আজ সোমবার, ৩১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিদায় সন্‌জীদা খাতুন

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৮, ২০২৫, ০৬:৪০ অপরাহ্ণ
বিদায় সন্‌জীদা খাতুন

Sharing is caring!

ফরহাদ মজহার 

বিদায় সন্‌জীদা খাতুন , বাংলাদেশের অতি নগন্য একজন কবির কাছ থেকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।
মানুষ সামাজিক, কিন্তু আমাদের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে গোলাম হয়ে পয়দা হওয়া সমাজে ব্যক্তিতান্ত্রিক চিন্তা ও সংস্কৃতি সমাজের বিপরীতে দাঁড়ায়, সমাজকে নতুন ভাবে গঠন করবার কর্তব্য গ্রাহ্য করে না এবং সামাজিক সংবেদনশীলতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে নিজের গৌরব আবিষ্কার করে। সমাজকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও ঘৃণাভরে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করাকে আমরা সাংস্কৃতিক মুক্তি মনে করি। ফলে প্রিয়জনদের বিদায় নেবার সময়ও আমরা বিতর্ক ও বিভাজন তৈরি করতে ছাড়ি না।
কিন্তু জুলাই গণভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হয়ে ওঠার তাৎপর্য আমাদের আরো ভালভাবে বুঝতে হবে। বিভক্তি ও বিভাজনের বাইরে দয়া, ভালবাসা এবং সামাজিকতার শক্তি তৈয়ারির প্রতি যেন আমরা আরও মনোযোগী হতে পারি। সমাজে ও ইতিহাসে প্রত্যেকের অবদানের পূর্ণ স্বীকৃতি মিটিয়ে দেবার ক্ষেত্রে যেন আমাদের কোন কার্পন্য না হয়। সন্‌জীদা খাতুন, আপনাকে সালাম।
বাঙালি জাতিবাদের প্রবল উত্থানের সময় আমরা উনসত্তর ও সত্তর দশকে ছড়া কেটেছি, “রবীন্দ্রনাথের গান কী যে তার মানে, রাজেশ্বরী দত্ত শুধু জানে”। কারন রাজেশ্বরী পাঞ্জাবের মেয়ে, তারপরও তিনি রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছেন, গেয়েছেন এবং আমাদের মুগ্ধ করেছেন। বাঙালি /পাঞ্জাবির বিরোধ তখন তুঙ্গে। ফলে জাতিবাদী অহমিকায় ভোগা বাঙালি না, একমাত্র একজন নিরহংকার পাঞ্জাবি মেয়ের পক্ষে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মাধুর্য ও মর্যাদা বুঝতে পারা সম্ভব।
তখন চলছে বাঙালি জাতিবাদের তুফান। তরুণ বয়সের বেড়ে ওঠার সময় একদিকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যেই আমাদের আবাস যেমন আমরা উপলব্ধি ও দাবি করেছি তেমনি আমরা কলকাতার কারখানায় নিজেদের তৈরি মানতে রাজি ছিলাম না। আমরা মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও বাংলার সুলতানদের ইতিহাস মনে রেখেছি। ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনের নির্মম স্মৃতি ভুলি নি। আঠারোশ সাতান্ন সাল ও সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস মনে রেখেছি। তাই এই সত্যও মনে রেখেছি ইসলাম এই দেশের জনগণের ধর্ম, ও সংস্কৃতি – বিশেষত আমাদের নীতি-নৈতিকতা নির্ণয় ও দার্শনিক পর্যালোচনার জমিন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাববার চিন্তা ও রাজনীতির বিপদ বোঝার আগেই আমরা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছি। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। বাঙালি বা বাংলাভাষীদের গড়ে ওঠা ও পরিণত হয়ে ওঠার প্রশ্ন ইসলামকে বাঙালি জাতিবাদের বিপরীতে ধর্মীয় জাতিবাদী মতাদর্শ হিশাবে দাঁড় করানো হতে পারে না – বরং জাতিবাদের কালপর্ব দ্রুত অতিক্রম করে বিশ্বসভায় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে শিরদাঁড়া খাড়া করেই আমাদের দাঁড়াতে হবে। সেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে ইসলামের কোন বৈরিতা নাই। থাকতে পারে না। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে শক্তিশালী ভাবে দাঁড়াতে হলে ধর্মীয় কিম্বা সেকুলার ইত্যাদি কোন কিসিমেরই ‘জাতিবাদ’ নয় — কোন প্রকার ‘পরিচয়বাদ’কে শ্বাশ্বত গণ্য করা নয় – হতে হবে আরও অগ্রসর ও পরিণত: হয়ে উঠতে হবে ইতিহাস সচেতন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি। একাত্তরে আমাদের ঐতিহাসিক আবির্ভাব এবং তার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক তাৎপর্য আমাদের বিশেষ ভাবে অনুধাবন এবং তা বাস্তবায়িত করতে হবে। সেকুলার কিম্বা ধর্মীয় – সকল প্রকার পরিচয়সর্বস্ব জাতিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। কারন উভয়েই ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানের উর্বর জমিন।
