সালেম সুলেরী
"মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীর কিডন্যাপের বিচার না করে আ'লীগ ভুল করেছিলো" : জে. সফিউল্লাহ { প্রথম প্রামাণ্য প্রতিবেদন, সাসু সম্পাদিত সাদাকালো, ১৯৯২}
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশে-বিদেশে পরিচিতি পান মেজর ডালিম।
কারণ বাংলাদেশ বেতারে প্রথম ঘোষণাটি দিয়েছিলেন তিনি। কাকভোরে বলেছিলেন 'খুনী মুজিবকে খুন করা হয়েছে।' যদিও ঘোষণার আরও ১৭ মিনিট পর মহামুজিব নিহত হন। কিন্তু হত্যাকান্ডের তথ্যগুলো যথাসময়ে রেডিওতে পৌঁছায় নি।
প্রধান হত্যাস্থল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ডালিম ছিলেন না। নীতিনির্ধারকেরা ওনাকে দায়িত্ব দেন রেডিও স্টেশন দখলের। ভোর সাড়ে পাঁচটায় শাহবাগস্থ স্টেশনে চালান সফল অপারেশন। দারোয়ানকে লাত্থি মেরে ফটক খুলে নেন। এনাউন্সমেন্ট রুমে গিয়ে প্রচার করেন প্রেসিডেন্ট হত্যার খবর। ইথারে ভাসতে থাকে ঐতিহাসিক স্বর-- 'আমি মেজর ডালিম বলছি।' যদিও ১৫ আগস্টের রক্তের দাগ ডালিমের হাতে ছিলো না।
ডালিম অদম্য, সাহসী তবে হত্যাস্থলের চরিত্রগুলো আলাদা। মেজর নূর, বজলুল হুদা, পাশা, মহিউদ্দিন, মোসলেম..। মেজর ডালিম সেই মূল অপারেশনে ছিলেন না। মেজর ফারুকের নেতৃত্ব তখন ডালিমকে অনত্র পাঠায়। এর নেপথ্য কারণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, ঘটনাবহুলও। নীতিনির্ধারকদের বিশ্লেষণ ছিলো সুস্পষ্ট। যে, ডালিম ৩২ নম্বরে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলবে। দুর্বলতায় পেয়ে বসতে পারে তাকে। কারণ মেজর ডালিমের বিয়ের 'উকিলবাবা' স্বয়ং প্রেসিডেন্ট মুজিব। স্ত্রী নিম্মি চৌধুরীসহ ডালিম ৩২ নম্বরে থেকেছে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে ছোটবেলা থেকে মা ডেকেছে। শেখ হাসিনা, কামাল, জামাল, রেহানা, রাসেল পারিবারিক সুহৃদ।
ঢাকার মালিবাগে বেড়ে ওঠা ডালিম শৈশবেই মাকে হারান। কামাল-জামালের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বেগম মুজিবকেই 'মা' ডাকতেন। ৩২ নম্বরে অবাধ যাতায়াত, খাওয়া-দাওয়া। সেই মুজিব পরিবারের ওপর বন্দুক ধরা কি সহজকথা! যতোই বিপ্লবী হোক-- ডালিম কি তা পারবে? ঠান্ডা মাথার মানুষ মেজর ফারুক তাই ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেন।
মুজিবহত্যার কারণগুলোর মধ্যে পাঁচ নম্বরে ছিলো 'ডালিম প্রসঙ্গ'। অফিসার্স ক্লাবের বিয়ের আসরে স্ত্রী নিম্মি চৌধুরীর শ্লীলতাহানি। প্রগতিশীল নিম্নির সঙ্গে ডালিমের পরিচয় ১৯৭১-এর যুদ্ধবর্ষে। যুদ্ধক্ষেত্রে গুলীবিদ্ধ ডালিম কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎধীন ছিলেন। কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসে নিম্নির বাবা শামসুল হকের চাকরি। হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবা দিতে গিয়ে নিম্নি-ডালিম পরিচয়, প্রণয়। স্বাধীনতার পর মহামুজিবের সংশ্লিষ্টতায় শুভ পরিণয়।
ইস্কাটনের 'লেডিস ক্লাবে' প্রবাসী তরুণ বাপ্পীকে ঘিরে গন্ডগোল। বিয়ের আসরে প্রতিপক্ষ-- পাড়ার একদল বখাটে ছেলে। বাপ্পীর লম্বা চুল ধরে পেছন থেকে টানাটানি। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে চড়-থাপ্পড়ের শাস্তি দেন ডালিম। প্রতিপক্ষের বখাটেরা পালিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে। সঙ্গে তখন নগর আ'লীগের সভাপতি, 'রেডক্রস' চেয়ারম্যান। একনামেই সর্বপরিচিত-- গাজী গোলাম মোস্তফা। অস্ত্রসজ্জিত দুটো মাইক্রোবাসে ডালিম-নিম্নিকে তুলে নিয়ে যান। উল্লেখ্য, মেজর ডালিম তখন চাকরিতে সাসপেন্ডেন্ড ছিলেন। কুমিল্লায় ছাত্রলীগ নেতাদের অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার করায় বিপদে পড়েন।
মেজর ও মেজরপত্নীর অপহরণের খবর পৌঁছে যায় সেনানিবাসে। ডালিমের দুই পেশাজীবী সামরিক বন্ধু ছুটে আসেন সিদ্ধেশ্বরী। দু'জনের খোঁজে গাজী সাহেবের বাড়িতে চালান তল্লাশী। বাসায় প্রবেশের এই আকস্মিক ঘটনাটি নিয়ে জল ঘোলা হয়। সামরিক চাকরিবিধির শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ তোলে আ'লীগ। অন্যদিকে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান মেজর ডালিম। মহামুজিব ওনার উকিলবাবা শুনে প্রতিপক্ষ রণে ক্ষান্ত দেন।
পরে ৩২ নম্বরে নিয়ে গেলে মহামুজিব একটি সমঝোতা করে দেন। কিন্তু বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ডালিম তা মানেন নি।
অন্যদিকে ক্যান্টনমেন্ট হয়ে ওঠে মহাউত্তপ্ত। সেনাপ্রধান জে. সফিউল্লাহকে চাপ দেন সামরিক কর্তারা। ডালিম ও তার পত্নীকে নির্যাতনের বিচার চান। বিষয়টি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাম সরকারপ্রধান মুজিবকে জানানো হয়। কিন্তু ফলাফল আসে পুরোপুরি উল্টো। গাজী গোলাম মোস্তফার বাসায় তল্লাশী চালানো মেজরদ্বয় সাসপেন্ড হন। এই শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশের সেনাপাড়া।
ওপরের বিবরণটুকু সেনাপ্রধান জে. সফিউল্লাহ সূত্রে প্রাপ্ত। ১৯৯১-এ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। কানাডায় হাইকমিশনার থাকা সফিউল্লাহ এক নোটিশে দেশে ফেরেন। সেবারই সর্বপ্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন আমাকে। সেনানিবাসের ঝকমকে গেস্টহাউজে উঠেছিলেন তিনি। যদিও সেনানিবাসের এক নম্বর বাসাটির মালিক উনি। তখন ভাড়া থাকতেন বিএনপির বিতর্কিত নেতা মেজর (অব) আখতারুজ্জামান।
জে. সফিউল্লাহ'র বহুধা বিস্তৃত কথামালা তিনটি মিডিয়ায় ছাপি। সাপ্তাহিক আকর্ষণ, নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানা। এবং আমার সম্পাদিত 'সাদাকালো' পত্রিকায়। 'দ্যা কিল্ড এন্ড দ্যা কিলার্স' শিরোনামে সিরিজ করি। তাতে মুজিব-জিয়া-খালেদ-তাহেরসহ জেলহত্যার নেপথ্যতথ্য ছিলো। বিশেষ আকর্ষণ ছিলো একাধিক দুর্লভ আলোকচিত্র। একছবিতে মুজিব-জিয়া-সফিউল্লাহ-খালেদ-কর্ণেল ফারুক-রশিদ-ডালিম..।
'সাদাকালো' ট্যাবলয়েডে ১৯৯২ সালে জে. সফিউল্লাহ দিলেন সাক্ষাৎকার। বললেন >> মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীর কিডন্যাপের বিচার না করে আ'লীগ ভুল করে।" মেজর ডালিম দম্পতির ওপর প্রথম প্রামাণ্য প্রতিবেদন সেটি। আমি ১৯৮৭--১৯৯১ পর্যন্ত ৪২০ মালিবাগে ভাড়া ছিলাম। বাড়িটি ছিলো আর্টকলেজ প্রিন্সিপাল শিল্পী আমিনুল ইসলামের। সম্পর্কে তিনি মেজর ডালিমের নিজের মামা। ফলে অনায়াসে অনেক তথ্য সেখানে পেয়ে যাই। শিল্পোদ্যোক্তা আবুল খায়ের লিটু, স্বপনও ডালিমের নিকটাত্মীয়। জাহাজমার্কা বাসাটিতে ছিলো অবাধ গতায়াত।
সর্বাধিক সার্কুলেশনের 'সন্দ্বীপ ম্যাগাজিনে' নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম ১৯৮৮--৯১ পর্যন্ত। তাতেও রাজনৈতিক হত্যাবলী নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার ছাপি। ভারতে অবস্থানকারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। সিরিজ আকারে পর পর ১০ সংখ্যায় তা ছাপি। সেসব দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার যৌথবই বেরোয় ১৯৮৯-এ। মুজিবহত্যার বিতর্কিত নায়ক ছিলেন মেজর / কর্ণেল ফারুক রহমান। দু'ভাবে আমি ওনার কথোপকথন ছেপেছিলাম। প্রথমটি বৃটেনের বার্মিংহামে দুই পর্বে নেওয়া। নিয়েছিলেন লেখক-কলামনিস্ট ফজলুল আলম। তিনি চ্যানেল আই-খ্যাত ফরিদুর রেজা সাগর ভাই-এর চাচা।
সন্দ্বীপে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি করেছিলো প্রতিবেদক আফরোজা নাজনীন। ভীষণ আলোড়িত হয় সেই প্রামাণ্য সাক্ষাৎকারটি। মেজর ডালিমকে বলা হয় ১৫ আগস্টের 'কাগুজে বাঘ'।
জে. সফিউল্লাহ অবশ্য এভাবে বলার পক্ষপাতী নন। তিনি বলেন ঐদিন যে দায়িত্ব পেয়েছে, পালনের চেষ্টা চালিয়েছে। সকাল পোনে নয়টার দিকে এক জীপ সৈন্য নিয়ে হাজির। আমি সেনাপ্রধান এরিয়ায় ৩৭-৩৮ অফিসার নিয়ে সভা করছি। আমাদের করণীয় বিষয়ে আলোচনা চলছিলো। হঠাৎ সে এসে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলী করে। সভাটি আকস্মিকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ৪-৫ জন সিনিয়র অফিসার সামনে বসা ছিলো। আমাকে বললো চলেন, প্রেসিডেন্ট ডাকতেছে। জে. জিয়া বলে উঠলো-- প্রেসিডেন্ট মানে? ডালিম বললো >> কেনো জানেন না, খন্দকার মোশতাক। সফিউল্লাহ বললেন >> উনি হয়তো তোমার প্রেসিডেন্ট, আমিতো জানি না।
ডালিম বললেন >> চলেন স্যার, উনি শপথ নিয়েছেন। আপনারা গেলেই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। সফিউল্লাহ জে. জিয়াকে বললেন-- তুমিও সঙ্গে চলো। ডালিম বললেন, উনি যেতে পারেন তবে আলাদা গাড়িতে। আর আপনি স্যার আমার গাড়িতে ওঠেন। এরপর সেনানিবাসে আরেকটি নাটক করলেন মেজর ডালিম। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে নিয়ে সেনানিবাসের চতুর্দিকে চক্কর দিলেন। অর্থাৎ জানান দিলেন পঁচাত্তর বিপ্লবে সেনাপ্রধানও সঙ্গে আছেন। অত:পর ১৫ আগস্টে শাহবাগের রেডিও স্টেশন অভিমুখে অভিযাত্রা।
সালেম সুলেরী : বিশ্বনন্দিত কবি ও সাংবাদিক
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2025 RED TIMES. All rights reserved.