আজ রবিবার, ১২ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিউ ইয়র্কে শনিবারের আড্ডা

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ১২, ২০২৫, ১২:২২ অপরাহ্ণ
নিউ ইয়র্কে শনিবারের আড্ডা

Sharing is caring!

‘অধ্যাপক অনিল আচার্যের মত সাহিত্য সম্পাদক বা অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়, অধ্যাপক অম্লান দত্ত ও অধ্যাপক চিন্ময় গুহর মতো চিন্তাবিদ জগতের যে কোন ভাষায়ই বিরল!’ ——আহমাদ মাযহার
আবেদীন কাদের 
আমি আর কবি শামস আল মমীন আড্ডাটা শুরু করি। কিছুক্ষণ সাহিত্যের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিলো। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই কথাশিল্পী স্বপন বিশ্বাস এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
স্বপন শুধু ভাল গল্পই লেখেন না, কবিতা এবং ব্সেটায়ার লেখেন দারুণ। ছড়াও খুব ভাল লেখেন। কিন্তু স্বপন যে সমকালীন রাজনীতির বিশ্লেষণ এতোটা সুন্দর লেখেন আগে জানতাম না। এ সপ্তাহে সাপ্তাহিক ‘বাঙালী’ পত্রিকায় বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি নিয়ে একটি সুন্দর লেখা লিখেছেন। এবিষয়ে কথা উঠতেই কথাশিল্পী বদরুন নাহার, কবি অভীক সোবহান ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী জান্নাত সৈকত এলেন। আমাদের আড্ডায় হঠাৎ করেই কথা উঠলো বদরুন ও অভীকের জিগরী দোস্ত ডঃ ফারজানা সিদ্দিকার বই নিয়ে। আমরা গত সপ্তাহে তাঁর দুটো বই নিয়ে সামান্য কিছুটা কথা বলেছিলাম, কিন্তু ওঁর যে অভিসন্দর্ভ ও প্রবন্ধগ্রন্থটি আমরা পাঠ করেছি তা নিয়ে আমার তেমন কিছু আলোচনা করা হয়নি সময়াভাবে। তাই আমি একটা গ্রন্থালোচনা লেখা শুরু করলাম, আসলে আড্ডায় দায়সারা গোছের কথাবার্তা হয়, অভিনিবেশ নিয়ে আলোচনা একমাত্র লিখে বলাই সম্ভব। দেখা যাক যদি কিছুদিনের মধ্যে লেখাটা শেষ করা যায়। ফারজানার লেখার বিষয়ে সবচেয়ে ভালো জানেন বদরুন আর অভীক, কিন্তু আমি যেহেতু তাঁর লেখার নতুন পাঠক তাই এ দুটি বইয়ের বাইরে তেমন কিছু জানি না। তবে বদরুন কিছুটা বললেন ফারজানার লেখক জীবনের গোড়ার দিকের লেখার প্রকৃতি নিয়ে। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। দুয়েক মিনিট কথা বলতেই আহমাদ মাযহার ও নসরত শাহ এসে উপস্থিত। কনকনে শীতের মধ্যে আড্ডার সদস্যরা আসতে পারবেন কিনা, সেটাই আমার চিন্তা ছিলো। আমি আর দেরি না করে কফি তৈরিতে গেলাম, পেছন ফিরে দেখি তানভীর রব্বানীও এসেছেন। রাব্বী এলেই ছোলা ভাজা, পিঁয়াজু ও মুড়ি নিয়ে আসেন অতি উৎকৃষ্ট ও দামী পানীয়র সঙ্গে, আজও কোন ব্যাত্তয় ঘটে নি তার। সারা ঘর আড্ডার সদস্যে ভরে গেলো, আমরা তুমুল তর্ক শুরু করে দিলাম বিভিন্ন বিষয়ে। তবে সাহিত্যই ঘুরে ঘুরে আসছিলো! কফি সবার জন্য হাতে নিয়ে আসতেই দেখি তখনও ডঃ ফারজানার বইয়ের, বিশেষ করে অভিসন্দর্ভ বা প্রবন্ধের গুণগত মান এবং এর মধ্যে দিয়ে তিনি যে সাহিত্যাদর্শের পরিচয় দেন তা নিয়ে কথা বলছেন বদরুন ও অভীক। ওঁদের দুজনের কথা শেষ হলে মাযহার কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। কিন্তু আমি যেহেতু গ্রন্থালোচনা লেখা শুরু করেছি, আমার তেমন কিছু বলা সমীচীন হবে না। কিন্তু আমার বই দুটো পড়ার পর যে-মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে দুয়েকটি কথা বলতে গিয়ে আমি শুধু বললাম ফারজানার যে-কোন লেখায় যে-‘আনকোরা শক্তি’ থাকে, যাকে ইংরেজি ভাষার সমালোচকরা Raw Energy বলে অভিহিত করেন সে- সম্পর্কে বললাম। ফারজানা আপাত গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়েও যে ইনটেনস বা তীব্রতার পরিচয় দেন, তা সম্ভবত তাঁর অন্তর্গত সত্তার এক সমাজ-বিষয়ে-বিরামহীন-ভাবনার পরিচয়। এটাকে সমাজবিজ্ঞানীরা Socio-Political Activist এর ‘মনোজগতের ক্ষরণ’ বলে ভাবতে পারে। এটা ইতিহাস রচয়িতার জন্য কিছুটা ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু সৃষ্টিশীল প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য একটি অসাধারণ গুণ বলা যায়। আমাদের দেশে যারা প্রথম সারির প্রাবন্ধিক এখনও জীবিত আছেন এমন দুয়েকজনের এই বিরল গুণটি তাঁদের লেখায় দেখা যায়। কিন্তু কলকাতায় তিরিশ এবং চল্লিশ দশকের চিন্তাশীল প্রাবন্ধিকদের অনেকের মাঝে সেটি রয়েছে, যারা প্রবন্ধ সাহিত্যকে প্রায় সৃষ্টিশীলতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেন এই গুণটি আবার ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে বলেছি সেটি হলো, এই ‘তীব্রতা’ শিল্পবিচারে কিছুটা না পক্ষপাতের সৃষ্টি করে, বা কনক্লুসিভনেস বা প্রাবন্ধিককে কিছুটা জাজম্যানটাল করে দেয়, সেই ঝুঁকি ফারজানাকে সারাক্ষণ ভীষণ ক্ষীণ অদৃশ্য সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করে। যদিও পুরোটা বই পড়ার সময় আমার মনে সে-ভয় থাকলেও কখনও তাঁকে খুব Strongly Conclusive হতে দেখি নি। এই ধরনের লেখক-প্রকৃতি বা চারিত্র বজায় রাখা অনেকটা কঠিন। অভিসন্দর্ভটি পড়তে গিয়ে আমার সারাক্ষণ মনে একটি প্রশ্ন জীবন্ত ছিলো, সেটি হলো ইতিহাস, ইতিহাস নির্মাণের বা পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্র, তার সঙ্গে সাহিত্যের অবিভাজ্য সম্পর্ক এতো বেশি জটিল এবং ডিসকারসিভ যে তাকে খুব সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নাও হতে পারে, যতোটা তা মূলত ঘটে থাকে। এর কারণ সম্ভবত ইতিহাস নিজেই খুব বেশি ‘অস্থির’, দোলায়মান এবং পরিপার্শ্বের অগণিত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে তা নিরন্তর রূপ বদলায়। ইতিহাসবিদ জুলিয়ান বার্নসের একটি লেখার উদ্ধৃতি আমার ছাত্র জীবনে কয়েক দশক আগে পড়া, কিন্তু অবিকল মনে আছে, যা আমাকে এক সময় খুব ভাবিয়েছিলো। বার্নস লিখেছিলেন, ‘History isn’t what happened. History is just what historians tell us. There was a pattern, a plan, a movement, expansion, the march of Democracy; it is a tapestry, a flow of events, a complex narrative, connected, explicable. One good story leads to another…We make up a story to cover up the facts we don’t know or can’t accept.’ ফারজানার ব্যাখ্যা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছিলো কথাশিল্পীরা যে-ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করেছেন, ইচ্ছায় অথবা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত, শুধুই শিল্প সৃজনের প্রয়োজনে, তা নিশ্চয়ই নতুন আরেক ‘ইতিহাস’ হতে বাধ্যও বটে!
ডঃ ফারজানা সিদ্দিকার বই দুটো নিয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো আমরা অনেকক্ষণ ধরে কথা বললাম। তবে এসপ্তাহের আড্ডায় আমিই বরং তাঁর লেখার কিছু বৈশিষ্ট্য এবং গবেষক হিশেবে অধ্যাপক সিদ্দিকার মেধার শক্তি এবং ভিন্নভাবে দেখার চোখ বিষয়ে দুয়েকটি মন্তব্য করেছি, একটু বাচালের মতো। যেহেতু সেগুলো সবই আমার প্রবন্ধে থাকবে তাই এখানে আর বলছি না। আমাদের আড্ডায় আলোচিত বিষয় নিয়ে লেখা ফেসবুকে দিলে এর দৈর্ঘ্য নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন। আমি তাঁদেরকে বলি, আমরা যেহেতু ছয় সাত ঘণ্টা ধরে নিজেদের মধ্যে চিল্লাচিল্লি করি, তাই পুরোটা লেখা প্রায় অসম্ভব, শুধু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বিষয় বা রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের কথা উঠলে সেগুলোকেই শুধু নথিবদ্ধ করে রাখতে চাই। তাছাড়া আমি আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে প্যাশনেটলি যে একটা মাত্র কাজ করি, সেটা আড্ডা। তাই আমার প্রিয় তিনটি পত্রিকাকে ঘিরে আড্ডার ইতিহাস আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিচারণে, সেরকম আড্ডা আমরা কোনদিন দিতে পারবো না কারণ আমাদের সে-মেধা নেই। যে তিনটি সাহিত্য পত্রিকার কথা বলছি সেগুলো হলো বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার আড্ডা, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকার আড্ডা ও সমর সেনের ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকা ঘিরে একটি আড্ডা। আমার নিজের ধারনা জগতের যে কোন উন্নত দেশের মেধাবী পণ্ডিত ও সৃজনশীল মানুষদের পক্ষেই শুধু সে ধরনের আড্ডার কথা কল্পনা করতে পারেন। ‘নিউ ইয়রকার’ পত্রিকায় সম্পাদক শন উইলিয়াম তাঁর লেখকদের নিয়ে, বিশেষ করে সহকর্মী ভেদ মেহতা, বা পত্রিকার লেখক কবি ডব্লিউ এইচ অডেন ও দার্শনিক হ্যানা এরেনটকে সঙ্গে নিয়ে যেসব আড্ডা দিতেন বলে তাঁদের স্মৃতিকথায় পড়েছি, তা শুধু আমাদের কল্পনার রাজ্য। কারণ অসাধারণ এসব আড্ডা বা বিষয়ের উজ্জ্বলতায় আলোকিত এরকম কোন আড্ডা দেয়াতে আমাদের মেধা নেই। আমরা শুধু যে সামান্য বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করি তা নিয়েই সামান্য কথা বলতে পারি। কিন্তু আমাদের আড্ডাতেও কবি শামস আল মমীন, আহমাদ মাযহার, বদরুন নাহার, অভীক সোবহান , স্বপন বিশ্বাস, এবিএম সালেহউদ্দীন, আদনান সৈয়দ ও নসরত শাহ এঁরা সবাই শক্তিশালী সৃজনশীল মানুষ, এঁরা এমন সব ব্যাখ্যা দেন বিভিন্ন সাহিত্যিক লেখার যা আমার মতো দুর্বিনীত ও অতৃপ্ত মানুষকেও মাঝে মাঝে বিস্মিত করে, তাই আমি যতদিন শরীর অনুমোদন করে আড্ডাটা চালিয়ে যেতে চাই, নতুন নতুন বিষয় শেখার জন্য। কিন্তু এসপ্তাহে আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেই, সেটা হলো, প্রতি সপ্তাহে একজন কবি, চিত্রশিল্পী, কথাশিল্পী বা প্রাবন্ধিক বা সুরশিল্পীর কাজ নিয়ে আমরা কয়েকজন নিজেদের মতো আলোচনা করে তা লিখে রাখবো। বিশেষ করে ঢাকা ও কলকাতার এসময়ের বেশ কয়েকজন কবি ও কথাশিল্পী আমাদেরকে সত্যিই মুগ্ধ করেন তাঁদের সৃষ্টি দিয়ে। আমরা সেগুলো পড়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবো, লিখে জানাবো আমাদের বন্ধুদের।
