Sharing is caring!
আলমগীর শাহরিয়ার
হুমায়ূন আহমেদ তখন বাংলা একাডেমির পুরস্কার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। পুরস্কারের জন্য নাম সুপারিশের এখতিয়ার তাঁর আছে। হুমায়ূন আহমদ তাঁর প্রথম যৌবনের ভাবগুরু ছফার কাছে গিয়ে বলছেন ছফা ভাই এবার একাডেমির পুরস্কারের জন্য আপনার নামটা প্রস্তাব করতে চাই।
এমন প্রস্তাব শুনে ছফা নাকি মারাত্মকভাবে ক্ষেপেছিলেন যে অকুস্থল থেকে হুমায়ূন আহমেদ পালিয়ে বাঁচেন। ছফা হুমকি দিয়েছিলেন এমন প্রস্তাব করলে হুমায়ূন যেন ভুলেও ছফার চতুর্সীমানায় কোনোদিন না ঘেঁষেন। ছফা এসব প্রতিষ্ঠান ও পুরস্কারের ধার ধারতেন না। নিজেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধি ভাবতেন এবং নিজেকেই প্রতিষ্ঠান ভাবতেন (himself an institution) । সেই খ্যাপা-আগুনের উত্তাপের ছোঁয়ায় বাংলা একাডেমিকে “খচ্চর প্রতিষ্ঠান” বলেছিলেন সলিমুল্লাহ খান?
ক্যাম্পাসে কোনো এক ছফা স্মরণসভায় গিয়ে সলিমুল্লাহ খানকে প্রথম দেখি। সম্ভবত কলাভবন-সংলগ্ন আরসি মজুমদার মিলনায়তনে। একনিষ্ঠ ছফা-শিষ্য হিসেবে ঢাকার সাহিত্য-সমালোচনা জগতে তিনি নিজেকে পরিচয় করান। তখন মিডিয়ার তাঁর এতো প্রচার ও প্রসার হয়নি।
একবার সলিমুল্লাহকে জাতীয় জাদুঘর থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আনতে গেছি “রেনেসাসঁ ও মেকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শন” নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলোর ইশকুলে একটা আলোচনা করতে। সেমিনার শেষ হতে দেরী হওয়ায় বললেন, আপনাকে পেরেশানিতে ফেলে দিলাম। উনি সবাইকে আপনি সম্বোধন করেন। গাড়িতে বসে শাহবাগ থেকে বাংলামোটর যাচ্ছি। সিরিয়াস আলোচনার ফাঁকে কথাচ্ছলে বেশ রসিকতাও করেন তিনি। নানা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। লেখালেখি একটা বড় প্রসঙ্গ ছিল। বললেন, আপনি তো ইদানিং মন্ত্রী হয়ে গেছেন। একটু চমকে বললাম কেমনে স্যার! বললেন আজকাল পত্রিকায় মিডিয়ায় আপনার নাম ধাম দেখি। শুনে একটু বিব্রত হলাম। অবশ্য আমাকে বিব্রত করা তার ব্রত ছিল না নিখাদ প্রশংসাই করেছিলেন। তাই বলে মন্ত্রী? কেন বলেছিলেন সেই প্রসঙ্গ বা স্মৃতিচারণ ভবিষ্যতে করবো। তারপর বললেন, স্যার (ছাত্রদের তিনি স্যার বলেও সম্বোধন করতেন) আপনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এগুলো ভালোবেসে করেন জানি। কিন্তু জীবন তো চালানো কঠিন। আমরাও যৌবনে ভালোবেসে এমন অনেক অবৈষয়িক শিল্প-সাহিত্যের সেবাধর্মী কাজ করেছি। যা হোক, সলিমুল্লাহ স্যার পরের বছর কেন্দ্রে ফরাসী দার্শনিক লাকা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
ইউল্যাবে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে উনার লাকা নিয়ে সেমিনার সিরিজে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান। তাঁর পাণ্ডিত্য নিয়ে সংশয় নাই। কিন্তু তাঁর পশ্চিমা এবং প্রাচ্যের রাজনৈতিক দর্শনের ব্লেডিং বেশ গোলমেলে বলে মনে হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে তার রাজনৈতিক দর্শনগত উল্লম্ফন ও অস্থিরতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে না পারার ক্ষোভ ও খেদ তার বক্তব্যে প্রায়ই টের পাওয়া যেত। বঞ্চিতের ক্ষোভ বড় বেপরোয়া হয়। গতকাল জনৈক মেট্রিক ফেইল বাইচান্স উপদেষ্টার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি দেখে অনেকে ষাটের দশকে আইয়ুবশাহী আমলে শওকত ওসমানের আলোচিত “ক্রীতদাসের হাসি” উপন্যাসটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। স্যার কি তাহলে বিপ্লবের স্পিরিট ভুলে দ্রুত বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলে অস্বস্তিতে পড়লেন? হ্যাঁ, অকপটে গণমাধ্যমে স্বীকার করেছেন পুরস্কার দিয়েই তো “বেইজ্জতিটা” করলো! অথচ দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও একনিষ্ঠ ছফা-শিষ্যের তো এসব পুরস্কারে এতো বিগলিত হবার কথা ছিল না। পুরস্কার তাঁকে কার পেছনে দাঁড় করিয়ে দিল সে কথাটাই শুধু ভাবছি।
— আলমগীর শাহরিয়ার ॥ ০২. ০২. ২০২৫