Sharing is caring!
শামীম আজাদ
বিদেশে দৈবের বশে আমি আজ এক গল্পের ফেরিওয়ালী। ছিলাম শিক্ষক ও সাংবাদিক । তারপর কবি ও শিক্ষক। তা থেকে একসময় এর সবগুলো দক্ষতা নিংড়ে হলাম গল্প দিদি।
দেশান্তরে জীবিকার শুরু ৯০ সালে সরকারী প্রাথমিক স্কুল টমাস বাক্সটনে।দেশে লেখালেখি চালিয়ে এই বিদেশে শিক্ষকতা করেছি টানা ২০ বছর। মনেপড়ে, তখন নিজের জ্ঞানের হাঁড়ির তলাটিও চেঁছে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে কবিত্বের প্রাণ গামছা দিয়ে বাঁধতে পারি নাই। সে কেবল কবি হতে চায়, লেখক হতে চায়, লিখেই উপার্জন করতে চায়। স্কুলের হেড বা ডেপুটি হতে চায় না।
এদিকে বিলেতের বাড়িতে মেঝে মুছে আয় করতে চাইলেও পড়া লাগে, পরীক্ষা পাশ লাগে,সনদ লাগে। তাই কাজের সমান্তরাল সময়েই ফাঁকে ফাঁকে রাত জেগে পড়াশোনা করে উমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোয়েট এ্যান্ড স্টোরিটেলার ইন এডুকেশনে স্নাতক করলাম। জানলাম, এদেশে সব শিল্প বা সৃজন বিদ্যাই সামাজিক শুশ্রূষা মাথায় রেখে প্রশিক্ষন দেয়া হয়। কিন্তু ‘এলাম দেখলাম জয় করলামের’ মত হল না। বিয়াল্লিশ বছর বয়সে তা হল ঘষ্টাতে ঘষ্টাতেই। পশ্চাতের খাল বাকল তুলে ঈশিতা, সজীব ও কমরেড আজাদের সাহায্য ও ভালবাসায়।
শিখলাম, এক মাঠ মানুষকে নিয়ে কিভাবে সাঁতরে পেরুতে হয় পূর্ণিমা পুকুর, টয়লেটের আউটলেটকে টঙ, অলেখাকে লেখা আর কিভাবে রোগ থেকে রোদন উঠিয়ে মানুষকে খানিক অব্যাহতি দেয়া যায়। সনদ পাওয়া মাত্রই স্কুলে পড়ানোর কাজ কমাতে কমাতে এক সময় ছেড়ে দিয়ে স্বপ্নের “রাইটার” হলাম। সৃষ্টিশীলতাই হল জীবিকা। সেই থেকে আজ অবধি…।
বিলেতে আমার গুরুদেব ও গুর্বী হলেন এবং ছিলেন মাইকেল রোজেন, ওয়েন্ডি কো্প, স্যালি পম ক্লেইটন, বেঞ্জামিন জাফানায়ারা, হেলেন ইষ্ট এঁরা। আমি তাঁদের বিদ্যাকে তাবিজ করে তবলা বাজাতে শুরু করেছিলাম কিন্তু যেহেতু আমি সালমান রুশদী বা রঞ্জনা এ্যাশ না। পার্লামেন্ট থেকে আমি বহুদূরে পেইভমেন্টে বসবাস আমার তাই যে কোন রকমের ছোটখাটো ফুট ফরমাশও আনন্দের সঙ্গেই করেছি। তবুতো আর্টস করে খাচ্ছি! মনের মাইকে মুখ রেখে বলেছি, ‘শামীম তুমি শুধু লিখে যাও, শব্দ দিয়েই বিস্কুট কিনতে পারবে, ইংল্যান্ডে এদেরই লিঙ্গুয়াফ্রাংকাতেই নিজশিল্প করতে করতে একদিন নাদের আলী তোমাকেও তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে।’
