আজ বৃহস্পতিবার, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রবীন্দ্রনাথ ও আমাদের রাজনীতিকদের ভাবনা!

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৮:০৮ পূর্বাহ্ণ
রবীন্দ্রনাথ ও আমাদের রাজনীতিকদের ভাবনা!

Sharing is caring!

 

আবেদীন কাদের

গতকাল আমি আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতি গত ছয় দশকে যেভাবে ঘটেছে সে-বিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম বর্তমান সরকারের দু’জন উপদেষ্টা ও নজরুল ইন্সটিটিউটের পরিচালকের বক্তব্যর উল্লেখ করে। সেখানে অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান ‘তথ্য ভুল’ উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে আমি ত্রৈমাসিক ‘শ্রাবণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১৯৮৬ সালে দেয়া অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের একটি অতি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছি। সেই সাক্ষাৎকারে এই রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীতে কারা যুক্ত ছিলেন বা অনুষ্ঠানে কারা অংশ নিয়েছিলেন তা বিস্তারিত বলেছেন অধ্যাপক মুরশিদ। এছাড়া বার কয়েক তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি তৎকালীন সরকার, রাজনীতিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু সংখ্যক অধ্যাপক ও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছেন, যার অনেকটাই তিনি ছাপতে বারণ করেন। তাই সে-কথা আমি আমার লেখায় উল্লেখ করিনি, সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করি নি, এই প্রতিবেদনেও উল্লেখ করি নি। এছাড়া সত্তর দশকের শেষদিকে আফ্রিকার একটি দেশে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সরকার প্রধানদের কনফারেন্সে জেনারেল জিয়াউর রহমান অধ্যাপক মুরশিদকে রবীন্দ্রনাথ ও আমাদের জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে কী ‘আপত্তিজনক’ মন্তব্য করেছেন, তাও উল্লেখ করি নি, কারণ তিনি বারণ করেছিলেন। অধ্যাপক মুরশিদ তখন কমনওয়েলথ দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। ‘শ্রাবণ’ পত্রিকার সেই সাক্ষাৎকারটি আমি কয়েক বছর আগে আবার পড়ি, এতে প্রকাশিত আমার নিজের লেখা প্রতিবেদনটিও আরেকবার পড়ি এবং ভাবি এই সংখ্যা ও বিষয়টি, অর্থাৎ রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা ছিলো তাই বিষয়টি আজকের প্রজন্মের জানা দরকার। তাই সেই লেখাটি হুবুহু রেখে (২. অধ্যায়ে) আমি নীচের লেখাটি প্রকাশ করি কয়েক বছর আগে। নীচে দেয়া লেখাটির সঙ্গে সেই প্রতিবেদনটি আমি ‘৬১ সালে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর সময়কার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও সাহিত্য পত্রিকা ঘেঁটে লিখেছিলাম। ‘৮৬ সালে প্রকাশিত ‘শ্রাবণ’-এর সেই সংখ্যাটিতে নীচে সংযোজিত প্রতিবেদনটিও আলাদাভাবে ছাপা হয়েছিলো। উৎসাহী বন্ধুদের জন্য লেখাটা এখানে দেয়া হলো। আজকের অন্তর্বর্তী সরকারের দু’জন উপদেষ্টা ও ষাটের দশকের পাকিস্তান সরকারের রাজনীতিক ও অনুগত বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্র-বিষয়ে চিন্তার কিছু সাদৃশ্য এতে পাওয়া যেতে পারে!
রবীন্দ্রজন্মশত বার্ষিকী কমিটি এবং ডঃ খান সারওয়ার মুরশিদের ভূমিকা!
১ .
