আজ বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৈশ্বিক রবীন্দ্রনাথ: ড. উইলিয়াম রাদিচের সাক্ষাতকার

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২১, ২০২৪, ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ
বৈশ্বিক রবীন্দ্রনাথ: ড. উইলিয়াম রাদিচের সাক্ষাতকার

Sharing is caring!

কামাল রাহমান

(ড. উইলিয়াম রাদিচে: উনিশশো একান্নয় জন্ম, লন্ডনে। দুটো ক্যারিয়ার গড়েছেন একসঙ্গে, একজন কবির, ও রবীন্দ্রনাথ তথা বাংলাভাষার একজন বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিতের! মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা তাঁর ত্রিশ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে কবিতাগ্রন্থ Strivings (1980), Louring Skies (1985), The Retreat (1994), এবং Green, Red, Gold: A Novel in 101 Sonnets (2003) উল্লেখযোগ্য। তাঁর নির্বাচিত ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা’ ও ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প’ অনুবাদ সঙ্কলন দুটি পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত হয়ে অনেকবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। জার্মান ভাষা থেকেও অনুবাদ করেন তিনি। ব্রিটেন, ভারত, বাংলাদেশ, উত্তর আমেরিকা, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ে অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন। বিশ্বভারতীতে ভিজিটিং প্রোফেসার হিসেবে কাজ করেছেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন রবীন্দ্র-বিশারদ। ১৯৮৭তে মাইকেল মধুসূদন দত্তের উপর থিসিস করে অক্সফোর্ড থেকে ডি. ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৮ থেকে ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)এ বাংলার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। গত বছর পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া প্রকাশ করেছে তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: Meghnadbodh Kabya রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এবছর বের হতে যাচ্ছে তাঁর ভূমিকা সহ গীতাঞ্জলির নতুন অনুবাদ। এছাড়াও প্রকাশিত হতে যাচ্ছে Particles, Jottings, Sparks: The collected Poems এবং Myths and Legends of India প্রভৃতি গ্রন্থ। ১৯৮৬তে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৭এ আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনারারি ডি.লিট এবং একই বছর বাংলা একাডেমি থেকে অনারারি ফেলোশিপ দেয়া হয় তাঁকে। ২০০৯এ কোলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট হতে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি লাভ করেন। বিবিসি ওয়ানের সকালের অনুষ্ঠান Pause of Thoughts সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন।
কামাল: সুদীর্ঘ তিন যুগ, কর্মজীবনের প্রায় সবটাই, রবীন্দ্র গবেষণা, আলোচনা ও উপস্থাপনায় রয়েছেন, এতটা সময় পেরিয়ে কেমন অনুভব করেন এখন, উইলিয়াম?
উইলিয়াম: ভালো, খুব ভালো।
কামাল: কোপেনহ্যাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, রবিঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি (১৯১৩) ও মহাপ্রয়াণ (১৯৪১) এর মধ্যবর্তী দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে বিশ্বের সেরা কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তিনি! কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ব্যাখ্যা করবেন, বিশেষ করে টি এস এলিয়ট ও মারিয়া রিলকের মতো বিশ্ববিখ্যাত কবিরাও যখন অভাবিত ঔজ্জ্বল্যে কবিতাবিশ্বে বিরাজ করছিলেন?
উইলিয়াম: আপনার লিখিত প্রশ্নগুলোয় সামান্য চোখ বুলাতে পেরেছি কামাল, কাজের ভীষণ চাপ। জানেনই তো মাইগ্রেণের যন্ত্রণায় কেমন ভুগছি। তার চেয়ে চলুন একটু সহজ কথা বলি, আমার যন্ত্রণার কিছুটা উপশম হবে।
কামাল: নিশ্চয়, যেমন ইচ্ছে করেন আপনি। প্রশ্নগুলো করা হয়েছে আপনার কাজের উপর ভিত্তি করেই। যাহোক, আপনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, কবিগুরুর সার্ধশত জন্মবার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে পালনের মাধ্যমে তাঁকে পুনরাবিষ্কারের সম্ভাবনা দেখা দেবে, অচলায়তন ভেঙ্গে নতুনভাবে, এমনকি আরো উজ্জ্বলভাবে দেখা দেবেন তিনি, এই আশাবাদের পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে?