আমার এজেন্ট ছিল এ্যাপল এ্যান্ড স্নেইক্স ( সুন্দর নাম না?) এখান থেকেই কাজ পেতাম। আমাকে বিদ্যালয়, ফেস্টিভ্যাল, ওল্ড হোম, হাসপাতাল, কমিউনিটি হল, লাইব্রেরী, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় না কোথায় ওরা পাঠাতে থাকলো ভাবতে পারবেন না! সে সব জায়গায় খিদে পেলে কখনো অর্গানিক আহার, কখনো কড়া হালুয়া, কখনো শুধু সুন্দর বুদবুদ পানীয় পাই। কখনো উপস্হাপনা উপাচারের সঙ্গে কাঁধের ঝোলার মধ্যে করে নিয়ে যাই কলা। আর দম ফুরিয়ে এলে উইম্বল্ডন টেনিস মাঠের খেলোয়ারদের মত এক কামড় কলা গিলে বাকিটা তার ত্বকেই পেঁচিয়ে পরের বারের জন্য ভরে রাখি। লাঞ্চবক্স লাগেনি। আজ ভাবতে অবাক লাগছে সেই আমি এ্যাপলস এর কবি হিসেবেই লাভ করলাম বিলেতের জাতীয় সংগঠন ন্যাশনাল লটারী পুরস্কার। সারা বিলেতে থেকে ১৩ জনকে দিল ‘আর্ট ইন দা কমিউনিটি এওয়ার্ড’! আমি তার একজন! বলেন ‘অবিশ্বাস্য!’
কী করে এতদূর এলাম? কখনো নিগৃহীতের মত বাথরুমের পাশে নড়বড়ে কোন এক চেয়ারে বসে একটা টেবিল যোগাড় করে মুখে মেগাফোন লাগিয়ে ‘এই গল্প গল্প গল্প,… মাইছা মাইছা মাইছা…স্টোরি স্টোরি স্টোরি…’ হেঁকে হেঁকে দর্শক জুটাতে হয়েছে। আড় ভেঙে দিয়েছেন স্যালি পম ক্লেইটন। কখনো শুধু মাত্র আমার কারণে বাংলাদেশের নামখানা কাগজে ছাপবে বলেই বেহায়ার মত লট্কে থেকেছি।কলিজার থোড় থেকে প্রাণ উগরে দিয়ে কাজগুলো করার শিক্ষা পেয়েছি। এতে করতালি থেকে কখনো অনন্য মন বিবাগী করা বেহেস্তও পেয়েছি।
সে রকমই একদিনের কথা বলছি।
গল্প বলার কাজ ছিলো বিলেতে প্রথম স্থাপিত বিশ্ববিখ্যাত শিশু হাসপাতাল গ্রেট অরম্যন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে। এই হাসপাতালেই রুগ্ন শিশুদের জন্য ১৯২৯ পিটার প্যানের লেখক জিম ব্যারি তার বই ও নাটকের সর্বস্বত্ত্ব দান করে দিয়ে গেছেন। তখন থেকেই তারা এখানের শিশুদের শিল্প দিয়ে সেবার চেষ্টা করে আসছে।
এজেন্সীর সুবর্ণ সুন্দরী ডেইজী হাসপাতালের করিডোর থেকে বিদায় নিতেই সামনে তাকিয়ে মনে হল আমি এক অবিস্মরনীয় আনন্দউদ্যানে এসে পড়েছি।হালকা মিউজিক হচ্ছে। চারি দিকে মিষ্টি রঙের দেয়ালচিত্র আর খাবারের রঙে ছোট ছোট চেয়ার টেবিল। এ শিশুদের ক্যাফে।কোন শিশু ইন্ট্রাভেনাস নিয়ে হাঁটছে , কেউ গলায় ব্যান্ডজ নিয়ে খাবার নাড়ছে, কেউ বা চিৎকার করছে ব্যথায়, কেউ আবার মাকে ধম্কাচ্ছে কেন তাকে তার প্রিয় ফিস এ্যান্ড চিপস দিচ্ছে না। চারদিকে পরীর মত সাদা নীল জামা পরা মমতাময়ী নার্সরা এ শিশু রাজ্যে শিশুদের আর্তনাদ মমতা দিয়েই, সেবা দিয়েই কষ্ট কমিয়ে দিচ্ছেন।
আমি ছ’বছর আর আট বছরের দুজন শিশুকে গল্প বলতে গেছি। অন্ত্রে অস্ত্রোপচারের পর দুজন একই ওয়ার্ডে আছে। তাদের চুলের রঙ মুখের রেখা আর নেতিয়ে পড়া বাহুযুগলের কথা এতদিন পরও স্পষ্ট মনে আছে। গভীর ক্লান্তিতে ডুবে আছে তাদের নরম চোখ। হাসি বিষন্ন ও মলিন। একজনের আইভি লাগানো কিন্তু অন্য হাতে বুকে জড়িয়ে রেখেছে উলের ডলফিন। নিজেদের অবস্থা নিজেরাই বল্ল। ডাক্তারি যন্ত্রপাতিতে ইতোমধ্যেই তারা বিশেষজ্ঞ। দু’মিনিটেই অবসন্ন স্বরে ভাগাভাগি করে বলে দিল তাদের রোগ সারাতে এই মেশিন গুলোর অসাধারণ ভূমিকার কথা। -কিমোতে প্রথমে তোমার একটু কষ্ট হবে, বমি বমি লাগবে কিন্তু তারপরই তুমি চিল্ড্রেন্স প্লে গ্রাউন্ডে খেলার মত শক্তি পেয়ে যাবে।’ আহারে … । হায় শিশু, হায় সোনালী শিশু কি কারণে তোমার এত কষ্ট! কে বলে ঈশ্বর সব মঙ্গলের নিমিত্তেই করেন? কেন ফিলিস্তিনে এত শিশুর মৃত্যু? এগুলো দেখা কার দায়িত্ব?
ওদের দুজনের বিছানার মাঝামাঝি এক চেয়ারে বসলাম। ঝোলার মধ্যে ছিল আমার গল্পের চরিত্রের একটি প্লাস্টিক খেজুর গাছ, একটি সাদা কালো গাভী আর একটি মিনি নক্সীকাঁথা।গল্প বলছিলাম থেকে থেকে, থেমে থেমে, নার্স বা তাদের মা তাদের পরিচর্যা করার ফাঁকে ফাঁকে। একজন শুনতে শুনতে বললো, আই এ্যাম টায়ার্ড, আরেকদিন বাকিটা শুনবো।’ আরেকজন ঘুমিয়ে পড়লো।আমি ঊঠে অন্য ওয়ার্ডে যাবার আগে পেছন ফিরে দেখি শিশুটি মায়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদছে। মা কৃতজ্ঞ চোখের আর্তি নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। জানতে চান, আমি কি ফিরে আসবো? থ্যাঙ্কু শামীম। আহারে… মা’ যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিক্ষুক। এ কথা লেখার পর বাংলাদেশের আর্যের মায়ের কথা মনে হচ্ছে যে কিনা সন্তানের চিকিৎসার জন্য সর্বহারা হয়ে বিদেশে পড়ে আছে।
আমি বাংলাদেশের এক অতি ক্ষুদ্র কবি, নগন্য এক গল্পদিদি।কী ইবা আমার সামর্থ্য ? জানিতো মৃত্যুই ধ্রুব আর কোন কিছু স্থায়ী না। মহাকালের এ সংক্ষিপ্ত সময়ে আমি দাতা নই গ্রহিতা নিত্যানন্দের। এই এ্যাত্তটুকু করে আমি আমার সৃজন সংসারে এমন অবিস্মরনীয় উপহার পাইলাম? এইতো মন-বিবাগী বেহেস্ত আমার।।
শামীম আজাদ : বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি