আজ রবিবার, ৩০শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বীর সন্তানদের স্মরণ

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৬, ২০২৫, ০৬:১৯ অপরাহ্ণ
শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বীর সন্তানদের স্মরণ

Sharing is caring!

টাইমস নিউজ

শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করা হলো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতার লড়াই।

আর সেই লড়াইয়ে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যেসব শহিদ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’র আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেসব বীর সেনানীকে বিনম্রচিত্তে স্মরণ করেছে জাতি।

বুধবার ছিল ৫৫তম মহান স্বাধীনতা দিবস। এটি গৌরবময় জাতীয় দিবসও। দিনটি উপলক্ষ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সর্বস্তরের মানুষ। ভোর থেকেই দলে দলে ফুল, ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধে আসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহিদবেদি। এ সময় অনেকের পরনে ছিল লাল-সবুজের পোশাক।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সকাল ৬টা ১১ মিনিটে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাতির বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর শহিদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকশ দল তাকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর।

এরপর শ্রদ্ধা জানান বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। শ্রদ্ধা জানান উপদেষ্টামণ্ডলী ও বিদেশি কূটনীতিকরাও। সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি এসএম এমদাদুল হক, বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জাতীয় স্বার্থে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা ঐকমত্য পোষণ করব। কিন্তু একেকজন মানুষের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। সেসব দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলো কমিয়ে আনতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। একটা সরকারের জন্য গতানুগতিক কিছু চ্যালেঞ্জ থাকেই। তবে এখন একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য গড়ার। সেটা অবশ্যই একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এটাকে চ্যালেঞ্জ বলেন আর না বলেন, একটা প্রক্রিয়া তো বটেই। আমাদের জন্য ওটাতে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াকে একটা বড় বিষয় বলে আমি মনে করি। আরেকটা হচ্ছে, নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে করে দেওয়া, জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা।

রাজনৈতিক দলগুলো সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের অনেকের চেয়ে তারা আরও অনেক বেশি অভিজ্ঞ। ফলে আমি মনে করি জনগণকে আস্থায় যদি আনতে হয়, তাহলে যে সংস্কারগুলোর দাবি জনগণের ক্ষেত্রে ওঠে, সেগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যে না পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। সব সময় জনগণের মতামতের সঙ্গেই আছি। আমরা তাদের জন্যই কাজ করছি।

এ সময় স্বাধীন ভূখণ্ডে এ দেশের মানুষ আর পরাধীন বোধ করবে না বলে মন্তব্য করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ৭১-এ দেশকে জন্ম দিয়েছে, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা। কিন্তু বিগত ১৬ বছরে স্বাধীনতার যে কনসেপ্ট সেটাকে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। আমরা মনে করি, দেশের প্রত্যেকটা নাগরিক যতক্ষণ না মনে করবে সে স্বাধীন, তার বাকস্বাধীনতা আছে, তার ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভূখণ্ড স্বাধীন হয়ে কোনো লাভ নেই। আমরা মনে করি, ’২৪ সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করেছে। এই স্বাধীনতা সামনের দিনগুলোতেও থাকবে। আর কখনোই একটি স্বাধীন ভ‚খণ্ডে এ দেশের মানুষ আর পরাধীনতাবোধ করবে না।

বিএনপির শ্রদ্ধা নিবেদন : সকাল আটটার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিএনপির নেতারা। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ইরফান ইবনে আমান, ঢাকা জেলা যুবদলের সভাপতি ইয়াছিন ফেরদৌস মুরাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে বাংলাদেশে কিছু নেই’ মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সাংবাদিকদের বলেন, যারা আজকের স্বাধীনতা দিবসকে খাটো করতে চান, একাত্তরের স্বাধীনতায় তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সুতরাং এই দিনটাকে তারা খাটো করতে চান। আমি বলব, তারা যেন এখানেই বিরত থাকেন। এই স্বাধীনতা দিবসকে যেন সম্মান জানান এবং সম্মান করেন। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন করে স্বৈরাচারকে তাড়িয়ে স্বাধীনতার নতুন স্বাদ পেয়েছি। অনেকে বলেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা। আসলে আজকের স্বাধীনতা দিবস প্রমাণ করে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে বাংলাদেশে কিছু নেই।

তিনি বলেন, প্রত্যেকটা দলের নিজস্ব আদর্শিক জায়গা ও মতাদর্শ আছে। সবাই যার যার মতাদর্শ থেকে কথা বলে। এটাকে আমি অনৈক্য বলব না। তবে দলগুলোর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত আছে। যদি কখনো এমন সময় আসে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন, তখন কিন্তু আমরা সবাই এক হয়ে যাব। এখানে কোনো ভুল নেই। এখন দলীয় আদর্শিক স্বার্থে হয়তো আলাদা কথা বলছি। কিন্তু যখন জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হবে, তখন বাংলাদেশের জনগণ এক হয়ে যাবে।

মির্জা আব্বাস বলেন, আজকে স্মরণ করছি স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, অতঃপর দেশে থেকে যুদ্ধ করে তিনি দেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ মাঝে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। গত ৫ আগস্টের পর আবার নতুন করে পেয়েছি। আমি ৭১-এর বীর শহিদ যারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করে দিয়েছিলেন, রক্তের বিনিময়ে যারা স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাদের স্মরণ করছি। তাদের পরিবারের যারা এখনো বেঁচে আছেন, তাদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। আজকের এই দিনে দেশবাসীকে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া, আমাদের নেতা তারেক রহমানের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। আমরা সেখানেই বিশ্বাস রাখতে চাই। এখানে আমরা বিশ্বাসের পরিবর্তন করতে চাই না।

জাতীয় নাগরিক পার্টির শ্রদ্ধা : সকাল সাড়ে আটটার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন দিলে মেনে নেওয়া হবে না মন্তব্য করে এসসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমাদের জাতীয় নাগরিক পার্টির যে দাবি বিচার ও সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচন। আমরা মনে করি সেই পথে গেলেই জাতির একটি উত্তরণ ঘটবে গণতন্ত্রের পথে। সংস্কার এবং বিচারবিহীন যদি নির্বাচন দেওয়া হয় এবং কোনো একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যই নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হয় সংস্কার ছাড়া, তাহলে তা অবশ্যই মেনে নেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, ন্যায়বিচারের জন্য। এরই ধারাবাহিকতা ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান। আমরা মনে করি, আমাদের একটি স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এবং বারবার এটা বেহাত হয়েছে এবং বারবার রক্ত দিতে হয়েছে জনগণকে। আমাদের যাতে সামনের দিনগুলোতে আর রক্ত না দিতে হয়, জনগণের এই প্রত্যাশা আমাদের আজকের দিনে। আমাদের যে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করেছি যুগ যুগ ধরে এবং ২০২৪ সালেও আমাদের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করতে হয়েছে।

নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, আমরা মনে করি, ৭১ এবং ২৪ আলাদা কিছু নয়, বরং ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই ৭১-এর যে স্পিরিট সেটা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেটা ৫৪ বছরে অর্জিত হতে পারেনি বিধায় একটা ফ্যাসিজম ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে চেপে বসেছিল। ফলে ৭১-এ যে সাম্যের কথা বলা হয়েছিল ২৪-এ কিন্তু আমরা সেই বৈষম্যহীন সমাজের কথাই বলেছি। ফলে যারা এটাকে পরস্পরবিরোধী বা মুখোমুখি করে দাঁড় করাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য অসৎ এবং আমরা মনে করি ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকে, ছাত্র-জনতার বিজয়কে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি।

তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পুরোনো সংবিধান আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা মনে করি ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং আমাদের যে ৭১-এর সংগ্রাম, ৪৭-এর আজাদীর লড়াই, সবকিছুর ভেতর দিয়েই আমরা যে স্বাধীন-সার্বভৌম মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র পেতে চেয়েছিলাম তার একটি সুযোগ এবং সম্ভাবনা কেবল আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের পরই তৈরি হয়েছে। আমরা কেবল ক্ষমতার লোভে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই যেন সেসব সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে দিই।

এ সময় এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।