১৯৬১ সালে কবি রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহলকে দ্বিধাদীর্ণ অবস্থায় পড়তে হয়। প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিকমনা বুদ্ধিজীবীগণ মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ সকল বাঙালির, হোক সে পূর্ব পাকিস্তানী বা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী, তাদের সকলের জীবনের এবং অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ রবীন্দ্রনাথের সকল শিল্পকর্ম! অন্য একদল বুদ্ধিজীবী যারা ইসলামপন্থী পাকিস্তানের তমুদ্দনে বিশ্বাস করতেন, তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ছিল ইসলাম বিরোধী এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী। এসময় ছিল সেনা স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের একনায়কত্বের তৃতীয় বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র তখন একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা প্রায় সকলেই সাহিত্যের ছাত্র বা সাহিত্য অনুরাগী তরুণ। তাঁরা নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন, যে কোনভাবেই হোক তাঁরা রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করবেন এবং তা জাতীয়ভাবে। কিন্তু জাতীয়ভাবে উদযাপন করতে গেলে শুধু ছাত্রদের উদ্যোগ বা সক্রিয়তা যথেষ্ট নয়, তার জন্য জাতীয় পর্যায়ের লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের এতে সক্রিয় থাকা জরুরি। যদিও সে-সময়ের লেখক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ছিলেন সাহসী সৎ, নৈতিক এবং অত্যন্ত শক্ত মেরুদণ্ডের অধিকারী, যা আজকাল প্রায় বিরল। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য তখনও পাকিস্তানপন্থী লেখকরা পেতেন, তাদের সংখ্যা এবং শক্তি বেশ বেশিই ছিল। কিন্তু এ অবস্থায়ও এই রবীন্দ্রানুরাগী ছাত্ররা তাঁদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। এই ছাত্রদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক অধ্যাপক মুরশিদের কাছে প্রথম যান আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও কাজী মুশতাক হোসেন। মুশতাক ছিলেন সে সময়ে ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র আর অধ্যাপক সায়ীদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। এই দুই ছাত্র ছাড়াও যারা জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি মনজুরে মওলা ও আতাউল হক। তাঁরা দুজন ছিলেন ইংরেজির ছাত্র এবং পরে বাংলাদেশ সরকারের সচিব। এই সব ছাত্রদের দৃঢ়তা এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর অনুরাগের কারণেই অধ্যাপক মুরশিদ তাঁদের প্রস্তাবে মত দেন এবং রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হতে সম্মত হন। কমিটির সভাপতি ছিলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুরশেদ। ৬১ সালে এই কমিটির ভূমিকা বা অধ্যাপক মুরশিদের সাধারণ সম্পাদক হিশেবে দায়িত্ব পালন এবং সর্বপরি কয়েকজন ছাত্রের রবীন্দ্রানুরাগ আমাদের জাতীয় জীবনে কী অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়টি আজ প্রায় ষাট বছর পর পেছন ফিরে ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়।
১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের একশত পঁচিশ বছর জন্মোৎসবের সময় বাংলাদেশ ছিল আরেক দুরাচারী স্বৈর সেনাশাসকের বুটের তলায় পিষ্ট, রবীন্দ্র-সাহিত্যও। সে সময়ে ৬১ সালের সেই ছাত্রদের একজন কবি মনজুরে মওলা একটি সাহিত্য পত্রিকা ‘শ্রাবণ’ সম্পাদনা করতেন। এই পত্রিকাটির সঙ্গে সহযোগী সম্পাদক হিশেবে আমার জড়িত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ‘শ্রাবণ’ সিদ্ধান্ত নেয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে একটি লেখা প্রস্তুত করা হবে, রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইগুলোর আলোচনা এবং অধ্যাপক মুরশিদের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হবে। সেই সংখ্যা ‘শ্রাবণ’ পুরোটাই ববীন্দ্র-বিষয়ক লেখা দিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল। অধ্যাপক মুরশিদের সাক্ষাৎকার ও তার প্রশ্নাবলী নির্ধারণ নিয়ে সম্পাদক ও আমরা সহযোগী সম্পাদকদের মধ্যে কয়েকটি সভা হয়। অধ্যাপক মুরশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সম্মতি দেন সাক্ষাৎকার বিষয়ে। এই সাক্ষাৎকারটি এবং ‘শ্রাবণ’ এর এই সংখ্যাটি প্রস্তুত করতে অন্যান্য সহযোগী সম্পাদকের সঙ্গে আমাকেও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিষয়ে পড়ার প্রয়াস নতুন করে কিছুটা শিক্ষিত করে তোলে। আমি জীবনে প্রথমবারের মতো কলকাতা থেকে মেরুন রেক্সিনে বাঁধাই রবীন্দ্ররচনাবলী সংগ্রহ করে অভিনিবেশ নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি! আগে বিক্ষিপ্তভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়েছি, এসময়ে পুরো রচনাবলী পড়ার চেষ্টা করি। এবিষয়ে এর দুতিন বছর আগে আমাকে রবীন্দ্রনাথের সব লেখা পাঠের পরামর্শ দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় তাঁর বাসার একটি আড্ডায়। আরও অনেক বইয়ের মতোই রবীন্দ্ররচনাবলী সংগ্রহে আমাকে সাহায্য করেছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু রাশিদা দাহদওয়ালা (রাশিদা জিয়াউদ্দিন)। এই রচনাবলীর সঙ্গে আরেকটি সুন্দর উপহার তিনি দিয়েছিলেন, সেটা এইচ এম ভি ও বিশ্বভারতীর যৌথভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের একগুচ্ছ ক্যাসেট, যা সুন্দর একটি কাঠের নকশা করা বাক্সে ধরা ছিল। ‘৮৬ সালের ‘শ্রাবণ’ এর এই উদ্যোগ আমার রবীন্দ্র-সাহিত্যে সম্পর্কে বোধকে অনেকখানি বদলে দিয়েছিল পরোক্ষভাবে।
সেই পত্রিকা প্রকাশের প্রায় বত্রিশ বছর পর আমি অধ্যাপক মুরশিদের সাক্ষাৎকারটি ও অন্যান্য লেখা আরেকবার পড়ি। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি সেই সাক্ষাৎকারে বলা অধ্যাপক মুরশিদের কিছু গভীর পর্যবেক্ষণ আমাদের দেশের জাতীয় ইতিহাসের জন্য আজও গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবীদের আচরণ ৬১ সালের সেই দুই শিবিরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমার মনে হয় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সমাজ-রাজনীতি বিষয়ক বীক্ষাও তেমন মোটা দাগে বদলায়নি। যদিও আজকের দিনে সমাজ ও রাজনীতি ধর্ম দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত বলেই মনে হয়। আরও চিন্তার বিষয় হল মধ্যবিত্ত এবং বুদ্ধিজীবী মহলে সেকুলার ও গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষের সংখ্যা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। নতুন করে সাক্ষাৎকারটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে এটির পুনর্মুদ্রণ হলে আজকের তরুণ লেখকরা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজে ষাট বছর আগেও কিছু কঠোর মেরুদণ্ডের অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী লেখক এবং আলোকিত ছাত্র ছিলেন যারা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য স্বৈরশাসক আইয়ুবের প্রতিপক্ষে দাঁড়াতে ভয় করেন নি। আমি তাই আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু কবি রাজু আলাউদ্দিনকে এটি পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করি। তিনি আমাকে সঙ্গে একটি ছোট ভূমিকা লিখে দিতে বলেন। সেটা লিখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এই শতবর্ষ উদযাপনের সময়ে আমাদের সমাজ-রাজনীতি এবং ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কার কী মত বা বক্তব্য ছিল তা এখানে কিছুটা আলোকপাত করলে আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবী সমাজকে বুঝতে একটু সহজ হবে। ‘শ্রাবণ’ এর সে সংখ্যায় ৬১ সালকে ‘ফিরে দেখা’র জন্য আমি কয়েকটি লাইব্রেরিতে পুরনো সংবাদপত্র কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। তাতে দেখেছি আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবীরা চিন্তার দিক থেকে অনেকটাই ইসলামি সংস্কৃতিকে ধারণ করে রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের পক্ষে ছিলেন। আমি সময়টাকে একটু বোঝার জন্য সেই তথ্যাদির কিছুটার আলোকে এখানে বর্ণনা দিচ্ছি!
২ .
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিরাট এক বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠেন। স্বৈরশাসক থেকে আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবী মহল এবং প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। সহজেই এই সব মানুষদের মনোজগৎ এবং রাজনৈতিক অবস্থানটি সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠিক তার দশ বছর পর এই মানুষগুলোই আমাদের জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকাল এবং ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ভূমিকাকে জাতির কাছে আরেকবার পরিষ্কার করেন। বাংলা পঞ্জিকানুযায়ী ২৪ বৈশাখ, ১৩৬৮, ইংরেজি ৭ মে ১৯৬১ সালে রোববার সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকার জেলা কাউন্সিল হলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফজলুল হক সেলবর্ষী। তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সার্থক উত্তরাধিকারী। অতি স্বাভাবিকভাবেই তাহার রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাই তিনি যত বড় কবিই হউন না কেন, মুসলমানদের জাতীয় কবি হইতে পারেন না।’ সে অনুষ্ঠানে কবি মইনুদ্দিন বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে উচ্চ শ্রেণীর কবি। একজন বিদেশি কবিকে যতটুকু সন্মান প্রদর্শন করা দরকার, আমরা তার বেশি তাঁহাকে দিতে পারি না। তিনি ভারতীয় আমরা পাকিস্তানী, তাঁহার আদর্শ আমাদের আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং তাঁহার জন্মবার্ষিকী পালন লইয়া আমাদের মাতামাতি করা শোভা পায় না। ইহাতে আত্মবিস্মৃতিরই পরিচয় পাওয়া যায়।’ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, ‘যাহারা পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্যসূত্র দেখিতে পান, তাহাদের জানা উচিৎ যে পাকিস্তান ভারতের রামরাজ্য নহে।’ এসব উদ্ধৃতি দৈনিক আজাদ পত্রিকার ৮ মে ১৯৬১ তারিখের সংখ্যা থেকে নেয়া, যেখানে আরও বলা হয় এই সভা ‘পূর্ব পাকিস্তানের বেতার কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন একাডেমীকে বিজাতীয় সঙ্গীত- সাহিত্যের অভিশাপমুক্ত করিয়া জাতীয় ঐতিহ্য ও আদর্শের অনুসারী করার জন্য’ পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শে বিশ্বাসী সরকার সুধী সমাজ ও জনসাধারণকে আহবান’ জানায়।
এছাড়া ৮ মে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় হলের মিলনায়তনে । এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ আবদুল হাই। প্রবন্ধ পড়েন আবু রুশদ, বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। সাজ্জাদ হোসায়েনের প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ব পাকিস্তান’। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলা উম্মত্ততা মাত্র; যারা বলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় মুসলমানদের উপেক্ষা করেছেন, তাদের মানসিকতা তাঁর কাছে উদ্ভট মনে হয়। তিনি গ্যাটের কথা উল্লেখ করেন। রাজনৈতিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অস্ট্রিয়া এবং জার্মান বাসী উভয়ের কাছে যিনি নিজস্ব কবি হিশেবে গৃহীত। তিনি আরও বলেন রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের কথা ভাবাই যায় না। একই ব্যক্তি, ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন পরবর্তীকালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে এক বিবৃতি দেন, ‘ ….The recent statement in favour of Tagore’s songs is liable to be misunderstood and is likely to be exploited in propaganda against Pakistan.’ বিবৃতিটি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ২৯ জুন, ১৯৬৭ সালে ছাপা হয়। বিবৃতিতে অন্যান্য স্বাক্ষরকারীরা ছিলেন কে এম এ মুনিম (পরবর্তীকালে অবজারভার পত্রিকার অস্থায়ী সম্পাদক), মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, মোহাম্মদ মোহর আলী ও এ এফ এম আবদুর রহিম। এঁরা সকলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ তারিখে দৈনিক আজাদ- এ সম্পাদকীয় ‘রবীন্দ্রনাথ ও মওলানা আজাদ’। একই বছরের ১২ বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন এ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বেরোয়- সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ ও চিঠি। বৈশাখের ১২ তারিখে সম্পাদকীয় ‘রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ব পাকিস্তান’, ১৩ তারিখে প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রশতবার্ষিকী প্রসঙ্গ’, লেখক আহমদ পারভেজ, ১৪ তারিখে সম্পাদকীয় ‘রবীন্দ্রনাথ ও আমরা’, উপসম্পাদকীয় ‘সাহিত্য সন্মেলনঃ কাগমারী ও রবীন্দ্রনাথ’, লেখক নুরুদ্দিন মাহমুদ প্রকাশিত হয় দুদিন , ১৭ ও ১৮ বৈশাখ। ১৯ বৈশাখ ছাপা হয় সৈয়দ আবদুর রশীদের প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মুসলমান’, জ্যৈষ্ঠ মাসের ১ তারিখে ছাপা হয় এম এ ওয়াহেদ রচিত প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ ও পাকিস্তানী’। যাদের নামে এসব প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ‘শ্রাবণ’ ৮৭ সালের জানুয়ারিতে অনেক চেষ্টা করেও সে-সব লেখকদের পরিচয় উদ্ধার করতে পারে নি। তবে অনেক গবেষক সন্দেহ করেছেন সে সময়ে যে, এঁদের মাঝে অনেক সাংবাদিক রয়েছেন যারা ছদ্মনামে এসব প্রবন্ধ ও উপসম্পাদকীয় লিখতেন। একজনের কথা জানা গিয়েছিল যিনি দৈনিক আজাদে নয়, বরং অন্য পত্রিকায় কাজ করতেন সে-সময়, বর্তমানে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে বাস করেন।
২৮ বৈশাখ প্রকাশিত হয় মোহাম্মদ আকরম খানের ‘রবীন্দ্রনাথের হোরি খেলা’, যেখানে তিনি লেখেন, ‘দশ কোটী মুসলমানকে কখনো তিনি মমতার চক্ষে দেখিতে পারেন নাই’, এরপর আরও লেখেন, ‘ মুছলমানের নাম করিতে হইলে সাধারণ ভব্যতার বালাই বিস্মৃত হইয়া কোন না কোন ঘৃণাব্যঞ্জক বিশেষণ ব্যবহার করিতে হইবে- এই সনাতন নীতির তিনিও বশবর্তী হইয়াছিলেন।’ এই সব লেখার প্রতিপাদ্য ছিল একটিই ঃ রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক ছিলেন, মুসলমানদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করতেন এবং যে- আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি, তাঁর রচনা সে- আদর্শের বিরোধী। সম্পাদকীয়তে বার বার বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের লেখায় মুসলমানদের জীবন ও ভাবনা জায়গা পায় নি, ভাষা ও সাহিত্যের যে- ধারায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তার সঙ্গে ‘মুসলমানদের নাড়ীর যোগ’ কখনো ছিল না।
বৈশাখ ১৩৬৮ সালের ৭ তারিখে ‘সংবাদ’ এর উত্তর-সম্পাদকীয় ‘নানা কথা’ ‘আজাদ’ এর পহেলা বৈশাখের সম্পাদকীয়র উত্তর। সংবাদের লেখায় বলা হয় ‘আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের অনুভূতি ও চিন্তায় এক হয়ে আছেন।’ ‘সংবাদ’ এর বৈশাখ ১৩, ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ ও আজাদ’ (উপসম্পাদকীয়) আগের দিন ‘আজাদ’ এ প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ব পাকিস্তান’ প্রবন্ধের জবাব। পরের দিন একই শিরোনামে সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় ‘নানা কথা’ , দুটোতেই আজাদ পত্রিকার ভূমিকা এবং সমালোচনা। পনেরোই বৈশাখ আবুল খায়েরের প্রবন্ধ ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ’, ১৩৩২ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে রবীন্দ্রনাথকে ছাত্রদের দেয়া দীর্ঘ মানপত্র ষোলই বৈশাখ পুনর্মুদ্রিত। উনিশে বৈশাখ বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা (শ্রাবণ ১৩২৯) থেকে কবি গোলাম মোস্তফার ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ’ পুরোপুরি তুলে দেয়া হয়, যার এক অংশ ঃ ‘বিরাট রবীন্দ্রসাহিত্যের কোথাও আমরা ইসলাম বিদ্বেষ খুঁজিয়া পাই নাই। বরং তাঁহার লেখায় এতো ইসলামী ভাব ও আদর্শ আছে যে তাঁহাকে অনায়াসে মুসলমান বলা চলে।’ এমনি করে বিভিন্ন দিন (১৪, ১৭, ২০, ২০, ২২, ২৭ ও ২৮ বৈশাখ এবং ১ ও ২ জ্যৈষ্ঠ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে প্রবন্ধ ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় ‘সংবাদ’ এ। ২৫ বৈশাখ বের হয় আট পাতার একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র। ২৬ বৈশাখ ‘সংবাদ’ এর প্রথম পাতায় চারদিকে দাগ দেয়া একটি অংশে লেখা হয়, ‘মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন ঃ পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র হিটলার , গোয়েবেলস, হিমলার, ও আইখম্যান শাসিত নাৎসি জার্মানিতে রবীন্দ্র-সাহিত্যের সর্বজনীনতা ও মানবপ্রীতির জন্য ১৯৩৫ সালে ইহার প্রচার ও প্রসার নিষিদ্ধ হইয়াছিল।’ এসময়ের দৈনিক ইত্তেফাক সহজলভ্য নয়, কিন্তু সচেতন পাঠকরা জানেন ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ আজাদ পত্রিকার ভূমিকাবিরোধী। ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজ’ নামে যে সব লেখা আহমেদুর রহমান রচনাবলীতে স্থান পেয়েছে সেগুলো সম্ভবত ইত্তেফাকে সে সময়ে প্রকাশিত। আহমেদুর রহমান তখন ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। জানা যায় সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনও রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সে-সময় প্রবন্ধ লেখেন ইত্তেফাকে।
রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীতে বিচারপতি এস এম মুরশেদের নেতৃত্বে একটি ও কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। প্রেসক্লাবে সাংবাদিকরা আরেকটি কমিটি করেন। শেষে এসব কমিটি একসঙ্গে কাজ করে। বিচারপতি মুরশেদ ছিলেন মূল কমিটির সভাপতি এবং অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। মূল উৎসব চারদিন ধরে চলে- চব্বিশ থেকে সাতাশে বৈশাখ। চব্বিশে বৈশাখ, ইংরেজি পঞ্জিকানুজায়ী ‘৬১ সালের ৭ মে রোববার সকালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে উৎসব শুরু হয়। সারা মঞ্চ জুড়ে শিশু থেকে নানা বয়সের শিল্পী; হে নূতন , দেখা দিক বার বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ, সমবেত কণ্ঠের গানে নেতৃত্ব দেন আতিকুল ইসলাম। উদ্বোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী। নিজের লেখা কবিতা পড়েন শামসুর রাহমান ও উর্দুভাষী ডঃ আন্দালিব শাদানী। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন অন্যান্যের মধ্যে খুরশিদী খানম, হুসনে আরা, নুরজাহান মুরশিদ, সেলিনা চৌধুরী, সাবিয়া বেগম, গোলাম মোস্তফা, ইকবাল চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। গান করেন অন্যান্যের মধ্যে লায়লা আরজুমান্দ বানু, বিলকিস নাসিরুদ্দিন, বেলা রায়, গোপা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাবেয়া খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, ফজলে নিজামী, আতিকুল ইসলাম, ওয়াহিদুল হক ও ভক্তিময় দাশগুপ্ত।
পরের দিন ২৫ বৈশাখ ফজলুল হক হলে বিকেল সাড়ে তিনটায় হয় আলোচনা সভা। সেখানে আলোচনা করেন অধ্যাপক আবদুল হাই ও আরও অনেকে। সেদিন সন্ধ্যায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে কবিতা পড়েন হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বেনজীর আহমেদ, আশরাফ সিদ্দিকী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, লতিফা হক, লতিফা হিলালী, আরও কেউ কেউ। সন্ধ্যায় চণ্ডালিকা ও চিত্রাঙ্গদা- র নির্বাচিত অংশের অভিনয়- প্রযোজনায় ছিল বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, পরিচালনা করেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত। এতে প্রকৃতি হয়েছিলেন মন্দিরা নন্দী, চিত্রাঙ্গদা জান্নাত গনি, অর্জুন অজিত দে, এবং আনন্দ জেকব পিউড়িফিকেশন।
২৬ বৈশাখ বিকেলে আরেকটি অনুষ্ঠান হয় যেখানে অনেক বিদগ্ধজন আলোচনা করেন।
মে মাসের ৩ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য কেন্দ্র রবীন্দ্রনাথের জীবন ও রচনা সম্পর্কে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে যেখানে ব্রডওয়েতে বিশ্বভারতীর সাহায্যার্থে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইনস্টাইন ও উইল ডুরানটের সঙ্গে নেয়া রবীন্দ্রনাথের ছবি স্থান পায়। বিচারপতি মুরশেদ প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। ঢাকায় ভারতীয় তথ্য কেন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত কবিতার সংকলন প্রকাশ করে যাতে বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের কবিদের লেখা স্থান পায়।
৬১ সালে এই রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনে বড় অভিঘাত সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথকে প্রতীক করে এটি ছিল বাঙালিদের পাকিস্তান শাসক-শ্রেণীর বিরুদ্ধে বড় প্রতিবাদ। কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকে নি। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথ আবার বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠেন। সেবছর ২৩ জুন খবর প্রকাশিত হয় যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ঘোষণা করেছেন যে রেডিও ও টেলিভিশন থেকে পাকিস্তান- বিরোধী রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পাকিস্তান বিরোধী গান! পরদিন ১৯ জন বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেনঃ ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করিয়াছে, তাঁহার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করিয়াছে , তাহা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানীর সংস্কৃতির সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করিয়াছে।’ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ডঃ মুহাম্মদ কুদরত- এ- খুদা, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, এম এ বারী, মুহাম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, সিকান্দার আবু জাফর, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, নীলিমা ইব্রাহিম, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও শহীদুল্লাহ কায়সার। জুন মাসের ৩০ তারিখে ‘সংবাদ’ এ এক পৃথক বিবৃতেতে কবি জসীম উদ্দিন বলেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীদের নাড়ীর বন্ধন– কোন সরকারি আইন দিয়ে সে বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না।’ এসময় সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেন কিংবা তার বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আলী আশরাফ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আতিকুল ইসলাম, কামাল হায়দার, মোস্তফা কামাল, লায়লা আরজুমান্দ বানু, সিরাজুদ্দিন হোসেন, এ বি এম মুসা, হাসান ইমাম, মুহাম্মদ মুনসর উদ্দিন, ওয়াহিদুল হক, জাহিদুর রহিম, ফারুকুল ইসলাম, আতাউর রহমান ও কামাল লোহানী।
৬৭ সালের জুন মাসের দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত মাওলানা ভাসানীর বিবৃতি। তিনি বলেন, “ইসলাম সত্য ও সুন্দরের জয় ঘোষণা করিয়াছে। এই সত্য ও সুন্দরের পতাকাকে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই, যারা ইসলামের নামে , রবীন্দ্রনাথের উপর আক্রমণ চালাচ্ছেন, তারা আসলে ইসলামের সত্য ও সুন্দরের নীতিতে বিশ্বাসী নন।” চট্টগ্রাম থেকে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে বিবৃতি দেন , অন্যান্যের মধ্যে আবুল ফজল, আল মাহমুদ, সুচরিত চৌধুরী, যা সংবাদ এ প্রকাশিত হয় ১ জুলাই, ১৯৬৭।
৩০ জুন ১৯৬৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটি ছিল, “…রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের তামুদ্দনিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ…’ এই উক্তির প্রতিবাদ করিতে আমরা বাধ্য হইতেছি এই কারণে যে, এই উক্তি স্বীকার করিয়া নিলে পাকিস্তানি ও ভারতীয় তমুদ্দনকে এক ও অবিচ্ছেদ্য এই কথাই মানিয়ে নেওয়া হয়। উপরোক্ত বিবৃতিকে (উনিশজন বুদ্ধিজীবীর দেয়া ২৪ জুনের বিবৃতি) আমরা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, অত্যন্ত মারাত্মক এবং পাকিস্তানের মূলনীতির বিরোধী বলিয়াও মনে করি।” আজাদ পত্রিকায় ৩০ জুন , ৬৭ সালের এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, অন্যান্যের মধ্যে মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, ইব্রাহীম খাঁ, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, কাজী দীন মোহাম্মদ, আশরাফ সিদ্দিকী, তালিম হোসেন, শাহেদ আলী, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, সানাউল্লাহ নুরী, এ কে এম নুরুল ইসলাম, জাহানারা আরজু ও কাজী আবদুল ওয়াদুদ। জুলাই মাসের এ তারিখে পয়গাম পত্রিকায় মাওলানা আকরম খান ও আরও ২৯ জন মাওলানা স্বাক্ষরিত বিবৃতিটির একটি অংশ ছিল, “রবীন্দ্রনাথের বহু সঙ্গীত মুসলিম তমুদ্দন কে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতি ও যৌন ভোগলালসার জয়গান গাহিয়াছে। সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন হইতেই এসকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও ও টেলিভিশনকে পবিত্র রাখার প্রয়োজন ছিল।” পরদিন পয়গামে প্রকাশিত হয় কয়েকজন শিল্পীর বিবৃতি, যাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল লতিফ, মীর কাশেম খান, আঞ্জুমানারা বেগম ও শাহনাজ বেগম। বিবৃতির এক জায়গায় বলা হয়, “………পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর রবীন্দ্রসঙ্গীত চাপাইয়া দেয়ার সকল প্রচেষ্টাই নিঃশেষে ব্যর্থ হইবে।” ‘৬৮ সালে ৬ জুলাই থেকে ৯ জুলাই রাইটার্স গিলডের উদ্যোগে ‘মহাকবি স্মরণ উৎসব’ — রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, গালিব, মাইকেল ও নজরুলকে নিয়ে অনুষ্ঠান হয়। ইসলামিক একাডেমীর পরিচালক আবুল হাশিম এ অনুষ্ঠানে বলেন, “যাঁহারা ইসলাম এবং পাকিস্তানী আদর্শের নামে রবীন্দ্রসঙ্গীত বর্জনের ওকালতি করিতেছেন, তাঁহারা শুধু মূর্খই নহেন, দুষ্টবুদ্ধি-প্রণোদিত ও তাঁহারা না বোঝেন রবীন্দ্রনাথ না বোঝেন ইসলাম।”
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, সদ্য কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্সে জনসভায় বলেন, “আমরা এই ব্যবস্থা (সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রচর্চায় বাধা) মানি না – আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এদেশে গীত হইবেই।” সেবছরই ষোলই ডিসেম্বর বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ, কয়েকজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর গাওয়া গানের রেকর্ড বের করে । রেকর্ড কোম্পানি বঙ্গবন্ধুকে একটি রেকর্ড উপহার দিলে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, “…..Vested quarters will always be active to bring cultural subjugation to perpetuate exploitation of the people, but the people must stand united to courageously defend their language and culture under all circumstances.” এর ঠিক দুবছর পর মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
১৯৬১ সালের রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের দশ বছরের মধ্যে বাংলার রাজনৈতিক চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে মোড় নেয়, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও গান আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে বড় গুরুত্ব বহন করে প্রতীক হিশেবে। আইয়ুব, জিয়া, এরশাদ এবং খালেদার শাসনামলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে ইসলামীকরনের অব্যাহত চেষ্টা চলে। ১৯৭৯ সালে লুসাকায় এক সন্মেলনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিষয়ে জেনারেল জিয়া যে বক্তব্য দেন অধ্যাপক মুরশিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায়, তা অধ্যাপক মুরশিদ তাঁর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। তাতে জেনারেল জিয়ার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে শুধু নয়, সাধারণ বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা সংস্কৃতি বিষয়ে মূর্খতা দেখে অধ্যাপক মুরশিদ বিস্মিত হয়েছিলেন সেদিন।
আমাদের সমাজ- রাজনীতির ইতিহাসে আজ কয়েক দশক যাবৎ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বা ইসলামিক আদর্শের দল ক্ষমতায় এলেই আক্রমণের প্রথম শিকার হন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু এদেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিকমনা বুদ্ধিজীবীরা সব সময়ই রবীন্দ্রনাথের জন্য রাস্তায় নেমেছেন। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেছিলেন বলে পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের উত্তরসূরি একদল ‘বুদ্ধিজীবী’ উদ্ভট মিথ্যাচারী তথ্য-নির্ভর এক বিতর্ক তুলেছেন।
আরেকটি বিষয় আমাদের দেশে খুব বেশি লেখা হয় নি, তা হলো ‘৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পর ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন এবং আরও কয়েকজনের মিলিত প্রচেষ্টায় ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের মনোজগতে বড় রকমের ছাপ ফেলে। আমাদের ছাত্রসমাজ ও নাগরিকদের সেকুলার গণতান্ত্রিকমনা করে গড়ে তুলতে ‘ছায়ানট’ এর ভূমিকা সত্যিই অনেক বড়।