এইচ বি রিতা
অমর একুশে বইমেলা বাঙালির সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার এক অনন্য দ্যোতক। এটি জ্ঞান, মননশীলতা, সৃজনশীলতা, মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রতিফলন। ভাষা আন্দোলনের চেতনা ধারণ করে এই বইমেলা প্রতি বছর নতুন নতুন লেখকের আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করে।
প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এই মেলা লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় যেখানে দেশ-বিদেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহাকে বইমেলার প্রারম্ভক বলা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বিক্রি শুরু করেন শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। গণমাধ্যম তথ্যসূত্রে মূলত ১৯৭৮ সালে বইমেলার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। আশির দশকে প্রকাশকদের কাছ থেকে বইমেলা বাংলা একাডেমির হাতে চলে গেলে ১৯৮৩ সালে বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘একুশের গ্রন্থমেলা’। সে বছর স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের কারণে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৮৪ সালে পূর্ণোদ্যমে ‘একুশের গ্রন্থমেলা’ শুরু হয় আবার। এরপর থেকে এটি জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
তবে জানা যায়, এর আগে, এ দেশে বইমেলার চিন্তাটি প্রথমে মাথায় আনেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি একসময় বাংলা একাডেমিতেও চাকরি করেছেন এবং বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদেও ছিলেন। সেসময়ে তিনি ইউনেসকোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাই করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। এরপরে তিনি ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সে সব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম।
সেই থেকে চলমান বইমেলা। ফেব্রুয়ারি মাস মানেই যেন লেখক প্রকাশকদের নির্ঘুম রাত। এ মাসে প্রকাশিত হয় হাজার হাজার বই। নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে মোহিত হয় মেলায় আসা ক্রেতা, দর্শনার্থী। বিক্রি হয় লাখ লাখ কপি বই। আজকের তরুণরাও ঊর্ধ্বমুখী। তারা আত্মপ্রকাশে সাহসী, উদ্যমী এবং সৃজনশীল। নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করছে। বইমেলা তাই তরুণ লেখকদের জন্য আত্মপ্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চও। এখানে নবীন ও প্রবীণ লেখকদের বই প্রকাশিত হচ্ছে, পাঠকদের সাথে সরাসরি সংযোগ ঘটছে। প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের একত্রিত করে বইমেলা এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে পাঠকরা সরাসরি লেখকদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করতে পারে এবং তাঁদের মতামত আদান-প্রদান করতে পারেন।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির প্রসারের কারণে পাঠাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে, তবে একুশে বইমেলা এখনো পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। মেলার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সংযোজনের ফলে অনলাইনেও বই কেনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে মেলার মূল আকর্ষণ এখনো রয়ে গেছে বইয়ের গন্ধ, পাঠকের উচ্ছ্বাস এবং লেখক-পাঠকের সরাসরি মিথস্ক্রিয়ায়।
তবে বইমেলার কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। গত ৫১ বছরে বইমেলা কেবল উৎসবের আনন্দে সীমাবদ্ধ ছিল না; এর সঙ্গে নানা বিতর্ক, সংঘর্ষ, বই বা প্রকাশক নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনাও কম ঘটেনি। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার থাকা সত্ত্বেও, কখনো কখনো সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা আদর্শগত কারণেই কিছু বই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, আবার কখনো বই প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছে। এসব চ্যালেঞ্জ বইমেলার মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার পরিবেশে প্রভাব ফেলেছে যা, সাহিত্য ও প্রকাশনার স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অন্যদিকে, বইমেলাকে আমরা সত্যিকারার্থে 'বইমেলা'য় পরিণত করব, নাকি 'বই মেলা'র দিকে ঠেলে দেব- সেটা নিয়েও জোরদার আলাপ ও তর্কচর্চা প্রাসঙ্গিগ হয়ে উঠেছে।
বইমেলার মূল চেতনা, বিশেষ করে একুশের চেতনার যথাযথ প্রতিফলন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বইমেলা কেবল বই বিক্রির একটি উৎসবে পরিণত হচ্ছে, নাকি এটি প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার আদান-প্রদান এবং ভাষা আন্দোলনের চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে টিকে থাকবে—এটি গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়। বইমেলা কি সত্যিই জ্ঞান, মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠছে, নাকি এটি শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত একটি ইভেন্ট হয়ে যাচ্ছে-এমন প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। কারণ বইমেলার দর্শনগত ভিত্তি ও কার্যকারিতা নিয়ে নানা সময়ে বিতর্ক হয়েছে।
প্রতি বছর অন্তত তিন থেকে চার হাজার বই প্রকাশিত হয়, যদিও বাংলা একাডেমির কাছে নির্ভরযোগ্য সম্পূর্ণ তালিকা না থাকায় প্রকৃত সংখ্যা অজানা। কেউ কেউ মনে করেন, সংখ্যাটি পাঁচ হাজারের কাছাকাছি হতে পারে, তবে তিন হাজারের কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমাদের কি সত্যিই তিন হাজার লেখক আছেন?
এখন পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, যদি প্রকৃত তিন চার হাজার লেখক না থাকেন, তবে যারা প্রতি বছর তিন থেকে চার হাজার বই প্রকাশ করছেন, তারা কারা?
এখানে দুটি দিক বিবেচনা করা যেতে পারে—একটি হলো প্রকৃত অর্থে লেখক, যারা সাহিত্য বা গবেষণাকে নৈপুণ্যের স্তরে নিয়ে যান, এবং অন্যটি হলো বই প্রকাশ করা ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে লেখালেখি করেন। বই প্রকাশের এই বিপুল সংখ্যা অনেকাংশে নতুন বা শখের লেখকদের হাত ধরে আসছে, যাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ভবিষ্যতে ভালো লেখক হয়ে উঠবেন, আবার অনেকেই কেবল নিজের নামের পাশে 'লেখক' তকমা বসানোর জন্য বই প্রকাশ করছেন।
অনেক সময় বই প্রকাশ ব্যক্তিগত তৃপ্তি, সামাজিক মর্যাদা, বা প্রচারের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ফলে বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও প্রকৃত সাহিত্য বা গবেষণার মানোন্নয়ন কতটা হচ্ছে, সেটাই মূল প্রশ্ন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—পেশাদার লেখকের সংখ্যা কত? এমন কতজন লেখক আছেন, যারা শুধুমাত্র লেখালেখির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন? বাস্তবতা হলো, এর সংখ্যা নগণ্য—একজনও নেই বললে ভুল হবে না। হাতে গোনা কয়েকজনের নাম শোনা গেলেও, তাদের খুঁজে পেতে যেন আতশীকাচ দরকার। আর যারা 'পেশাদার লেখক' হিসেবে পরিচিত, তাদের কেউ কেউ হয়তো বিভিন্ন সুবিধা ও সহযোগিতার উপর নির্ভর করেই এই পরিচয় ধরে রেখেছেন।
অমর একুশে বইমেলা বাঙালির সংস্কৃতি, মননশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সুযোগ, এর মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানচর্চা, সৃজনশীলতা ও মুক্তচিন্তার প্রসার হওয়া উচিত। কিন্তু বইমেলার বর্তমান প্রবণতা কি সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে? বইয়ের সংখ্যাধিক্য, মানের প্রশ্ন, বাণিজ্যিকীকরণ ও লেখালেখির প্রকৃত উদ্দেশ্য—এসব দিক বিবেচনায়, বইমেলা কি সত্যিই বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, নাকি বাণিজ্যিক লাভের একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে? বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর মান কেমন? আমরা কি সত্যিকার অর্থে সাহিত্যচর্চার চেতনায় বই প্রকাশ করছি, প্রতি বছর যদি বইমেলায় তিন থেকে পাঁচ হাজার বই প্রকাশিত হয় তবে এতো বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশের পেছনে কত সংখ্যক প্রকৃত লেখকের উপস্থিতি রয়েছে?
ফরাসি দার্শনিক রঁলোন বাহতা তার 'The Death of the Author (1967)' -এ বলেছেন, 'পাঠকের জন্ম হতে হলে লেখকের মৃত্যু অপরিহার্য' অর্থাৎ লেখকের মৃত্যু ঘটে তখনই, যখন লেখালেখি চিন্তা ও অভিজ্ঞতার বাইরে চলে যায়।বর্তমান বইমেলার দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক প্রকাশক শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বই প্রকাশ করছেন, যেখানে সাহিত্যিক মান, ভাষার শুদ্ধতা ও চিন্তার গভীরতা অনুপস্থিত। অনেক বইতে বানান ভুল, ভাষাগত ত্রুটি ও অসংলগ্ন বাক্য গিজগিজ করে।
লেভ টলস্টয় বলেছেন, 'শিল্প হস্তশিল্প নয়, এটি শিল্পীর অভিজ্ঞতার সঞ্চারণ।' অর্থাৎ শিল্প কেবল দক্ষতা বা কারিগরি নৈপুণ্যের ফল নয়; বরং এটি শিল্পীর অনুভূতি, অভিজ্ঞতা এবং ভাবনার গভীর প্রকাশ। প্রকৃত সাহিত্য তখনই শক্তিশালী হয়, যখন তা পাঠকের মনে লেখকের অভিজ্ঞতা ও ভাবনাকে সঞ্চারিত করতে পারে।
কিন্তু আমাদের বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, 'কিছু কিছু' ক্ষেত্রে সাহিত্যের প্রকৃত রূপ অনুপস্থিত। বিশেষ করে নতুন লেখকদের অনেক বইতে মৌলিক চিন্তার অভাব প্রকট। সমাজ, দর্শন, রাজনীতি, ইতিহাস কিংবা মনস্তত্ত্বের গভীর বিশ্লেষণ ছাড়াই, অনেক সময় অপরিণত, অগভীর এবং অসংলগ্ন চিন্তাকে বই হিসেবে প্রকাশ করা হচ্ছে। ফলে এসব বই শিল্পের প্রকৃত রূপ ধারণ করতে পারছে না, বরং সাহিত্যিক মানের অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।
জ্যাঁ-পল সার্ত্র যখন বলেন, 'সাহিত্য নির্দোষ নয়। এটি দোষী এবং তা স্বীকার করা উচিত,' তিনি বোঝাতে চান যে সাহিত্য কেবল নিরপেক্ষ বিনোদন নয়; এটি একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা সমাজকে প্রভাবিত করে, বাস্তবতাকে বদলে দিতে পারে এবং কখনো কখনো নিপীড়ন বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বা এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। সাহিত্যের এই দায় স্বীকার করাই লেখকের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক লেখকই সে দায় স্বীকার করেন না, বরং অনেক সময় বাস্তবতা থেকে পালানোর চেষ্টা করা হয়, সাহিত্যকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ২০২৪ সালের জুলাই গণহত্যা, যখন রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটলেও অনেক লেখক চুপ ছিলেন। তারা নিজেদের নিরাপত্তা, প্রতিষ্ঠিত পরিচিতি বা সুবিধার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন, ফলে তারা সাহস করে সত্য উচ্চারণ করতে পারেননি।
'অর্থডক্সির পরিবেশ সর্বদাই গদ্যের জন্য ক্ষতিকর, এবং সর্বোপরি, এটি উপন্যাসের জন্য সম্পূর্ণ বিধ্বংসী—যা সাহিত্যিক রূপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অরাজক,'- জর্জ অরওয়েল তাঁর প্রবন্ধ "The Prevention of Literature" (১৯৪৬)-এ এমনটাই বলেছেন।
অরওয়েল যে সাহিত্যকে মতাদর্শিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন, আজকের 'অনেক' লেখক ঠিক তার বিপরীত অবস্থানে রয়েছেন। লেখকের প্রধান দায়িত্ব হলো সমাজের অসঙ্গতি ও সত্যকে নির্ভয়ে তুলে ধরা। অথচ অনেক লেখক এখন রাষ্ট্র, প্রকাশক বা গোষ্ঠীগত চাপের কারণে স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ মেনে নিচ্ছেন, অনেক লেখক সাহসী সত্য উচ্চারণের পরিবর্তে জনপ্রিয় বা প্রতিষ্ঠিত মতবাদ অনুসরণ করেন, যা প্রকৃত সাহিত্যের স্বাধীনচিন্তার পরিপন্থী। অরওয়েল বিশ্বাস করতেন, উপন্যাস হলো সাহিত্যের সবচেয়ে স্বাধীন রূপ, যেখানে সত্যকে কঠোর বাস্তবতার আলোকে তুলে ধরা যায়। কিন্তু আজকের 'অনেকে' সেই স্বাধীনতার পথে হাঁটার পরিবর্তে মতাদর্শিক, বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক সুবিধার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, যা সাহিত্যের প্রকৃত শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
তবে ভালো মানের বই যে প্রকাশ হচ্ছে না তা নয়। অনেক লেখক আছেন, যারা গভীর গবেষণা, বিশ্লেষণ ও সাহিত্যিক দক্ষতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ও চিন্তাশীল রচনা উপহার দিচ্ছেন। তবে এসব বইয়ের প্রচার ও পাঠকের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম যা দুঃখজনক।
