আজ মঙ্গলবার, ২১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কবি সৌমিত্র দেব ও তাঁর কবিতায় উত্তর-আধুনিক বৃষ্টিপাত

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ১২:১২ অপরাহ্ণ
কবি সৌমিত্র দেব ও তাঁর কবিতায় উত্তর-আধুনিক বৃষ্টিপাত

Sharing is caring!

 

জায়েদ হোসাইন লাকী

কবি সৌমিত্র দেব তার কাব্যিক চোখে কৃষ্ণচূড়ার মাঝে দেখেন দুখিনি বর্ণমালার জলছাপ। জীবনের দহন তাকে ছুঁতে পারেনি একদমই। তবুও কবি আক্ষেপ করে বলেছেন ইতিহাস থেকে নেমে এসেছে কষ্ট, শত বিভেদের জ্বালা। ভাষার ভেতরে ভালবাসা আছে কবি সে ভালবাসা দু’হাতে তুলে আনেন দারুণ দক্ষতায়।

নম্র উপখ্যানে কবি দেখেছেন কী করে পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামে জল আর সেই জলের নিচে জীবন বিলায় এক জলবালিকা। কবি জীবনের উৎস খোঁজেন ঝর্না জলের উৎসে ভেতরে। আবার তিনি রক্তের ভেতরে দেখেন প্রকাশযোগ্য দিকচিহ্নহীন ক্ষীয়মান স্মৃতি। রাতটিকে বিদীর্ণ করা, ঝলসে উঠা বল্লমের ফলায় কবি বিনম্র হাতে তুলে আনেন সময়ের ইদিপাস, জীবনের আগুনে পুড়ে যাওয়া দুর্লভ ক্ষরণ।

‘‘তুমি আজ ঘরে নেই তবু কেন আমার ইন্দ্রিয় তোমাকেই খুঁজে ফেরে’’ কবির মনে বাসা বাঁধে অশরীরি এক দুর্দান্ত ভালবাসার অমোঘ চেতন। কবির কানে বাজে অহর্নিশ প্রেয়সীর পায়ের নুপুর। তার তৃষ্ণার্ত চোখ খোঁজে কোন অজানায় চলে যাওয়া একান্ত প্রিয় কোন মানুষের মুখচ্ছবি। স্মৃতির সামিয়ানায় তার মনে দহন করে প্রিয়াকে হারানোর কঠিন যাতনা। প্রিয়াকে অসীম ভেবে কেন যেন তার খুব ভাল লাগে। তবুও কবি জানেন তার সীমিত ক্ষমতার কথা। একান্ত প্রিয় যে মানষ প্রতীমা, কবি তাকে চিরকাল ধরে রাখতে পারবেন না জেনেও নিজেকে সপেছেন প্রিয়ার মনের ধু ধু নীল ধূসর শুন্যতায়।

মরমী হাসনে অনেকটা আবদ্ধ কবি। নিজের জীবনের উপরে কবি হাসনের প্রভাব টের পান প্রতিনিয়তই। মরমী হাসনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কবি নিজেকে অবলিলায় বলেছেন-আমি যেন মাটির পুত্র, পাকা বাড়ি বড় ভীতিকর লাগে, মাটির ঘরেই আমি নিরাপদ। ইট কাঠের এই যান্ত্রিক যুগে কবি নিজেকে বড় অসহায় মনে করে নিজেকেই বলেছেন-আমি এক পাখির শাবক। যান্ত্রিকতা তাকে কুড়ে কুড়ে খেলেও নিজের মন, মানবিকতাকে তিনি কখনই শিকায় তুলেননি বরং নিজেকে প্রসারিত করেছেন সময়ের মাঝে, সুখে-দুখে ঠিক মরমী হাসনের জীবনাদর্শে। কবি তার কবিতায় দারুণ চিত্রকল্প এঁকেছেন।

 

তার মনে ডানা ঝাপটে মরে শব্দ আর ছন্দের মাছরাঙা পাখি। ছন্দের শাসনে নিজেকে সঁপে দিয়ে তিনি বলেছেন-আমি সমাজ মানি না, সমাজ মুক্ত চিন্তার আলোকে নিভিয়ে দিয়ে, কবিতাকে থামিয়ে দেয়, হৃদয়ের ফিতা দূর থেকে টেনে ধরে। দিনে দিনে যেন বাড়ছে দহন। চারদিকে শুধু যুদ্ধের নাকারা বাজে। এ দেখে কবির মন অশান্ত হয়ে উঠেছে। অত:পর যুদ্ধের মাঝেই শান্তির পূজা চলে দেখে কবি ফেটে পড়েছেন তীব্র হাসিতে। কালিমন্দিরে পৃথিবী গিয়েছে ঢেকে । তাহলে শান্তি কেন এখনও অস্তাচলে। কবি শান্তি চেয়েছেন। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সুদূরের পানে তাকিয়ে দেখেছেন আগুন ভাসছে মনু গঙ্গার জলে।

 

অন্ধ পথিক তিনি। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বুড়ো বটতলায় এসে দাঁড়িয়েছেন একটু উষ্ণতার জন্য। অথচ বট বৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছেন অসহায় এক বট বৃক্ষের সে কি এক দারুণ যন্ত্রনা। বৃক্ষের কষ্টে কবির মন চৈত্রের রোদে ফাটা ক্ষেতের মতই ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এখানে বট বৃক্ষ বলতে কবি মানুষের সততা, মূল্যবোধকেই চিহ্নিত করেছেন। ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্টে কবির মন হাহাকার করে উঠেছে।

 

মঙ্গায় খেতে না পেরে মরে যাওয়া শিশুর মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে কবি কেঁদেছেন বিলাপ করে। তার মন বিদীর্ণ হয়েছে মঙ্গাকবলিত মানুষের কষ্ট দেখে। গাছে গাছে ঝুলে আছে চাল-ডাল-তেল-নুন-তরি-তরকারী অথচ মানুষ মরে যাচ্ছে ক্ষুধায়। ক্ষুধার্ত এসব মানুষের কথা মনে করে কবি বলেছেন-সময় এখন দু:সময়। জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি সত্যের সন্ধান করেছেন জীবনভর।

পৃথিবীর রূপ রস গন্ধে তিনি বিভোর হয়ে বলেছেন-ইশানী আমার মাতা, আমি তার অধম সন্তান। কবি এ পর্যায়ে এসে ঠিক বুঝতে পেরেছেন যে, জীবনের বড় পুঁজি ভালবাসা। কবিতা তার প্রেম আর তিনি কবিতার প্রসন্ন প্রেমিক। অথচ জীবন তার হাতে রাখি বেঁধে দিয়ে দেয় বিপরীতমুখী ছুট। সময় যেদিকে ছোটে কবি তার উল্টো দিকে ছোটেন। সততা ও মূল্যবোধকে কবি ‘শিবানী’ সম্মোধন করে বলেছেন-শিবানী আমার কন্যা, তার জন্য আগামী পৃথিবী।

 

পৃথিবীর লাবন্যতা ক্রমশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে আসছে। কবি সেই অমসৃণ পৃথিবীর দিকে নেত্রপাত করে বলেছেন-পাথরে লাবণ্য দেখে আমার ভেতরে আসে আবুল হাসান। এখানে আবুল হাসান বলতে কবি জীবনের মসৃণতাই বুঝিয়েছেন। কবি তার কবিতাকে বলেছেন-কাঞ্চন আলোয় একদিন জন্ম নিয়েছিল-ক্যামেলিয়া। এই ফুল যেন অনাদরে ফুটে থাকা এক করুণ রসের সৃষ্টি। কবিতা তাকে ধরে আছে আজীবন। মহাকাল তাকে বর্জন করলেও তিনি কখনই কবিতাকে ছেড়ে যাবেন না বলে কসম খেয়েছেন পথের ধুলিকনা, নয়তো শামুক শাবকের শরীর স্পর্শ করে।

 

কাব্যিক এক দারুণ চেতনাবোধ কবিকে জাগ্রত করেছেন সারাটি সময়, অনন্তকাল। দেশপ্রেম কবিকে পাগল করে দিয়েছে যেন। তিনি বলেছেন ঘাতক লাল করে দিয়েছিলো আকাশের বুক। এখানে তিনি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি মনে ধারণ করে হানাদারদের দায়ি করেছেন আকাশকে, বাতাসকে, বাংলাকে অপমান করার দায়ে। আবার সেই এক রাতে ফুটেছিলো লাল ফুল বলে কবি বিজয়ের স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেন তার কবিতার ভাষায়। ক্ষত-বিক্ষত সংবিধানের পাতা কবির চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে দেখে তিনি আক্ষেপ করেছেন। শস্যের স্বাদ লাগুক সবার জিভে বলে কবি বোঝাতে চেয়েছেন শান্তি যেন সবার বাড়িতেই থাকে।

 

কবি প্রকৃতিকে ভালবাসেন। মানুষকে ভালবাসেন। ভালবাসা মানেই নিজস্ব এক নদী’ বলে কবি তার অন্তরে ফুটিয়েছেন ভালবাসার এক দারুণ রঙিন গোলাপ। যে গোলাপের গন্ধে কবি বিভোর হয়ে জন্ম দিয়েছেন হাজারো গোলাপী কবিতা। দিগন্তের সুনীল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে কবি বলেছেন-পৃথিবীর সব গাছ কাটা পড়ে গেল, শিউলি ফুলেরা নেই। মানুষের নির্মমতা কবিকে দারুণভাবে আঘাত হেনেছে। বেদনার স্মৃতিগুলো যেন কবিকে তাড়া করে ফেরে প্রতিদিন। কবি তার কবিতায় গ্রামের ও শহরের পার্থক্য ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সাথে। গ্রাম হল মানুষের চোখের মত, শহর যেন তার হাত পা, গ্রাম কত সুন্দর। গ্রামের নৈসর্গিকতায় পাগল হয়ে কবি বলেছেন-শহর বিয়ে করল তার পাশের বাড়ির গ্রামকে। আর গ্রাম এক মাকড়সা মা। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা গেল। এখানে কবি তার গ্রামের প্রতি ভালবাসাকে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।