Sharing is caring!
সালেম সুলেরী
১৯৮৪-এর অক্টোবর-নভেম্বর ভালো যাচ্ছিলো না স্টালিনের। ঢাকার প্রণয়কন্যা যেন আজ আছে কাল নেই। মেয়ের বাবা-মা অন্য পাত্রের জন্যে অধিক আগ্রহী। একদিন ভীষণ মন মরা হয়ে অফিসে এলো। অফিস মানে দৈনিক জনতা, হাটখোলা রোড, ঢাকা। আমি তখন সহ-সম্পাদক কাম ফিচার ইন-চার্জ। ব্যাচেলর জীবন, বেতনের অর্ধেক টাকা বেঁচে যায়। স্টালিন তখনও শিক্ষার্থী, চাকরি-বাকরি হয়নি। যশোরের সতীর্থরাও তখনও ঢাকাবাসী হয়নি। ফলে, আমার কানে তুলে দিতো আনন্দ-বেদনার কথকতা।
প্রণয়কন্যার শেষ সংবাদটি আমি কোনদিন ভুলবো না। চোখের জল আটকে রেখে স্টালিন বললো, গুডবাই। মানে তার নায়িকা চূড়ান্তভাবে গুডবাই জানিয়েছে। অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়েছে, বাবা-মা অনঢ়। স্টালিনও তা মেনে নিয়েছে দেখে রাগ হলো। কিন্তু সে ফুঁসছে, তবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না। আমাকে প্রবোধ দিয়ে একটি সংবাদ মেলে ধরলো। বললো, তার বিদায়ী প্রেমিকার মনটা খুব উদার। বললো, দেখোনা, বিদায় বেলায় একহাজার টাকা দিলো। বলেছিলো, তোমার যা যা মনে আসে খেয়ে নিও।
এমন তথ্যে হাসবো না কাঁদবো, বুঝতে পারছিলাম না। স্টালিন বললো, চলো আজ একটু শীতল জলের স্পর্শ নেই। উল্লেখ্য, আমাদের দৌড় তখন শাহবাগের ‘সাকুরা’ পর্যন্ত। দ্রুত কাজ সেরে অফিস থেকে বেরুতে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি পত্রিকার চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শামস-উল-হুদা। স্টালিনকে দেখিয়ে বললেন– সে কি শাহনূর খানের ভাই। অভিনেতা সাজ্জাদ খানের হুবহু ডুব্লিকেট! উল্লেখ্য, সাজ্জাদ খান তখন বিটিভি’র আলোচিত নায়ক। আর স্টালিনের চেহারায় তারই রোমান্টিক প্রতিচ্ছাপ।
না, সেসব ‘আনকোড’ কথা-কাহিনী লেখেনি স্টালিন। তাঁর প্রিয় কবিতাটির পটভূমি ভিন্নতর। যা প্রথম প্রকাশ পায় ‘সাদাকালো’ ম্যাগাজিনে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ২০০১ সালে। ঢাকার সেই ম্যাগাজিনটির যুগপৎ সম্পাদক আমি।
স্টালিনের জন্মদিন একবার আমরাও পালন করেছিলাম। ‘অনিরুদ্ধ আশি’ সংগঠনের ব্যানারে, ২০০২ সালে। আমি ছিলাম আয়োজক-সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সভাপতি প্রয়াত কবি, মুক্তিযোদ্ধা ড. খোন্দকার আশরাফ হোসেন। সম্মানিত অতিথি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত দুই কবি। দু’জনই ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে’র কবি, কথিকা পাঠক। কবি-সম্পাদক আল মুজাহিদী ও কবি-বোহেমিয়ান নির্মলেন্দু গুণ।