এসব কথা ভাবতে গিয়ে দেখলাম গত সপ্তাহের লেখা ফেসবুকে দেয়ার পর আমার গভীর শ্রদ্ধার মানুষ, এক সময়ের সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকার সম্পাদক, তরুণ বয়সে যিনি ছাত্ররাজনীতিতে ফায়ারব্র্যান্ড ছিলেন, সেই সৈয়দ তোসারফ আলী গত সপ্তাহের আড্ডা নিয়ে মন্তব্য লিখেছেন একটি প্রশ্নের ধরনে, কেন আমাদের সাহিত্য, শিল্প বা কবিতার জগৎ একটি বৃত্তের মাঝে বহুদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে! তাঁর শঙ্কা মেধাবী শিক্ষার্থীরা সাহিত্য সাধনায় আসছে না, এর কারণ কী! এই প্রশ্ন আমাকে সারা সপ্তাহ ধরে ভাবিয়েছে। আমি বিষয়টি এসপ্তাহের আড্ডায় তুলেছিলাম। অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, তবে আড্ডার অধিকাংশ সদস্য প্রায় একই মন্তব্য করেছেন, সেটি হলো, সমাজের বা সংস্কৃতির ও শিল্পের মান নির্ধারণ করার চাবিকাঠি হলো সে-দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান। আমাদের দেশ থেকে শিক্ষা, মানে ইংরেজ উপনিবেশিক শাসনামলের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রায় বিলুপ্ত। আমরা যে স্বাধীন জাতি হিশেবে একটি ভালো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি সেটি আমাদের সাহিত্যের বা শিল্পের মান খুব ভালো না হওয়ার প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ সম্ভবত আমাদের গত সারে পাঁচ দশকের পুরো সময় জুড়ে নষ্ট রাজনীতি। তৃতীয় কারণ সম্ভবত আধুনিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় আমরা ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছি বলে আমাদের সমাজে কোন ‘প্রতিষ্ঠান’ই শক্ত ভিত্তি পায়নি, হোক তা আইনের শাসন, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি বা এগুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত উপরিকাঠামো হিশেবে সংস্কৃতি ও শিল্পকলার সকল শাখা। বিচ্ছিন্নভাবে দুয়েকজন ভালো শিল্পী বা কবি বেরুলেও সামগ্রিক অর্থে আমাদের শিল্পকলার প্রায় সকল শাখাই দুর্বল এবং শ্রদ্ধেয় অগ্রজ সৈয়দ তোসারফ আলী যাকে বলেছেন ‘একটা বৃত্তের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে’, তা সর্বাংশে সত্য। দ্বিতীয় যে মন্তব্যটি আমাকে চিন্তিত করেছে, ভেবেছি ও আড্ডায় তুলবো সেটি লিখেছেন আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব কবি কাজী আখতার হোসেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন এখনো কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের পর কেন শহীদ কাদরীর নাম উচ্চারিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো, আগে শামসুর রাহমানকে প্রধান কবি বলা হতো, এখন কবিদের মধ্যে প্রধান, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ কারা? এই প্রশ্নটি আমাদের আড্ডায় আগেও আলোচনা হয়েছে, কিন্তু আমরা তথ্য প্রমাণাদিসহ কখনও সিদ্ধান্তে আসি নি। জানি বিষয়টি অবশ্যই সাবজ্যাকটিভ, কোন সিদ্ধান্তে আসা কঠিন, কিন্তু তবুও কবি বন্ধু কাজী আখতারের প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা সামনের আড্ডায় বিস্তারিত আলোচনা করবো বলে কথা বললাম। হোক না এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা, যে কেউ তাঁর মতো করেই বলবেন, তবুও আলোচনা তো করতে পারি আমরা!
এরপর আড্ডায় আবার কথা উঠলো কম্পিউটার জগৎ ও আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বিষয়ে সাম্প্রতিক ভাবনা নিয়ে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতাকে কম্পিউটার ও এ আই-এর জগৎ। আমাদের আড্ডার সদস্য ও গল্পকার কম্পিউটার বিজ্ঞানী তানভীর রব্বানী বিষয়টির শক্তি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। বদরুন ও অভীক তাতে যোগ দিলেন, আমি এবিষয়ে বিন্দুবিসর্গ জানি না। কিন্তু অভীক এমন ভয় দেখালেন যে এটাই হবে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মূল ভাষা, সুতরাং এটা শেখা ভীষণ জরুরি! অভীকের ভাষ্য অনুযায়ী বিকল্প ভাষা বা দ্বিতীয় ভাষা আসলে কম্পিউটার ভাষা, কিন্তু আমাদের মতো প্রবীণ ও মেধাহীনদের হাতে যে সামান্য সময় আছে তাতে আমি অন্তত এসব শেখার চেষ্টা আর করবো না, নিজের সমাজবিজ্ঞানের যে সামান্য কাজ বাকী আর আত্মার আনন্দের বিষয় সাহিত্য বা শিল্পের যে শাখাগুলো নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে আমি শুধু তাই করবো। এ আই এবং কম্পিউটার জগৎ নিয়ে রাব্বী যখন আমাদের হাজারটা বিষয় বোঝাচ্ছিলেন তখন আদনান সৈয়দ, জান্নাত সৈকতের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করে আদনান অনেক কিছু জেনে নিচ্ছিলেন। আদনান প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় অনুশীলন করতে চান। রাব্বী এসব বিষয় অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছিলেন আদনান ও বদরুনকে। আমার কাছে বিষয়টা একেবারেই ল্যাটিন ভাষার মতো। কিন্তু বদরুন দেখলাম কম্পিউটার ও এ আই- এর অনেক কিছুই জানেন। জিজ্ঞেস করলে জানালেন তিনি এদেশে এসে কম্পিউটার পেশা নিতে অনেকটা শিখেছিলেন কোর্স নিয়ে, কিন্তু চাকুরী নিতে গিয়ে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন নিজের লেখালেখির জন্য। সেটা হলো কম্পিউটার পেশায় গেলে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই লাভবান হতেন, কিন্তু এতে তাঁর লেখার ইচ্ছেটা মরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, তাই শেষে তিনি সিটির কেরানিগিরি বা আমলাতন্ত্রের পেশায় চলে গেছেন যাতে তাঁর লেখার অঢেল সময় থাকে! বিষয়টা আমার তরুণ বয়সের কথা মনে করিয়ে দিলো, আমি জীবনের শুরুর দিকে বিপুল অর্থবান হওয়া যায় এমন পেশা থেকে বা ‘প্রতাপের’ জগৎ থেকে নিজেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার সব সময় মনে হয়েছে আমি সারাজীবন একা থাকবো এবং অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যের জীবন বেছে নেবো, যাতে নৈতিকতার কোন স্খলন যেন আমাকে স্পর্শ করতে না পারে। জীবনে মরাল ও এথিক্যাল স্ট্যান্ডিং বজায় রাখতে হলে পেশা নির্বাচনে শুরুতেই নিজেকে চাবুকের নীচে রাখতে হয়, কেন জানি না বাবা আমাকে ছাত্রজীবনে এটা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতেন। ঢাকার ছাত্রজীবনে টুইশানি, ফ্রিলেন্সিং সাংবাদিকতা, সামান্য কিছুদিনের আমলাতন্ত্র ইত্যাদি দেখেটেখে শেষ অবধি আমি এদেশে দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশুনা শেষ করে আমার প্রিয়তম পেশা অধ্যাপনায় ফিরে যেতে পেরেছিলাম বছর পঁচিশেক আগে। সারাটা জীবন খুব দরিদ্র জীবন কাটালেও এটা ভেবে আমার মনটা কিছুটা স্বস্তি পায় আমি পছন্দের পেশায় ফিরতে পেরেছিলাম। আমার বাবা আমাকে বলতেন জীবনে নিজের পছন্দের পেশায় না থাকতে পারলে কষ্ট পাবে, কারণ তাতে মনের প্রশান্তি ক্ষয়ে যায়! আড্ডায় তুমুল কথাবার্তার মাঝে আমি একটু আনমনা হয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম। বদরুন নিজের লেখার জন্য বেশি অর্থকড়ির পেশায় যান নি শুধু লেখার জন্য, এটা শুনে খুব ভালো লাগলো!
এরপর শুরু হলো আমাদের নিজেদের লেখা পাঠ। দুজন শক্তিশালী কথাশিল্পী বদরুন নাহার ও স্বপন বিশ্বাস, প্রাবন্ধিক আদনান সৈয়দ, আহমাদ মাযহার, নসরত শাহ, কবি শামস আল মমীন ভাই ও এবিএম সালেহউদ্দীন, সবাই চাইলে লেখা পড়তে পারেন। কিন্তু এ আড্ডায় স্বপন তাঁর নিজের লেখা রাজনৈতিক সেটারিক ছড়া পড়লেন, অভীক নিজের লেখা অসাধারণ একটি কবিতা শোনাতে দিলেন বদরুনকে তাঁর চোখের অবস্থা ভালো নয় বলে। অনেক বছর আগে লেখা অভীকের অত্যন্ত শক্তিশালী এই কবিতাটি শুনে মুগ্ধ হলাম। এরপর বদরুনকে আমরা অনুরোধ করলাম গল্প পড়তে, কিন্তু আদনান রসিকতা করে জিজ্ঞেস করলেন বদরুন যেন দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত গল্প পড়েন, কারণ লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর সব গল্প বেশ দীর্ঘ। আমরা সত্যিই এই ‘প্রথম আলো’র কথাশিল্পীদের শব্দসীমা বেঁধে দেয়ার বিষয়টি মনে করে কৌতুক বোধ করলাম। হায় দৈনিকের সাময়িকী! তুমি সাহিত্যকে তোমার ছাঁচে ফেলে অর্ডারি বস্তুতে পর্যবসিত করছো নাতো! বদরুন ছোট, অর্থাৎ খুব বেশি দীর্ঘ নয় এমন গল্প তাঁর টেলিফোনে খুঁজে না পেয়ে আমাদের সুন্দর একটা কবিতা শোনালেন। বদরুনের কবিতাও সত্যিই খুব সুন্দর।
রাত গভীর হচ্ছিলো, নসরতকে বহুদূর যেতে হবে অন্য স্টেটে, বদরুন ও অভীকের বাড়ি ফিরতে হয় মধ্যরাতের দিকে, তাই আমি, আদনান, মমিন ভাই ও মাযহার বসে কবিতা নিয়েই দীর্ঘ আড্ডায় মেতে রইলাম বাকীরা বিদায় নেয়ার পর। আমাদের তক্কাতক্কির বিষয় ছিলো কলকাতার অসাধারণ লিটল ম্যাগাজিনগুলো, বা আজকের ঢাকার পত্রিকা ও সাহিত্যের অবস্থা! কথায় কথায় ‘এক্ষণ’ সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য ও ‘অনুসটুপ’ সম্পাদক অধ্যাপক অনিল আচার্যের কথা উঠলো। বছর তিরিশেক আগে অনিলদা বইমেলায় নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে আমাদের আড্ডা হয়েছে, কিন্তু নিউইয়র্কের কয়েকটি দিন, কবি সৈয়দ শহীদের ‘অনন্যা’য় যে বিরামহীন আড্ডা হয়েছিলো, আদনানকে তিনি ভালোবেসে একাধিক বই উপহার দিয়েছিলেন সেসব কথা মনে করে আমরা কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম। সম্পাদক অনিল আচার্যসহ কলকাতার লেখক বুদ্ধিজীবীদের অনেকের সঙ্গেই আমাদের নিউ ইয়র্কে যে গভীর ভালোবাসা-জড়ানো দিনগুলো আড্ডায় কেটেছে তার কোন তুলনা নেই। কে কেমন সম্পাদক বা সৃষ্টিশীল লেখক তার বিচার সময় করবে নিশ্চয়, কিন্তু কলকাতার অনেক লেখক সম্পাদকরা মানুষ হিশেবে যে আমাদের স্মৃতিতে দাগ কেটে গেছেন দীর্ঘদিন ধরে, তা ভোলা সত্যিই কঠিন।
আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি তারাপদ রায়, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মীনাক্ষী দত্ত ও কবি জ্যোতির্ময় দত্তসহ অনেকেই, তাঁদের কাছ থেকে আমরা এ আড্ডার অনেকেই গভীর স্নেহ লাভ করেছি, কিন্তু দীর্ঘ আড্ডার মধ্য দিয়েই তাঁদের লেখার মতোই তাঁদের অন্তরকে আমরা চিনেছি একটু ভিন্নভাবে।
এছাড়া গত বছর তিনেক ধরে আমি একবারে ঘোর আচ্ছন্ন হয়ে একাধিকবার পড়ে চলেছি অধ্যাপক চিন্ময় গুহর লেখা বিভিন্ন বই। অনেকদিন আমি এমন শক্তিশালী দর্শনাশ্রয়ী সৃজনশীল লেখা পড়ি নি। আজকের সময়ে তাঁর মানের লেখা কম দেখা যায় বাংলা বা বিদেশি কোন ভাষায়। মাস কয়েক আগে আমরা এই আড্ডার কয়েকজন একটি দিন কাটিয়েছি অধ্যাপক চিন্ময় গুহর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে নিউ ইয়র্কে, সেই স্মৃতি সত্যিই ভোলা যাবে না।
আদনান সৈয়দ ও আহমাদ মাযহার অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়, অধ্যাপক অম্লান দত্ত, অধ্যাপক চিন্ময় গুহ, লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্যসহ বাংলা ভাষার এসব বড় লেখক ও বড় মানুষদের নিয়েই অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন এদিনের আড্ডায়। তাঁদের লেখা নিয়েও বিস্তারিত কথা বললেন। এসব শুনে কেন জানি না আমাদের মন খুব ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো!
সবাই বাড়ি ফিরে গেলেন, আমি থালাবাটি গেলাস ধুয়ে টুয়ে লেখার টেবিলে বসলাম, গত কয়েক দশক ধরে এসব মানুষদের সঙ্গে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেলো!
জানুয়ারি ৪, ২০২৫