জুলাই গণভ্যুত্থানের মর্ম জাতিবাদ নয়, বরং বৈচিত্র ও ভিন্নতাসহ নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গঠিত হবার প্রতিশ্রুতি। সেই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা সন্‌জীদা খাতুনের অবদান মনে রাখব।
আমরা সকলেই ইতিহাসের সন্তান। ইতিহাস যোগ্যদের স্বীকৃতি দিতে কখনই কার্পন্য করে না/ সন্‌জীদা খাতুন বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। ষাট থেকে নব্বই দশক অবধি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ব্রাহ্ম ও একত্ববাদী রবীন্দ্রনাথকে আমাদের আপন ও ঘনিষ্ঠ করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর এবং তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’-এর অবদান অসামান্য।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিহারা কৃষক যখন ১৯৫৩ সালে জমির মালিকানা ফিরে পেল তখন তার মুখ্য প্রশ্ন হয়ে উঠল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি মুসলমান একশ বছরেরও অধিক কাল ইংরেজি শেখে নি, এই সময় কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হাতে ঘটল বাঙালির ‘নবজাগরণ’। একদিক থেকে সেটা যেমন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভূত বিকাশের কালপর্ব, অন্যদিকে একই সঙ্গে সেটা হিন্দুত্ববাদের জমিন তৈরির সবচেয়ে উর্বর সময়। উচ্চবর্ণের হিন্দুর হাতে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদের পাশাপাশি কখনো নিজের গুণে, কখনও বিপরীতে প্রতিক্রিয়া হিশাবে গড়ে উঠেছে মুসলিম জাতিবাদী ধারা ও রাজনীতি। কলোনিয়ালিজম বাংলাভাষীদের দুই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিতে ভাগ করে দিয়ে গেছে। একদিকে হিন্দুত্ববাদ এবং তার বিপরীতে মুসলিম জাতিবাদ। ফল হয়েছে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ। বাঙালি ও পাঞ্জাবিরা ছাড়া অন্য কোন ভাষা ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠিকে দেশভাগের ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় নি। হচ্ছে না।
সন্‌জীদা খাতুনসহ বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই টানাপোড়েনের মধ্য বড় হয়েছেন। কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তাদের এন্টি-কলোনিয়াল স্পিরিটকে বুঝতে হবে। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিজের আত্মবিকাশের অপরিহার্য অঙ্গ হিশাবে দাবি ও প্রতিষ্ঠা করা বিশাল অর্জন। ষাট দশকের পাকিস্তানে ভাষা ও সংস্কৃতির বিপরীতে ধর্মীয় জাতিবাদের দ্বন্দ্বসংকুল কালপর্বে জন্মেছিলেন সানজিদা। এই সময় রবীন্দ্রনাথকে আমাদের লড়াই, সংগ্রাম ও রক্ত দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু এই কালপর্বে বাংলা ভষা ও সংস্কৃতির পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে যেভাবে ইসলাম বিদ্বেষ ও ঘৃণার চাষাবাদ হয়েছে তার দায় ছায়ানটকেও নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে সন্‌জীদা খাতুনকে ছায়ানট থেকে আলাদা করাও কঠিন কাজ।
কিন্তু আমরা যেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে অতীত বিচার করি, যেন তাঁর অবদানকে অস্বীকার না করি। আমরা যেন বালখিল্য না হই, ইতিহাস পাঠ করতে যেন ভুল না করি। যাকে পছন্দ করি না তাকে সমাজ ও ইতিহাস থেকে নির্মূল করে দেবার উদগ্র বাসনা থেকে যেন মুক্ত থাকি।

 

ফরহাদ মজহার ; কবি  ও দার্শনিক