স্টালিনসহ করোনাপূর্ব শেষ অনুষ্ঠান ঢাকায় ২০১৮-এর আগস্টে। ‘তিনবাংলা’ আয়োজিত ৮ স্মারক ব্যক্তিত্বের স্মৃতিতর্পণ। ঋদ্ধ কবি-লেখক-এ সমৃদ্ধ ছিলো আয়োজনটি। এমন অর্ধশত আয়োজনে একসাথে কথা বলেছি, কবিতা পড়েছি। বয়েসে আমি কিছুটা জ্যেষ্ঠ, তবে সম্পর্কটি গভীরতর। সেই ১৯৮৩-৮৪ থেকে আমরা ঢাকায় সেতুবন্ধে। সেসময় তাঁর হাতে থাকতো ‘পূর্ণ প্রাণ যাবো’। যশোরের তরুণতম ‘পন্চপান্ডবে’র পদাবলি-প্রকাশনা। স্টালিন-দারা-রব-তাপস-রানা’র যৌথ কাব্যগ্রন্থ। এরপর বেরুলো ‘ফিরিনি অবাধ্য আমি’, ‘আশ্চর্য আয়নাগুলি।’
সাহিত্যপ্রাণ স্টালিন আমার অবশ্যপাঠ্য কবিবন্ধু। সর্বশেষ সে তার ‘আবৃত্তির কবিতা’ বইটি উপহার দিয়েছে। লিখেছে >> প্রিয় কবি সালেম সুলেরী, তোমাকে দিলাম >> রে.স্টা.। আমার এক দীর্ঘ লেখায় স্টালিনের পংক্তি উদ্ধৃত করেছি। যতোদিন বাঁচি, যতো দূরেই থাকি স্টালিনকে পড়তে চাই। উল্লেখ্য হারানো প্রেমটি ফিরিয়ে এনেছিলো স্টালিন। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সে এক অদম্য-সৃষ্টিমুখ।
২২ নভেম্বর প্রিয়দিন জন্মদিনে সপ্রাণ শুভেচ্ছা। নিবেদিত হলো তাঁর প্রিয় কবিতাটি। সঙ্গে লেখাপূর্ব নেপথ্য গল্পটিও।
নিরপেক্ষতার প্রশ্নে’– যতোটা কবিতা, ততোধিক জীবনদর্শন ♦ রেজাউদ্দিন স্টালিন -আমার সাম্প্রতিককালের প্রিয় কবিতার শিরোনাম হচ্ছে ‘নিরপেক্ষতার প্রশ্নে’। এই কবিতার কাব্যগুণ সম্পর্কে আমার উচ্চাশা নেই। তবে বক্তব্য প্রবাহের অভিঘাত কবিতাটিকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ‘নিরপেক্ষ’ বলে যে ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান প্রচারণা চালায় আদতে তা’ মূল্যহীন বা ফাঁপা। কোনো না কোনো পক্ষাবলম্বন করতেই হয় অন্তত যদি সে জীবিত হয় কিংবা যদি তার হৃদয় থাকে। নিরপেক্ষ– অর্থাৎ যে শুধু একাই, ‘তার পরিপার্শ্ব বলে কিছু নেই’, তাপ-উত্তাপ বলে কিছু নেই, ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু বোঝার শক্তি নেই– তাহলে সে নিশ্চয়ই মৃতবৎ। মৃতবৎ এবং মৃত-এর মধ্যে শব্দগত পার্থক্য থাকলেও চেতনাগত পার্থক্য নেই। এ জন্যে ‘নিরপেক্ষতা’র বিরুদ্ধে সত্য-সুন্দর স্বপ্ন ও প্রত্যাশার পক্ষে এই কবিতাটিকে দাঁড় করাতে চেয়েছি। সব সময় রাজনীতি করলেই যে পক্ষাবলম্বন হয় তা কিন্তু নয়। যে ন্যায়ের পক্ষে, যে সত্য ও সুন্দরের কল্যাণের পক্ষে সে-ই প্রকৃত মানুষ, তার জন্যে এই কবিতা।
নিরপেক্ষতার প্রশ্নে ♦ রেজাউদ্দিন স্টালিন
যার আশা নেই সে কিছু হারায় না
যার স্বপ্ন নেই সে শুধু বর্তমানের
তার অতিত ও ভবিষ্যৎ নেই
যার মন আছে সে নিরপেক্ষ নয়
আকাশের আশা নিরপেক্ষ হবে
কিন্তু মেঘ তাকে আচ্ছন্ন রাখে
চাঁদ স্বপ্ন দ্যাখে নিরপেক্ষ আলোর
কিন্তু সূর্য তার আষ্টপৃষ্ঠে বাঁধা
নদী চায় নিরপেক্ষ প্রবাহের পথ
কিন্তু সমুদ্রের জলে তার বক্ষ বিবাহিত
পথ চায় নিরপক্ষে নিয়মে গন্তব্যে গমন
কিন্তু পথিকের পদশব্দে
পথ ভেঙে ভিন্ন দু’টি গ্রহ
যার আশা আছে সে কিছু হারায়
যার স্বপ্ন আছে তার কিছু ভাঙে
যার আশা নেই স্বপ্ন নেই
তার মন নেই
সে নিরপেক্ষ অথবা মৃত ♠ ঢাকা