল সত্তাকে মেরে ফেলো না।”

সত্যিই, রথীর মতো মানুষেরা প্রমাণ করে দেন—আমরা সবাই জন্মগতভাবে বাউল, শুধু কেউ সেই সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখি, আর কেউ হারিয়ে ফেলি সময়ের স্রোতে।