পাঠকদের অনেকেই হালকা বিনোদনমূলক বা জনপ্রিয় ধারার বইয়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন, ফলে গভীর চিন্তাশীল ও গবেষণাধর্মী বইগুলোর চাহিদা তুলনামূলক কম থাকে। আবার অনেক প্রকাশক সহজেই বিক্রিযোগ্য বই প্রকাশে আগ্রহী থাকেন, ফলে উচ্চমানের কিন্তু জটিল বা গভীর বিষয়বস্তুর বই প্রকাশের ঝুঁকি কম নিতে চান। কিছু লেখক আছেন যারা পাঠকের কাছে তাদের বইটি যথাযথভাবে পৌঁছানোর জন্য কার্যকর বিপণন বা প্রচার-প্রচারণা করতে পারেন না, যার ফলে এসব বই পাঠকসমাজে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে না। তাছাড়া, দ্রুতগতির ডিজিটাল যুগে পাঠকদের মধ্যে দীর্ঘ, গভীরভাবে ভাবনার উদ্রেককারী বই পড়ার ধৈর্য কমে যাচ্ছে। ফলে অনেকেই সহজ ও হালকা বিষয়ের দিকে ঝুঁকছেন। আরো দুঃখজনক বিষয়টি হলো, ভালো বই নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা বা সাহিত্য সমালোচনার সুযোগ কমে যাচ্ছে, যার ফলে এসব বই পাঠকের কাছে অনেক সময় সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না।
মূলত, যে বই পাঠককে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে, তাকে ভাবতে বাধ্য করতে পারে, তার মানসিক পরিধিকে সম্প্রসারিত করতে পারে, সেটাই ভালো বই। একটি ভালো বইয়ের ভাষা শৈল্পিক হলেও অপ্রয়োজনীয় জটিলতা বা বাহুল্য থাকে না। ভালো বইয়ের বিষয়বস্তু সময়ের সীমানা পেরিয়ে দীর্ঘমেয়াদে প্রাসঙ্গিক থাকে। এটি শুধু বর্তমান সময়ের সমস্যা নয়, বরং মানুষের সার্বজনীন অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটায়। একটি ভালো বই শুধু পুরনো চিন্তার পুনরাবৃত্তি করে না; বরং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে। লেখকের নিজস্ব স্বতন্ত্রতা এবং মৌলিক চিন্তা এতে প্রতিফলিত হয়। গল্প, কবিতা, উপন্যাস বা প্রবন্ধ—যে ধরনের বইই হোক না কেন, একটি ভালো বইতে নান্দনিক মান থাকে যা পাঠকের সাহিত্যরস ও মানসিক গভীরতা সমৃদ্ধ করে। সাহিত্য হলো সমাজের দর্পণ। ভালো বই পাঠককে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির গভীর বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত করায় এবং তাকে সচেতন করে তোলে। শুধু ভাষার কারুকাজ নয়, বরং চিন্তার স্বকীয়তা, বক্তব্যের স্বচ্ছতা, এবং অন্তর্নিহিত গভীরতা মিলেই তৈরি হয় প্রকৃত বই।
আমরা জানি, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে প্রকাশকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, এবং তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ভালো বই প্রকাশ করা। কিন্তু সাহিত্য যখন শুধুমাত্র ব্যবসায় পরিণত হয়, তখন তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। বর্তমান সময়ে বইমেলায় কিছু প্রকাশক এমন লেখকদের বই ছাপাচ্ছেন, যারা হয়তো লেখালেখির মৌলিক ধারণাই বোঝেন না, কেবলমাত্র জনপ্রিয়তা বা আত্মপ্রচারের জন্য বই প্রকাশ করছেন। ফলে বইমেলায় ভালো বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে মানসম্মত প্রকাশনা ও প্রকৃত প্রতিভার মূল্যায়ন জরুরি। নাহলে একসময় বইমেলা শুধুই একটি বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে, যেখানে প্রকৃত সাহিত্য ও মননশীল লেখকদের জন্য কোনো জায়গা থাকবে না। তাই লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের দায়িত্ব হলো ভালো বই নির্বাচন করা, প্রকৃত সাহিত্যকে এগিয়ে নেওয়া এবং বইমেলাকে শুধু বই বিক্রির আয়োজন না বানিয়ে সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
আমেরিকান সাইন্স ফিকশন লেখক অক্টাভিয়া ই. বাটলার এর একটি পরামর্শমূলক উক্তি দিয়েই শেষ করছি, 'আপনি শুরুতেই ভালো লেখা লিখতে পারবেন না। আপনি বাজে লেখা দিয়ে শুরু করেন এবং ভাবেন যে তা ভালো। এরপর ধীরে ধীরে আপনি উন্নতি করতে থাকেন। এ কারণেই আমি বলি, অধ্যবসায় হলো সবচেয়ে মূল্যবান গুণগুলোর একটি'
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2025 RED TIMES. All rights reserved.