উইলিয়াম: অসংখ্য… অনেক…
কামাল: এজন্য ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী বাঙালিদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে উলেখ করেছেন, সেটা কীভাবে?
উইলিয়াম: রবীন্দ্রনাথকে সময়োপযোগী করে উপস্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে যারা জন্মসূত্রে ইংরেজি ভাষাটা পেয়েছে, তাদের কাছে ভাষাটার মর্মমূল রয়েছে, বাংলা ভাষাটাও পারিবারিক সূত্রে পেয়েছে এরা, এদের অনুবাদ নির্ভরযোগ্য হবে, দুটো ভাষার সুবিধেই গ্রহণ করতে পারবে এরা।
কামাল: আপনার জানা-শোনা কেউ কি করছে এসব?
উইলিয়াম: অভিষেক মুখার্জি করছে, এশ মুখার্জি নামে সবাই চেনে ওকে, ওর জন্য বারোটা গান অনুবাদ করে দিয়েছি, উঁচুমানের কোরিওগ্রাফার সে, ভরতনাট্যমে ওর পারদর্শীতা, ব্যালেটাও ভালো আয়ত্বাধীন ওর।
কামাল: হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে একজন বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার। মাইকেল জ্যাকসনের আবহে করা তাঁর কাজগুলো অসাধারণ, খুব জনপ্রিয়। তিনি যদি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু করেন তাহলে খুব তো উৎসাহের কথা, ভালো কাজ হবে আশা করি।
উইলিয়াম: অরুণ ঘোষ করছে, বিবিসি ওয়ানে সন্ধ্যা ছটায় ওর একটা উপস্থাপনা আছে, দেখতে পারেন, মূলত সে ক্ল্যারিওনেটিস্ট, ভালো কম্পোজার। অনেকে করছে… এরকম অনেক কিছু, ওয়েবসাইটে সবই পাবেন।
কামাল: শান্তিনিকেতন ও বাংলাদেশের বাইরে, আন্তর্জাতিকভাবে কীভাবে রবীন্দ্র সার্ধশতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছেন, কিছুটা ধারণা দেবেন কি?
উইলিয়াম: সবই তো ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।
কামাল: কথা বলা যাক গীতাঞ্জলি নিয়ে, ওটার কতগুলো কবিতা অনুবাদ করেছেন? কবিগুরুর অনুবাদ ও আপনার অনুবাদ কীভাবে পৃথক? এর প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিয়েছে?
উইলিয়াম: এত কথা গীতাঞ্জলি নিয়ে! যে গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনায় ছিল, যা তিনি জাহাজে বসে সাজিয়েছিলেন, ওটা, আর নোবেল পুরস্কার এনে দেয়া গীতাঞ্জলি এক নয়, জানেন আপনারা। যে খাতাটিতে তিনি গীতাঞ্জলি সাজিয়েছিলেন, ওখানে আশিটা কবিতা ছিল, এবং স্পষ্টভাবে দাগ এঁকে ওটার সমাপ্তি টেনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পেছনে কিছু খালি পৃষ্ঠা থাকায় আরো তিনটি কবিতা ওখানে তুলেছিলেন, কিন্তু ওগুলো গীতাঞ্জলির নয়। আরো কুড়িটা কবিতা নিয়ে ইয়েটস-এর নির্বাচিত গীতাঞ্জলিতে কবিতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল একশো তেইশটি, ওটা একটা মিশ্র সঙ্কলন, বিভিন্ন ভাব ওখানে মিশে গেছে। রবীন্দ্রনাথের নেয়া আশিটি কবিতার ভেতর চমৎকার একটা সামঞ্জস্য ছিল, ওটা ছিল খুব সুচিন্তিত, পরিমিত ভাবের, অনন্যসাধারণ একটা সুনির্বাচন, কবিতাবিন্যাসে, একের পর এক সাজানোর মধ্যেও ছিল একটা উঁচুমানের সৃষ্টিশীলতা, একটা অভিনব, আধ্যাত্মিক জগতের উন্মোচন, ওটার কিছুই রাখা হয়নি ঐ অনুবাদে!
কামাল: তাহলে কি মূল গীতাঞ্জলির রূপটিকে ধরতে চাইছেন আপনি?
উইলিয়াম: হ্যাঁ, চাইছি। ঐ খাতাটি এখন বিশ্বভারতী বা শান্তিনিকেতনে নেই, হার্ভার্ডে আছে, রথেনস্টাইন সংগ্রহে, আপনারা জানেন রথেনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কোলকাতায়। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সে খাতাটি দেখার, এবং সেখান থেকে কাজ করার। মূল কাজটিকে কাটাছেড়া করে যা করা হয়েছে তা ঠিক হয়নি, আমার মনে হয়। ঐ খাতাটি থেকে টাইপ করা পাণ্ডুলিপিতে ইয়েটস কি করেছিলেন, তা বলার সুযোগও নেই, কারণ কাটাছেড়া ঐ পাণ্ডুলিপিটার আর অস্তিত্ব নেই এখন! আমি চেষ্টা করেছি রবীন্দ্রনাথের মূল সুরটিকে ধরতে, পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া থেকে যে অনুবাদটি বেরোবে ওটার ভূমিকায় অনেককিছু বলেছি। রবীন্দ্রনাথের মূল গীতাঞ্জলির আশিটি কবিতা, পরে সংযোজিত তেতাল্লিশটি কবিতা ছাড়াও তিনটি কবিতা নিয়েছি, তবে পৃথকভাবে, ওসবের ব্যাখ্যা করেছি আমি, আশা করি পাঠক বুঝতে পারবে।
কামাল: খুব আগ্রহ রইলো আপনার অনুবাদটির জন্য।
উইলিয়াম: ধন্যবাদ আপনাকে।
কামাল: রথেনস্টাইন ও ইয়েটসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সে-সময়ের বন্ধুত্বে তো মনে হয় কোনো খাঁদ ছিল না, গীতাঞ্জলির ভূমিকায় ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, বিশ্বসভায় তাঁর স্থান পাওয়ার জন্য ওটা নিঃসন্দেহে অনন্যসাধারণ হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে রথেনস্টাইনের প্রভাব রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ছিল। এখানে ফাঁকটা কোথায়?
উইলিয়াম: আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের নিয়ন্ত্রণটা তখন নিজের হাতে ছিল না, যতদূর বুঝতে পারি, তিনি অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, এছাড়া তাঁর করারও কিছু ছিল না। সোনার তরী কবিতাটি পড়–ন, ‘এতকাল নদীকূলে/ যাহা লয়ে ছিনু ভুলে/ সকলি দিলাম তুলে/ থরে বিথরে…’ তাঁর সকল ফসল অন্যের নায়ে তুলে দিতে হচ্ছে!
কামাল: তাঁর ঐ ফসল নেয়ার জন্য নাবিককে তো তিনিই আহ্বান করে এনেছেন! ‘ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে,/ বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।/ যেয়ো যেথা যেতে চাও,/ যারে খুশি তারে দাও,/ শুধু তুমি নিয়ে যাও, ক্ষণিক হেসে/ আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।’
উইলিয়াম: হ্যাঁ, কারণ তিনি অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সোনার ফসল নিয়ে একা বসে আছেন! ‘চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।’ ফসল তো তিনি নিজের জন্য ফলান নি, অন্যের নৌকোয় তুলে দেয়া ছাড়া আর কি করতে পারতেন, তাঁর তো কোনো নৌকো ছিল না।
কামাল: আপনার অনূদিত সোনার তরী কবিতাটি নিয়ে কথা বলা যায়, এটা আপনার সাম্প্রতিক অনুবাদ, এখানে লক্ষ্য করা যায় আপনার শুরুর দিকের অনুবাদ থেকে অনেকটা সরে এসেছেন, এমনকি কবিতাটির আঙ্গিকেও পরিবর্তন এনেছেন, তেতালিশ লাইনের কবিতাটিকে আপনি প্রতিটি পাঁচ লাইনের ছয় অনুচ্ছেদে ত্রিশ লাইনে অনুবাদ করেছেন, কি ভেবে এটা করতে হয়েছে? বাংলা সাহিত্যে রূপক কবিতার একটা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এ কবিতাটি, আপনার অনুবাদে এলিগরি কি সেভাবে এসেছে? এই সোনার তরী যে এক অর্থে জীবনতরী, এটা কি পাঠক বুঝতে পেরেছে?
উইলিয়াম: এটা তো মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই জীবনতরী . . .
কামাল: কবিতাটিতে ছন্দের যে চমৎকার প্রবহমানতা আছে, অনুবাদে কি সেটা ধরা গেছে? একজন পাঠক যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়বেন তাঁর চেতনায় একশো বছরের পুরোনো উচ্চাঙ্গের একটা সৌন্দর্য ধরতে চাইবেন, সাম্প্রতিক কবিতার কোনো বিষয়-আশয়, অলঙ্কার প্রভৃতি তিনি আশা করবেন না, ধরা যাক সারে চারশো বছর আগে লেখা রূপক পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস-এর কথা, এটা তো আজকের পাঠকও উপভোগ করতে পারছেন, নিচের লাইন ক’টা –
The hill, though high, I covet ascend;
The difficulty will not me offend;
For I perceive the away to life lies here:
Come, pluck my heart. let’s neither faint nor fear,
Better, though difficult, the right away to go,
Than wrong, though easy, where the end is owe.
আমার বাংলা কানেও এটা ছন্দের দোলা দেয়, এটার মাধুর্য্য এখনো প্রায় অক্ষুণœ রয়েছে মনে হয়, এটার হিল শব্দটি যে রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না, আপনার কি মনে হয় না রবীন্দ্রনাথের কবিতার যে ভাব, আধ্যাত্মিক গভীরতা তা পিলগ্রিমস প্রোগ্রেসের সমতলীয়?
উইলিয়াম: এসব কথা অনেকভাবে বলা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের তুলনা তো তিনি নিজেই, তাঁর কাজে জীবন ও শিল্প, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা, প্রকৃতি ও বিজ্ঞান, এসবের অত্যন্ত গভীর সামঞ্জস্য রয়েছে। এটা এক অব্যাখ্যাত ক্ষমতা! এক কবির ভেতর এত বিভিন্নতা, বহুমুখীনতা, এত সংশ্লেষ, এত সৌকর্য কল্পনা করা যায় না!
কামাল: আপনার কি মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো কবিতাকে ধরার জন্য উচ্চাঙ্গের, আধুনিক, উত্তরাধুনিক, এরকম বিভিন্নভাবে একাধিক অনুবাদ হওয়া উচিত? দীর্ঘদিন ধরে এবিষয়ে গবেষণা করছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রাণের সুরটিকে ধরতে পেরেছেন, খাঁটি বাঙালি না হলে যা ধরতে পারা খুব কঠিন, এক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই ব্যতিক্রম, আমি জানি না, ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।’ এর মূল সুরটিকে কীভাবে অনুবাদে আনা সম্ভব! অনুবাদে ‘স্যাড’ শব্দটি এনেছেন, কবিতাটি দুঃখের নয়, কিছুটা বিষাদের, আবার চূড়ান্ত হতাশারও নয়, … নাহি ভরসা, অর্থাৎ আপনি রিলাই করতে পারছেন না, দুঃখ ও বিষাদের পার্থক্য ইংরেজিতে কীভাবে প্রকাশ করবেন জানি না, বাংলা কবিতাটি পড়ার পর আপনার ভেতরে যে বোধ কাজ করে, অনুবাদটি পড়ার পর, অনুবাদক নয়, পাঠক হিসেবে একই বোধ কি আপনার ভেতর কাজ করে?
উইলিয়াম: কনফিউজিং… গোলমেলে…
কামাল: বিষয়টাকে আরেকটা দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা যায়, যে দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর গীতাঞ্জলিকে দেখেছেন ইয়েটস, আজকের পাঠকের ওরকম দৃষ্টি থাকার প্রশ্ন নেই, সোনার তরী কবিতাটির ইয়েটসের সময়ের অনুবাদ, ধরে নেই ইয়েটসেরই অনুবাদ, আপনার কুড়ি বছর আগের অনুবাদ, ও সাম্প্রতিক কারো অনুবাদ, এভাবে কবিতাটি ভিন্ন ভাষ্য তৈরি করবে, কবিতাটির ভাবানুবাদ, অথবা পুননির্মাণ হতে পারে, মূলের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে, এই বিভিন্নতাগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, অথবা কীভাবে একটা সঙ্গতি রক্ষা করে কবিতাটির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে পাঠক, ভবিষ্যতের অনুবাদকের বিষয়টা ভাবনায় রেখে এটা আলোচনা করতে পারেন।
উইলিয়াম: অনুবাদের স্বচ্ছতা একটা প্রশ্ন…
কামাল: রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদ বিষয়ে আপনার টেগোর দ্য ওয়ার্ল্ড ওভার: ইংলিশ এজ দ্য ভেহিক্যাল লেখায় যথার্থই বলেছেন, কিছুটা বিবলিক্যাল স্টাইলে, ও ছন্দ থেকে মুক্ত থেকে তা করেছিলেন তিনি। মূল কবিতার বয়ন, আঙ্গিক, ছন্দ, অন্তর্সৌন্দর্য প্রায় কিছুই আসেনি ঐ অনুবাদে, ওটা পড়েই ইয়েটস বলেছিলেন তাঁর রক্তে নাচন ধরেছে, গীতাঞ্জলির অনুবাদগ্রন্থের ভূমিকায় এটার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, যা তাঁকে পাশ্চাত্য কবিতাভুবনে একটা উচ্চাসন এনে দেয়। ঐ অনুবাদের কোমল ভাব, মানবিক আবেদন, আধ্যাত্মিক গভীরতা, প্রভৃতি হয়তো ইয়েটসকে একটা নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিল। অন্যান্য ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর, কবিতাগুলো অনুবাদের সময় এটাকে অন্যান্য ভাষায় সহজ-অনুবাদযোগ্য করার বিষয়টা কি তাঁর ভাবনায় ছিল, যা আপনি উলেখ করেছেন?
উইলিয়াম: গীতাঞ্জলির ঐ অনুবাদটা ছিল পরিবর্তীত, অনেক ভুল ছিল ওখানে, এমনকি ব্যাকরণগত ভুলও ছিল। ভাব প্রকাশে ভুল কতটা এই কবিতায় দেখুনÑ ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা/ প্রভু তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।’ এখানে প্রশ্নবোধক চি‎হ è আসে কোথা থেকে!
কামাল: হ্যাঁ, অর্থটাই তো পাল্টে যায়, এখানে সমর্পণের আকুলতা, পূর্ণতা প্রকাশ পায়, ‘তোমার পানে’ অংশটা তিনবার ব্যবহার করেছেন, যেনো অন্য কারো কাছে অবশ্যই নয়, সেখানে প্রশ্নবোধক চি‎হ্ণ অবিশ্বাস অথবা সন্দেহ বোঝাতে পারে, সম্ভবত অনুবাদে ংযধষষ দিয়ে বাক্যটি শুরু হয়েছে বলে এটা হয়েছে।
উইলিয়াম: বিবলিক্যাল স্টাইলে সাধারণ বাক্যও ংযধষষ দিয়ে শুরু হতে পারে। ওটা নিঃসন্দেহে একটা বাজে ভুল ছিল, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় প্রকাশিত কোনো সঙ্কলনে এটার সংশোধন হয় নি, পরে অবশ্য সংশোধন করা হয়েছে। এরকম অসংখ্য ভুল ছিল, আমি চেষ্টা করেছি রবীন্দ্রনাথের নির্ভুল অনুবাদ করতে, দুএকটা ব্যকরণগত ভুল ছাড়া রবীন্দ্রনাথের মূল অনুবাদটির কোনো পরিবর্তন করি নি।
কামাল: রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর অনুবাদের জন্য পরে আক্ষেপ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শব্দ, ছন্দ, ভাষা সব বদলেও যদি তাঁর প্রকৃত ভাবটিকে ধরা যায়, তাহলে সেটাও হতে পারে অনূদিত ভাষার পাঠকের জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি, গীতাঞ্জলির যে অনুবাদ করেছেন, সেখানে মূল কবিতার ছন্দ ও সৌন্দর্য কীভাবে এনেছেন?
উইলিয়াম: গানের অনুবাদে ছন্দ রাখার চেষ্টা করি আমি।
কামাল: পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া থেকে করা আপনার গীতাঞ্জলি অনুবাদে কতগুলো কবিতা থাকছে? আপনি কি মনে করেন ওখান থেকে আবার অন্যান্য ভাষায় কবিতাগুলোর নতুন অনুবাদ বেরোবে? এটাও কি অন্য ভাষায় সহজে অনুবাদযোগ্য করে, না ইংরেজি কবিতার অনুরূপ ছন্দে অনুবাদ করেছেন?
উইলিয়াম: বলেছি, একশো ছাব্বিশটি।
কামাল: কণিকা, স্ফুলিঙ্গ ও উৎসর্গের অনেক কবিতা অনুবাদ করেছেন আপনি, উৎসর্গের পয়তালিশ সংখ্যক কবিতাটির বিষয়ে আসা যাকÑ
অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
এখানে মরণের অনুবাদ এসেছে ডেথ, রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত এশব্দটি কি ডেথের মতো এত কঠিন? এখানে মরণ বলতে কি মৃত্যুর মতো হিমশীতল কিছু বোঝায়? রবীন্দ্রনাথ মরণকে প্রকাশ করেছেন ‘শ্যাম সমান’ বলে, অর্থাৎ প্রেমাস্পদের মতো, এই মরণ চূড়ান্ত কোনো ভীতির নয়Ñ
আমি যাব যেথা তব তরী রয়
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
যে মৃত্যুকে ভয় পাই, এড়িয়ে চলি, সেটাকে মনে হয় এই মরণ শব্দটি প্রকাশ করে না, এশব্দটির উপর গুরুত্ব দিচ্ছি, কারণ এটা কবিতাটির কী ওয়ার্ড, চাবীশব্দ, এটার যথার্থ অনুবাদ সম্ভব কিনা জানি না, আপনার কি মনে হয়?
উইলিয়াম: রবীন্দ্রনাথের আরো অনুবাদ আমি আশা করি।
কামাল: বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ আউট অব ফ্যাশন হয়ে পড়েছেন, বাংলা সাহিত্যে কিন্তু না, এখনো রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য, তাঁর কবিতা বিপুলভাবে পঠিত, ফ্যাশন আউট অব ফ্যাশন হয়ে যায়, কিন্তু যে বস্তু দিয়ে ফ্যাশনটি তৈরি, সেটি যদি বাতিল না হয়ে যায়, তবে সেটিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা যায়, পুরোনো ফ্যাশনও আবার চক্রাকারে ঘুরে আসে, রবীন্দ্রনাথের কবিতার মূল বস্তু কখনোই বাতিল হওয়ার নয়, চিরন্তন মূল্য রয়েছে এর, তাঁর কবিতার অসাধারণ এই বস্তুসত্তাটিকে কীভাবে হাল ফ্যাশনে নিয়ে আসা যায়?
উইলিয়াম: প্রোফেশনালদের হাতে রবীন্দ্রনাথের যথাযোগ্য উপস্থাপন প্রয়োজন, যে-সব স্টেইজ পারফর্মেন্স এখানে হচ্ছে তা খুব হতাশার, হারমোনিয়াম বাজিয়ে অচর্চ্চিত গলায় রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয়, এটা ঠিক না, এ মাপের একজন শিল্পীর কাজ এত তুচ্ছভাবে উপস্থাপন কীভাবে সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ এই হারমোনিয়াম যন্ত্রটাকে পছন্দ করতেন না।
কামাল: নিজেদের ঘরোয়া আসরে এটা হয়তো সহ্য করা যেতে পারে, কিন্তু সম্প্রচারের জন্য এটা করা অন্যায়।
উইলিয়াম: ভাবুন তো উনিশশো বাইশ তেইশে জিমলিন্সকির মতো প্রতিভাবান শিল্পী রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে সিম্ফনি করেছিলেন, ওটা বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিল, জার্মানি সহ ইউরোপের সর্বত্র, এখন কি হচ্ছে?
কামাল: হ্যাঁ, উনিশশো একুশে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জার্মানি সফরের পর ওটা করেছিলেন আলেকজান্ডার জিমলিন্সকি। ওর লিরিক সিম্ফনিটা শুনেছি, অসাধারণ! অবশ্য, ওখানে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া আমার জন্য ছিল সত্যি কষ্টকর, এটা আমারই ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে। এমনকি, সিম্ফনিটা শোনার সময় রবীন্দ্রনাথের মালী কবিতাটা সামনে রেখে বুঝতে চেষ্টা করেছি। আসলে অর্কেস্ট্রা শোনার যোগ্য করে বিধাতা আমার কান সৃষ্টি করেন নি। আমি হয়তো কান পেতে থাকি রবীন্দ্রসংগীতের ঐ স্বর্গ-হতে-ভেসে-আসা সুরের জন্য, আমার কাছে এগুলো অপার্থিব মনে হয়!
উইলিয়াম: জিমলিন্সকির কাজের সঙ্গে গুস্তাভ মার্লেরও যোগাযোগ ছিল।
কামাল: তিনি তো সম্ভবত উনিশশো এগারোতে মারা যান।
উইলিয়াম: হ্যাঁ, মাত্র একান্ন বছর বয়সে, জিমলিন্সকির কাজ অন্য একটা মাত্রা পায় মার্লের সংশ্লিষ্টতার পর মার্লের একটা ঘরানা ছিল, পরবর্তীতে অনেকে ঐ ঘরানায় কাজ করে।
কামাল: আপনি একজন সঙ্গীতজ্ঞ, চমৎকার পিয়ানো বাজান, রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস অবলম্বনে আপনার নির্মাণে অপেরা লিব্রেতো বিপুল প্রশংসা পেয়েছে, পরম বীর সিং যেটা পারফর্ম করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য, কিংবা নৃত্যনাট্য নিয়ে আপনার কি কোনো পরিকল্পনা রয়েছে? রবীন্দ্রনাথের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর স্টেইজ পারফর্মেন্সগুলো কবিতা থেকে বেশি জোরালো হতে পারে মনে করেন কি?
উইলিয়াম: হ্যাঁ, পরম বীরের একটা ভালো কাজ ছিল ওটা। এছাড়া ম্যাথু প্রিচার্ড রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কাজ করছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে, বিশ্বভারতী থেকে একটা কোর্সও করে এসেছে সে। মুকুল আহমেদ কিছু কাজ করছেন। নাটক পরিচালনা করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশের অনেক মঞ্চায়ন হয়েছে, সম্ভবত টুয়েন্টি টুয়েল্ভ অলিম্পিকে তাসের দেশ দেখানো হতে পারে। ওটা একটা ভালো পারফর্মেন্স হবে আশা করা যায়।
কামাল: রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যগুলোর কি আধুনিকায়ন সম্ভব? কীভাবে হতে পারে এটা?
উইলিয়াম: রবীন্দ্রনাথের কাজগুলো এত উঁচুমানের, এগুলোর পারফর্মেন্সও তো উঁচুমানেরই হতে হবে, এগুলোকে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসতে হবে, অথেন্টিক পারফর্মেন্স না হলে হবে কি করে, প্রোফেশনালদের ছাড়া কি একাজটা সম্ভব!
কামাল: শেক্সপীয়ারের সাম্প্রতিক ভার্সন মঞ্চায়নগুলোকে কীভাবে দেখেন? শেক্সপীয়ার থিয়েটার থেকে তো এগুলো সরে এসেছে!
উইলিয়াম: এগুলোর পারফর্মেন্স গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডেই হচ্ছে, রিসাইক্লিং-এর বিষয়টা তো সব সময়ই রয়েছে।
কামাল: ফরগটেন বুকস থেকে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে, বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষীদের কাছে ভুলে যাওয়া এই কবিকে কতটা উদ্ধার করা সম্ভব? তাঁকে পুনরুদ্ধারের জন্য লন্ডনের টেগোর সেন্টারের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেবেন, আপনিও যেহেতু এটার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন?
উইলিয়াম: নেহেরু সেন্টার ওদের মতো করে অনুষ্ঠানাদি করছে, মে’র তিন তারিখে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রদর্শণী ও ছিন্নপত্রের উপর নির্মিত ফিল্ম দেখানো হবে, চার তারিখে দেখানো হবে নাটক, আমার অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর, দশ তারিখে রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ও বহুমুখী সৃষ্টিশীলতা নিয়ে সেমিনার আছে, ওখানে আমার আলোচনা উপস্থাপন আছে, মে মাস জুড়েই অনেক অনুষ্ঠানাদি, ওদের ওয়েবসাইটে দেখবেন। তারপর বারো ও তেরো তারিখে ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে আমার বক্তৃতা আছে, ওখানেও ডাকঘর মঞ্চস্থ হবে, আসবেন আশা করি।
কামাল: আশা করি। ভবিষ্যত কোনো পরিকল্পনা বিষয়ে বলবেন?
উইলিয়াম: এবছরই রিটায়ারমেন্টে যাচ্ছি, তখন হয়তো আরো কিছুটা সময় পাবো।
কামাল: পাবেন আশা করি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অনেক দিয়েছেন আপনি, এজন্য আপনার কাছে আমরা ঋণী, আপনার প্রতিও আমাদের আন্তরিক ভালোবাসা রয়েছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে উইলিয়াম, এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দিয়েছেন, অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাই।
উইলিয়াম: ধন্যবাদ আপনাকেও কামাল, ভালো থাকবেন, শুভরাত্রি।
কামাল: শুভরাত্রি, উইলিয়াম।