লুৎফর রহমান রিটন
মামলার নাম ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং।'
সংশোধিত নাম 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।'
আসামী সংখ্যা ৩৫। ১নম্বর আসামী শেখ মুজিব।
ওদিকে শেখ মুজিব বন্দী ছিলেন জেলখানায়, তাঁর ৩৪ সহযোদ্ধার সঙ্গে।
আর এদিকে 'জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো' বলে শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করছি আমরা পুরো পাকিস্তানকে। পূর্ব এবং পশ্চিম।
টালমাটাল পূর্ব পাকিস্তান।
তীব্র আন্দোলন ক্রমেই তীব্রতর।
পরাভূত সোকল্ড লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইউব খান।
অতঃপর মুক্তি পেয়েছেন বাংলা ও বাঙালির মুক্তিসনদ 'ছয় দফা'র প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান।
অতঃপর তাঁকে আমরা ভালোবেসে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধীতে ভূষিত করেছি।
শৃঙ্খলিত বাংলা ও বাঙালির মুক্তিদূতকে তো বঙ্গবন্ধু সম্বোধনেই ডাকতে হবে।
তিনি আমাদের 'বঙ্গবন্ধু' হলেন।
তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখালেন।
একটি দেশের স্বপ্ন।
একটি পতাকার স্বপ্ন।
একটি মানচিত্রের স্বপ্ন।
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে স্তোত্রপাঠের মতো করে মন্ত্রোচ্চারণ করলেন তিনি--
'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঊর্মিমুখর একটি অকূল সমুদ্রের সামনে
তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে বললেন--'রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো।'
আমরা রক্ত দিলাম।
আমাদের তিরিশ লক্ষ শহিদের বুকের তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠলো সমুদ্রটা।
বাংলার আকাশ-বাতাস-মৃত্তিকা-পাহাড়-বৃক্ষ-নদী-পাখি-ফুল-প্রকৃতি
কোরাস গাইলো--'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা, আমরা তোমাদের ভুলবো না।'
কিন্তু আমরা তাঁদের ভুলে গেলাম।
আমরা স্মৃতিভ্রষ্ট হলাম।
আমরা কুলাঙ্গার ভুলে গেলাম আমাদের বঙ্গবন্ধুকে।
আমরা কুলাঙ্গার হত্যা করলাম আমাদের জাতির জনককে।
ছবি হয়ে গেলেন আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
অতঃপর একদিন তাঁকে আমরা স্থাপন করলাম দেয়ালে দেয়ালে, মনের খেয়ালে।
ফ্রেমবন্দী হয়ে গেলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু......।
বঙ্গবন্ধু উৎকীর্ণ ছিলেন ছবির ফ্রেমে।
আমরা তাতে ফুলের মালা পরিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছি।
তারপর একদিন কাগজের নোটে মুদ্রিত হয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু।
অতঃপর তাঁকে আমরা পকেটে পুড়েছি।
অতঃপর মুদ্রিত সেই নোটের লোভ আর মোহের কাছে পরাজিত হতে হতে
আমরা কুলাঙ্গার কল্পনাতীত কুলাঙ্গার হয়ে উঠি দিন দিন।
অবলীলায় আমরা ভুলে যাই আমাদের বঙ্গবন্ধুকে।
আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হয় বুকের মধ্যে।
আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হয় করোটির ভেতরে।
আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে লালন করতে হয় প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের চিন্তায় চেতনায় মননে ও মেধায়।
বিস্মৃতির গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতে
উন্মত্ত নেশাতুর আমরা কেবলই সংগ্রহ করি কাগজের নোটে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুকে।
কেবলই সংগ্রহ করি
কেবলই সংগ্রহ করি......।
আমাদের লিকলিকে ক্ষীণ ওয়ালেট-মানিব্যাগ ফুলে ওঠে পোটকা মাছের পেটের মতো।
দুধের ফেনার মতো উপচে পড়ে আমাদের ড্রয়ার-আলমিরা।
আমাদের বিছানার জাজিমের ভেতরে থরে থরে সাজানো থাকে কাড়িকাড়ি নোট।
কাগজের নোটে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা লুকিয়ে রাখি বালিশের তুলোর ভেতরে।
আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আপনি আমাদের জন্যে এনে দিয়েছিলেন 'স্বাধীনতা' ।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আপনি আমাদের জন্যে নির্মাণ করেছিলেন আলাদা ভূখণ্ড।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--রক্ত আর জীবনের সুঁই-সুতোয় সেলাই করে দিয়েছিলেন আপনি লাল সবুজের অপরূপ একটি পতাকা।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মোহরের অধিক মোহর নিজস্ব মুদ্রা।
সেই মুদ্রায় হেসে উঠেছে বাংলা ভাষার অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণমালাসমূহ।
কিন্তু সেই বর্ণমালাকে উপেক্ষা করি,অবজ্ঞা করি আমরা!
আপনার দেয়া মোহরগুলোকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে দিই বরফের দেশে!
অপমান করি পতাকাকে!
পতাকার অপমানে কেঁদে ওঠে মৃত্তিকায় মিশে থাকা তিরিশ লক্ষ শহিদের আত্মা।
আপনার অর্জিত 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'কে ইজারা দিই শত্রুর কাছে!
এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র অনেক দাম দিয়ে কেনা 'স্বাধীনতা'কে বিক্রি করে দিই নামমাত্র মূল্যে!
আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু।
আপনি কি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু?
[ বঙ্গবন্ধুর ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী মাসুক হেলাল ]
রচনাকাল: অটোয়া ২৭ মে ২০২০
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2025 RED TIMES. All rights reserved.