আজ মঙ্গলবার, ১লা এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বলতে পেরেছি

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৯, ২০২৫, ০৬:০৪ অপরাহ্ণ
আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বলতে পেরেছি

Sharing is caring!

ইসহাক  খান 

২৩ মার্চ দুপুরবেলা অচেনা নম্বর থেকে ফোন। আমি ফোন রিচিভ করার পর অপর প্রান্ত থেকে লম্বা করে সালাম দিলেন। আমি সালামের জবাব দিয়ে তার পরিচয় জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আমি শহীদ রমিজ উদ্দিন বীরবিক্রম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, আমার নাম কামাল ফারুক।’
‘কি ব্যাপার বলুন।’
ফারুক সাহেব বললেন, ’২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস। গণহত্যা দিবস পালনের জন্য আমরা একজন রণাঙ্গনের যোদ্ধাকে চাইছিলাম। অনেক কষ্টে আপনাকে আমরা পেয়েছি। ২৫ তারিখ আমাদের ছাত্রদের সামনে রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ করবেন। আমরা শুনেছি একই সঙ্গে আপনি একজন লেখকও। এই জন্যে আপনার ব্যাপারের আমাদের সবারই ব্যাপক আগ্রহ।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘ভীষণ মজার কথা বলেছেন আপনি। যে দেশের সরকার হলো রাজাকার। তারা রিসেট বাটন টিপে মক্তিযুদ্ধের সব কিছু মুছে দিয়েছে, সেই দেশে আপনি গণহত্যা দিবস পালন করতে চান? খুবই মজা পেলাম আপনার কথায়। আপনার মাথা ঠিক আছেতো ভাই?’
উনি বললেন, ‘সরকার আমাদের নির্দেশ দিয়েছে দিবসটি পালন করার জন্য। সরকারি নির্দেশ না পেলে আমরা কি এমন রিস্ক নিতাম? কথা দেন আপনি আসবেন। আপনি আসলে আমরা ভীষণ খুশি হবো।’
অগত্যা কথা দিতে হলো। বললাম, ‘ঠিকআছে। আপনি লোকেশন দিন।’
উনি লোকেশন দিলেন। ঢাকা সেনানিবাসে সিএমএইচ হাসপাতালের পাশে।
পরে আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম শহীদ রমিজ উদ্দিন নামে স্কুল এবং কলেজ, দুটোরই পাশাপাশি অবস্থান।
বললাম, ‘সময় কখন? কয়টায় যেতে হবে?’
বললেন, ‘সকাল দশটা।’
বললাম, ‘আমিতো দশটায় ঘুম থেকেই জাগি না। আপনি আমাকে ভীষণ বিপদে ফেললেন।’
উনি বললেন, ‘একদিন না হয় আমাদের জন্য একটু কষ্ট করলেন।’
বললাম, ‘আচ্ছা চেষ্টা করবো।’


পরে কথাটা আমার গৃহবন্ধু শ্যামলীকে বললাম। বললাম যাবো কিনা? শ্যামলী বললো, ‘যাবে না কেন, যাও। যা সত্য তুমি তাই বলবে।’
শ্যামলী আমাকে ঘুম থেকে সকাল সকাল জাগিয়ে প্রস্তুত করে দিল। আমি বললাম, তুমিও চলো। তুমি থাকলে আমি মনে জোর পাই।
যথাসময়ে শহীদ রমিজ উদ্দিন বীর বিক্রম হাইস্কুলে পৌঁছে গেলাম। প্রধান শিক্ষক জনাব কামাল ফারুক আমাদের উষ্ণ স্বাগত জানালেন। নিয়ে গেলেন তাঁর দপ্তরে। সেখানে আরও কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হলো।
বড় হলরুমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। অনেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষকমন্ডলি মিলিয়ে বড় গ্যাদারিং। স্কুল ছুটি তারপরও উপস্থিতি কম ছিল না। প্রধান শিক্ষক কামাল ফারুক সাহেবের স্বাগত বক্তব্যের পরই আমাকে ডাকা হলো। আমি নির্মহ ভাবে প্রকৃত ইতিহাস তুলে বক্তব্য শুরু করলাম। বললাম, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমি নিজে শুনেছি রেডিওতে। সেই ভাষণ শোনার পর আমার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। তারপর আমরা গ্রামের স্কুলমাঠে লাঠি দিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং শুরু করি। ২৫ মার্চ ভয়াল গণহত্যার রাত্রীতে আমাদের ঘাড়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তখন আমাদের বড় ভরসা বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা তোমাদের রাস্তাঘাট যা যা আছে সব বন্ধ করে দেবে।’
তারপর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সকার শপথ নেওয়ার পর আমরা কয়েকজন বন্ধু যুদ্ধযাত্রায় ভারতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি।
বক্তৃতায় আমি কিছু যুদ্ধের স্মৃতি শুনিয়েছি। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের কৃষকের যে অবদান তেমন একটি স্মৃতি কথা শুনে সামনের আসনে বসা একজন শিক্ষয়িত্রী চশমা খুলে চোখ মুছলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক বক্তব্য দেওয়ার পরও তারা আরও শুনতে চাচ্ছিলেন। তাদের অনুরোধে আরও কিছু স্মৃতি বলতে হলো।
অনুষ্ঠান শেষ করে বেরিয়েছি এইসময় পাশেই শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের একজন শিক্ষক এক প্রকার জোর করে তাদের কলেজে নিয়ে গেলেন। সেখানেও গণহত্যা দিবসের অনুষ্ঠান। কিন্তু সেখানে যে মুক্তিযোদ্ধার আসার কথা তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি আসতে পারেননি। তার বদলি হিসেবে সেই অনুষ্ঠানে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হলো। দুটো প্রতিষ্ঠানে আমার লেখা ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’[যুদ্ধের স্মৃতিকথা], ‘যারা যুদ্ধ করেছিল’[উপন্যাস] ‘সত্তুরে ইসহাক খান’ গ্রন্থ তিনটি তাদের লাইব্রেরিতে উপহার হিসেবে দিয়ে এসেছি। উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অকুন্ঠ ভালবাসা পেয়েছি। কথা দিয়ে আসতে হলো আগামীতে ডাকলে আমি যেন সাড়া দেই। দুটো অনুষ্ঠানে আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বলতে পেরেছি, বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা বলতে পেরেছি, জয়বাংলা বলতে পেরেছি, এতেই আমি অনেক তৃপ্ত। জয়বাংলা
ছবি – শ্যামলী খান

ইসহাক  খান ; বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক