শামীমা সুলতানা
পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রে নেতা প্রয়োজন। নেতা প্রয়োজন বিভিন্ন পেশাগত মানুষের গোষ্ঠীতে। এই নেতা নির্বাচন করা হয় সকলের মতামতের ভিত্তিতে। একটি গোষ্ঠীকে একটি মৌলিক আদর্শে বেঁধে নিয়ে এক বৃত্তে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নেতা প্রয়োজন। অনেক সময় ঝুঁকি নিতে হয় গোষ্ঠীকে। সেই ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় নেতার উপরে ভরসা করে। সেজন্য একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে নেতা খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। নেতার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি পরিবারে। কারণ পরিবার হলো প্রাথমিক এবং মৌলিক সামাজিক সংগঠন।
এখনকার নিউক্লিয়ার পরিবার নয়, এক প্রজন্ম আগের যৌথ পরিবার কাঠামোর দিকে তাকালে পরিবারে নেতার ভূমিকা চোখে পড়ে স্পষ্টরূপে। অনেকগুলো সন্তানের একটি পরিবারে পিতা সাধারণত বড় সন্তানকে, সুনির্দিষ্ট করে বললে বড় ছেলেকে গঠন করায় মনোযোগী হতেন। আশা এবং বিশ্বাস করতেন, তার এই বড় ছেলে হাল ধরবে ভাইবোনের। এই প্রবণতা খুব সাধারণ ছিল পরিবার এবং পিতামাতার ভিতরে। আর সেই বড় ছেলে রূপী পরিবারের নেতা মুখপাত্র হতেন সেই পরিবারের। অনেকগুলো ভাইবোনের ভিতরে বিভিন্ন মত এবং পথের ভিন্নতা লাঘব করে সবার চলার জন্য একটি সাধারণ পথ নির্মাণ করতেন তিনি এবং তার এই নেতৃত্ব গুণের শক্তিতে এগিয়ে যেত পুরো পরিবার। নেতৃত্বের প্রয়োজন হয় কোথায়? যেখানে অনেকগুলো ভাবনা এক জায়গায় মাথা ঘামায়, সেখানে প্রয়োজন হয় সিদ্ধান্তের। অনেকগুলো ভাবনা জড়ো হয় কোথায়? যেখানে অর্থনৈতিক লাভক্ষতির বিষয় থাকে অথবা পরিবার বিপদে পড়ার ঝুঁকি থাকে সেখানে ভাবনা এবং দুর্ভাবনা সক্রিয় হয়। অর্থাৎ টিকে থাকার স্বার্থ, শর্ত এবং ঝুঁকি কে মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্নমুখী ভাবনাকে নিরসন করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় একজন পথনির্দেশক, একজন নেতা। এই নেতা পরিবারের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি যদি ব্যক্তি থেকে শক্তিতে পরিণত হতে পারেন তাহলে সেই পরিবার টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে।
এখন প্রশ্ন হলো, নেতা কে এবং নেতার বৈশিষ্ট্য কী? প্লেটোর 'রিপাবলিক' গ্রন্থে নেতার স্বরূপ বর্ণনা করে বলা হয়েছে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা নেতা হবেন। নেতাকে মান্য করা যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি কনিষ্ঠদের স্নেহ পাওয়ার অধিকার থাকবে অবস্থানগতভাবে। অর্থাৎ শ্রদ্ধা এবং স্নেহ দুটো ধারাই হতে হবে কার্যকর এবং প্রশ্নাতীত। সেজন্য যদি কোনো পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই অকার্যকর হয়, সেই পরিবার নেতৃত্বশূন্য হওয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি।
এখন প্রশ্ন, নেতা তথা বড়ভাই 'কার্যকর' হয় কীভাবে? সহজ এবং অনাড়ম্বর উত্তর হলো, পরিবারের নেতাকে হতে হবে ব্যক্তিগত লোভ এবং লাভের চিন্তার ঊর্ধ্বে। পরিবারের পিতামাতা এবং ছোট ভাইবোন অন্ধ না, তারা বাস্তবতা বর্জিত নয়। সম্ভব এবং অসম্ভবের বিচারবোধ তাদের আছে। তাদের আস্থা থাকতে হবে ভাইয়ের প্রতি যে তিনি যা করবেন সেটা করবেন সবার জন্য। এই বিশ্বাস অর্জন করতে হয় সারা জীবনের কর্মরূপী যোগসাধনা দিয়ে। অর্থাৎ, জন্ম থেকে যে ভাইকে তারা পেয়েছে, তাকে তারা পেয়েছে বিপদে, আপদে, ভালোবাসায়, শাসনে, ক্রন্দনে, ত্যাগে, এবং দায়িত্বে। ভাই বাইরের পৃথিবীতে তাদের পক্ষে লড়াই করে ঘরে ফিরিয়ে এনে কশে একটা চড় দিয়েছে, লেখাপড়ায় কেমন করছে এবং কোনো সমস্যা হলে তার নিরসন করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাই বাড়ি ফিরলে তাকে পাশে নিয়ে বসে ভাত খাওয়ার সময় মাছের পেটি, মুরগির রান তার পাতে তুলে দিচ্ছে। পিতাকে দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ বহন করবে অথবা সঙ্গতি না থাকলে পিতার পাঠানো টাকা অপ্রতুল হলে নিজের সাধ্যমতো আর্থিক দায়িত্ব নিজে বহন করবে। বড় ভাইয়ের আর্থিক দায়িত্ব পালন করা তাকে মেনে নেবার পরীক্ষার অংশ। অর্থাৎ, তার উপরে ছোট ভাইবোন বিশ্বাস করবে তখন, যখন সে আর্থিকভাবে সাহায্য করবে, অথবা করার চেষ্টা করবে, যে চেষ্টায় আন্তরিকতা থাকবে অভিনয় নয়। অভিনয় অথবা সত্যনিষ্ঠা কীভাবে বোঝা যাবে, এই প্রশ্ন অবান্তর। পরিবার চিরকাল বুঝে নিয়েছে নির্ভুলভাবে। নেতার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বোঝানোর প্রয়োজন পড়েনি কোনোদিনই।
সবকিছু চোখে দেখে-ই পরিবার পরিজন বুঝতে পারে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কোনটা বাণিজ্যচেষ্টা, কোনটা দায়, কোনটা অপারগতা, কোনটা শঠতা, আর কোনটা প্রতারণা। নিশ্চিত থাকেন- আপনি যা করবেন, পরিবার সেটাই দেখবে। আপনি শঠতা করে অপারগতা প্রমাণ করতে পারবেন না, ধূর্ততাকে ঢাকতে পারবেন না নির্বুদ্ধিতা দিয়ে। আবার যা অসম্ভব চেষ্টা আপনার অবস্থান থেকে, সেটা বুঝে নেবে ভাই বোন এবং ভ্রাতুষ্পুত্ররা। মোট কথা, বাক্য ব্যয় করে যদি প্রমাণ করা লাগে, তাহলে পারার থেকে দূরে আছে নেতা। হ্যাঁ, যেখানে পরিবার সন্দিহান, সেখানে নিজ থেকে তিনি বলবেন, প্রশ্ন গ্রহণ করবেন সহজভাবে। উত্তর দেবেন সত্য, সহজ এবং বস্তুনিষ্ঠ। মনে রাখবেন, মানুষ আত্মসমর্পণ করতে চায়, মানুষ চায় পরিচালিত হতে। যোগ্য পরিচালক পেলে পরিবার বর্তে যায়। দশ দিকে দশজন ছুটতে চায় না। কিন্তু জ্যেষ্ঠর পারঙ্গমতা থাকতে হবে একটি বৃত্তে সবাইকে বাধার।
আত্মত্যাগ, ভালোবাসা আর সত্যের সাহচর্য ছাড়া পাওয়া যায়না পরিবারের সমর্থন এবং সমর্পণ। আপনার সিদ্ধান্তে সবাই পা বাড়াবে, আপনাকে সমর্থন দেবে কৈফিয়তহীন, আপনার ভুলকে আত্মস্থ করবে সবাই, আপনার হাতে তুলে দেবে নিজের সন্তান অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর জন্য, আপনি বিক্রি করবেন মাঠের জমি, আপনি তৈরি করবেন নতুন ভবন, মার্কেট এবং বসতবাড়ি, আপনি বন্ধক দেবেন পিতার গোডাউন, আপনি হেরে যাবেন নির্বাচনে, অর্থ লোকসান হবে, ভুল হবে, নষ্ট হবে ফসল, দখল দেবে ভিটের একপাশে চাচাতো ভাই, কিছু সমস্যা সমাধান হবে, কিছু থাকবে সমাধানহীন, কোনো ব্যাপার না; কিন্তু পরিবার একটা মানুষ চায় বিশ্বাস করার। একটা ডাকের কণ্ঠস্বর, যে তাদের সাহসী করে, যার উপস্থিতি শান্তি দেয়, শান্ত করে। পরিবারের 'নেতা' কোনো লাভজনক পেশা নয়, নেতা হতে হয় সত্য এবং ভালোবাসার নিষ্ঠায়।
৮ ডিসেম্বর ২০২৪।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2025 RED TIMES. All rights reserved.