Sharing is caring!

সুমন তুরহান
রাষ্ট্র-সরকার-দেশ-সংস্কৃতি-জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় – এই বিষয়গুলো বাঙালি মুসলমানের কাছে একেকটি বিশাল বড় ধাঁধা। আমাদের প্রপিতামহদের প্রজন্ম, যাঁরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছিলেন, স্বরাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা ছিলেন ‘ভারতীয়’। আমাদের পিতামহদের প্রজন্ম, যাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঐতিহাসিক ভুলটি করেছিলেন, তাঁরা একদিন জেগে উঠে দেখলেন যে তাঁরা হয়ে গেছেন ‘পাকিস্তানি’। একাত্তরে সেই ঐতিহাসিক ভুলকে সংশোধন করলেন আমাদের পিতাদের প্রজন্ম, সৃষ্টি করলেন বাংলাদেশ, এবং হয়ে গেলেন ‘বাংলাদেশি’। জাতি-রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণের এই আকস্মিকতার উদাহরণ আমাদের প্রায় সবার জীবনেই রয়েছে। আমার নিজের জন্ম মৌলভীবাজারে, যেটি সাতচল্লিশের সিলেট গণভোটে ভারতের অংশ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। সিদ্ধান্ত একটু এদিক-ওদিক হলেই আমার রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্ব ভিন্ন হতে পারত। জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা এমনই ভঙ্গুর। তিন প্রজন্মে আমরা তিনটি রাষ্ট্র দেখেছি, এবং নিশ্চিত হওয়ার কোনো কারণ নেই যে আমরা ইতিহাসের চূড়ান্ত সমাপ্তিতে পৌঁছে গেছি।
বাঙালি মুসলমানের ‘ভারতবিদ্বেষ’ নিয়ে একটি বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন; গবেষণাটি করা উচিত হবে কোনো গণমনোবৈকল্য গবেষকের, কারণ রোগটি রাজনৈতিক নয়, মানসিক এবং সম্ভবত আরোগ্যের অতীত। তবে বাঙালি মুসলমানের ভারতবিরোধিতা মূলত ‘হিন্দুবিরোধিতা’; এই সত্য যে আমরা স্বীকার করি না, এর কারণ হচ্ছে ‘কপটতা’ আমাদের চরিত্রের একটি বড় অংশ। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী যখন গুলি করে আমাদের কোনো কিশোরীকে হত্যা করে, তখন বাঙালি মুসলমান প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, এবং সেই প্রতিবাদ ন্যায্য। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যখন আমাদের ক্রীতদাসী কন্যারা নিয়মিত ধর্ষিত হয় এবং তাদের লাশ বাক্সবন্দী হয়ে ঢাকায় ফিরে আসে, তখন আমরা কাউকেই সৌদি আরবের পতাকা অপমান করতে দেখি না, কিংবা দূতাবাসের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখি না – কারণ দিনশেষে, তারা মুসলমান। মুসলমান ভাইয়েরা আমাদের মেয়েদের সঙ্গে অমন আচরণ করতেই পারে; পাকিস্তানি ভাইয়েরাও করেছিল একাত্তরে – সেগুলো আমরা মনে রাখিনি, যেমন ভুলে গেছি আরও অনেক কিছুই।
পাকিস্তানপর্বে ‘ভারতবিদ্বেষ’ রোগটির সাংস্কৃতিক নাম ছিল ‘তমদ্দুন’। তমদ্দুনবাদীদের মূল কাজ ছিল আমাদের সংস্কৃতি থেকে সকল ভারতীয় (তাদের ভাষায় ‘হিন্দুয়ানি’) অনুষঙ্গ ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। বাংলাদেশে এখন প্রচুর তমদ্দুনবাদী বুদ্ধিজীবী দেখা যাচ্ছে, যারা বাংলাদেশকে ‘সংশোধন’ করছে, নতুন করে ইতিহাস লিখছে এবং আমাদের সংস্কৃতিকেও সংশোধন করার চেষ্টা করবে। তবে, যে জিনিসটি তারা সংশোধন করতে পারবে না, সেটি হলো আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। এখনকার কথা বাদই দিলাম, যদি পুরাবংশগতিবিদ্যায় দক্ষ কোনো বিজ্ঞানী আজ থেকে ৫,০০০ বছর পরও একজন সিলেটবাসীর জিনগত উপাদান একজন বর্ধমানবাসীর সঙ্গে তুলনা করেন, তবে দেখা যাবে যে আমাদের দুজনের জিনই ভারতীয়। (আমার নিজের ডিএনএ বিশ্লেষণেও এটি স্পষ্ট হয়েছে। আমার জিনগত ইতিহাসের একটি অংশ দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, সুদূর অতীতে আমার পূর্বপুরুষদের কেউ দক্ষিণ ভারত থেকে এই বঙ্গ অঞ্চলে এসেছিলেন, যা আজকের বাংলাদেশ)। জিন সিলেট-বর্ধমান বোঝে না, সীমান্ত-কাঁটাতার বোঝে না, রাজনীতিও বোঝে না। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশের মানুষের জিনগত ভিত্তি ভারতের মানুষের সঙ্গে অভিন্ন।
আমাদের সংস্কৃতিও ‘ভারতীয়’; যাকে আমরা ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলি, সেটি বৃহত্তর ভারতীয় ঐতিহ্যেরই অংশ। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা ‘ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ আর ‘ভারত’ রাষ্ট্রকে আমরা এক করে দেখি – এটি এক রকমের “ক্যাটাগরি এরর“ – প্রকারবিভ্রম। ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন, বহুমাত্রিক, বহুজাতিক – এর বিস্তৃতি ‘ভারত’ রাষ্ট্রের সীমানার চেয়েও বড়ো। আমরা, আজ যারা বাংলাদেশে বাসিন্দা, শুধু ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশই নই, আমরা এই ঐতিহ্য গঠনে অবদানও রেখেছি। ভারতীয় ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করতে হলে, আমাদের সবার আগে বাদ দিতে হবে বাংলা ভাষা, কারণ ‘বাংলা’ সংস্কৃতের কন্যা (তমদ্দুনবাদীরা এটি বুঝেছিল, চক্রান্ত করেছিলো বাংলার বিরুদ্ধে, তবে বায়ান্নোর বিস্ফোরিত চেতনার কারণে সফল হতে পারেনি)। ভারতীয় ঐতিহ্যকে বাদ দিতে হলে আমাদের আরো কিছু কাজ করতে হবে। বাতিল করে দিতে হবে বুদ্ধ, ব্যাস, বাল্মীকি, পাণিনি, পতঞ্জলি, কালিদাসকে; বিস্মৃত হতে হবে চর্যাপদের রচয়িতাদের, ভুলে যেতে হবে নাগার্জুন-বসুবন্ধু-গৌড়পাদ-শঙ্কর-বিবেকানন্দের নাম, উপেক্ষা করতে হবে সুভাষ-সুরেন্দ্রনাথ-অরবিন্দকে, এমনকি বাদ দিতে হবে বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথকেও। রবীন্দ্রনাথকে অবশ্য আমরা আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছি, তবে আমাদের বাদ দিতে হবে নজরুলকেও। নির্বাক নজরুলকে এনে নাগরিকত্ব দিলেই তাঁর ‘ভারতীয়ত্ব’ মুছে যাবে না। তাঁর কাব্যে, সঙ্গীতে, বিদ্রোহে – সবখানেই ভারতীয়ত্ব উচ্চকিত স্বরে জানান দেয়।
এখন যদি আপনি ভারতীয় ঐতিহ্য মুছে ফেলতে চান, তবে সবার আগে বিদ্বেষে দগ্ধ হয়ে নিজেকে মুছে ফেলুন। কিন্তু ছাই হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় আর সাংস্কৃতিক শেকড় চিৎকার করে বলবে: আপনি বৃহত্তর ভারতীয় ঐতিহ্যের অংশ ছিলেন, আছেন, এবং থাকবেন।
সুমন তুরহানঃ লেখক, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী