Sharing is caring!
সরওয়ার আহমদ
অবসর এবং একাকীত্বের রেশ কাটাতে মোবাইল যন্ত্রটি এক উপাদেয় সহযোগী বলেই গণ্য।ফেসবুক ও ইউটিবের দৃশ্যপট ভাবনার রাজ্যে দোলা দেয়।ইদানিং ফেসবুক এবং ইউটিবে যুদ্ধংদেহী নর্তন ও বাতচিত দৃষ্টে গ্রামীণ হাঙ্গামার দৃশ্যপট ভেসে উঠে।গ্রামে দু’পক্ষের মধ্যে হাঙ্গামা বাঁধলে আতুর ল্যাংরা ও কানারা বীরবাহাদুর হয়ে উঠে।হাঁক লাফালাফি ও গালিগালাজ দিয়ে তারা প্রমাণ দিতে চায় যে তাদের মতো লেঠেল ক’জন আছে!ফেসবুকে যারা লাফাচ্ছে তারা উল্লেখিত গোত্রের বাসিন্দা বলেই প্রতীয়মান।লাগাতে পারবে কিন্তু খসাতে পারবে না এবং সময়বুঝে লাপাত্তা হয়ে যাবে। এর উদাহরণটা পরে টানছি।যারা যুদ্ধের আয়োজক তাদের নিকট যুদ্ধ খেলা সমতুল্য হলেও জাতি হয়ে উঠে ভুক্তভোগী।যুদ্ধের খেসারত বা মাশুল গুনতে হয় কড়ায় গন্ডায়।সেটি দেশ হোক কিংবা বিদেশই হোক।
১৯৭১ সনের প্রলম্বিত মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি নিজ দৃষ্টিতে এবং অনুভবে।তখন ইন্টার মিডিয়েট ক্লাসের ছাত্র ছিলাম বিধায় পর্য্বেক্ষণ ক্ষমতা কারো চাইতে কম ছিলোনা।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এই বাংলাদেশে তাদের নারকীয় “অপারেশন সার্চ লাইট ” শুরু করেছিলো ২৫ মার্চ রাত দশটা থেকেই।সে রাতে কি ঘটেছিলো সেটি আত্মবিস্মৃত জাতি ভুলে গেলেও ইতিহাস ভুলেনি।ইতিহাসের পাতায় তার অবয়ব আঁকা আছে স্বমহিমায়।শত চেষ্টাতেও সেটি মুছে ফেলা যাবেনা।পরদিন ২৬ মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন জাতির উদ্দেশ্যে ইংরেজীতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি পুরো মাত্রায় হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলেও সারমর্ম বুঝতে অসুবিধা হয়নি।ভাষণের একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট তার সেনাবাহিনীকে সাবাশী দিয়ে বলেছিলেন -আমার সৈনিকরা পূর্ব পাকিস্তানে ফুটবল খেলতে নামেনি। মদ্যপ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মুখ থেকে নির্জলা সত্যেরই প্রকাশ ঘটেছিলো।হানাদার বাহিনী কি খেলা খেলেছিলো সেটি আত্মবিস্মৃত জাতি ভূলে গেলেও ইতিহাস তাহা ভুলেনি।নারকীয় যে খেলা ২৫ মার্চের কালো রাত থেকে শুরু হয়েছিলো সে খেলায় নিরস্ত্র মানুষের লাশ ভেসেছে নদীতে ,ডাঙায় লাশ নিয়ে টানাটানি করেছে শিয়াল কুকুর ও শকুন।স্তুপীকৃত মৃতদেহকে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিলো যথায় তথায়।ঘরপোড়ার ধূম্রকুন্ডলী এবং ধর্ষিতাদের আর্তনাদে বাতাস হয়েছিলো ভারী।বানভাসির পিপিলীকা কুন্ডলির মতো দেশত্যাগী মানষের ঢল নেমেছিলো চরাচরে।কিন্তু ঘটনাতো অবস্থা বৈগুণ্যে একপাক্ষিক থাকেনি। আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতও অবধারিত ছিলো।ফলশ্রুতিতে হানাদার বাহিনীর লাশও ভেসেছিলো এতদ্দেশীয় গঙ্গায়।লাশের বহর প্লেনযোগে পাকিস্তানে পাঠানো সম্ভব না হওয়াতে এ দেশের ঝোপ জংগলে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো রাতের আঁধারে।বর্তমানে এ সমস্থ কবরস্থানের চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট নেই।কবরগাহে গজিয়েছে বাড়ীঘর ,অফিস এমনকি পাবলিক টয়লেট।নিহতদের স্বজনরা কি এখবর জানে?
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঘাটাঘাটি কালে অনেক মর্ম্মান্তিক ও বিয়োগান্তিক ঘটনা সম্পর্কেও অবহিত হয়েছি।সমশেরনগর ডাকবাংলোতে অবস্থান কালে জনৈক পশ্চিমা মেজর সেলিম খান তার পিতার নিকট চিঠি লিখেছিলেন তাকে এদেশ থেকে বদলি করে নেওয়ার জন্য।চিঠির শেষাংশে তার ছোট্ট শিশু সন্তানকে আদরও জানিয়েছিলেন।কিন্তু চিঠিটি পোষ্ট করার আগেই ঘাতক বুলেট দুনিয়া থেকে তাকে বদলি করে দিয়েছিলো! শ্রীমংগলের মাজডিহি চা বাগানের উর্দ্দুভাষী দেশওয়ালি আজমত খাঁ ছিলেন ঘটনাচক্রে মৌলভীবাজারস্থ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের বাবুর্চি সহকারি। তিনি বলেছিলেন ,মিয়ানওয়ালির এক গ্রাম্যপরিবারের সাতভাই সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেছিলো। যুদ্ধকালে তাদের অবস্থান ছিলো বাংলাদেশে।মে থেকে আগষ্ট পর্য্ন্ত কশবা আখাউড়া এবং কামালপুরের যুদ্ধে ছয়ভাই নিহত হয়েছিলো। অবশিষ্ট একভাই ছিলো মৌলভী বাজারস্থ ব্রীগেড হেড কোয়ার্টারে।ছয়ভাইয়ের শোক সহ্য করতে নাপেরে নিজ মারণাস্ত্রের গুলিতে সে আত্মহত্যা করেছিলো। এক পরিবারের সবশেষ। এটি হচ্ছে যুদ্ধের খেসারত।যুগ যুগান্তর পর্য্ন্ত এ খেসারতের ভার বহন করতে হয়।
যুদ্ধে পরাজিত না হওয়া পর্য্যন্ত জেনারেল থেকে শুরু করে সাধারণ সৈনিকরাও নিজেদেরকে বিজয়ী মনে করে।আর তাদের সিভিলিয়ান সমর্থকরা ছাগলের তিননম্বর বাচ্চার মতো তাধিং নাচে বাজিমাৎ করতে এগিয়ে আসে।৭১ সনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থাও ছিলো তদ্রূপ।বাংলাদেশে “অপারেশন সার্চ লাইট “শুরু করার আগে জেনারেল টিক্কা খাঁন সদম্ভে ঘোষণা করেছিলো যে,বেয়াদব বাঙ্গালীদেরকে শায়েস্তা করতে ৪৮ ঘন্টার বেশী সময় লাগবে না।কিন্তু ৪৮ ঘন্টাতো ছাড় ৬/৭ মাসেও যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছিলোনা এবং দিনবদলে ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাঙালি বিচছু বাহিনী অধিকতর ক্ষিপ্র ও লড়াকু হয়ে পান্জাবী নিধনে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলো তখন পাকিস্তানী সমর বিশারদদের হিসেবনিকেশ পাল্টে গিয়েছিলো।তারা ধরেনিয়েছিলো যে বাঙ্গাল মুল্লুককে আর কব্জায় রাখা যাবেনা। তখন তাদের মগজে তৃতীয় চিন্তা খেলে উঠেছিলো।বাঙালিকে সমর্থন দানকারী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ইন্ধনদাতা চিরশত্রু ভারতকে তখন সরাসরি আক্রমণের সিদ্ধান্তে পৌছে পাকিস্তানী জেনারেলরা। ১৯৪৮ এবং১৯৬৫ সনে পাকিস্তান যেভাবে আগবেড়ে ভারতকে আক্রমণ করেছিলো এবং জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যেভাবে যুদ্ধ বিরতি কার্য্কর হয়েছিলো সেভাবে আরও একটি যুদ্ধ বাঁধলে জাতিসংঘ এগিয়ে আসবে এবং বিরাজমান পরিস্থিতির একটি গ্রহণযোগ্য ফয়সালা হবে,এমন একটি ধারণায় বদ্ধমূল হয়েছিলো পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ।এটি হলে অন্ততঃ বাংলাদেশকে খোয়াতে হবেনা।
যেমন চিন্তা তেমন কাজ। ৭১ সনের অক্টোবর থেকেই পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠেছিলো।চাঁদপুরের এক সমাবেশে পাকিস্তানী এক জেনারেল সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন -আর কয়েক সপ্তাহ পরে আমরা দিল্লীর জামে মসজিদে নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি ।মৌলভী বাজারের শিশুপার্কের এক সমাবেশে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা ঘোষণা করেছিলেন -ভারতের কৈলাসহর নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের ৬ ঘন্টা সময়ও লাগবেনা। রাজা যাহা বলে ,পরিষদগণে বলে তার শতগুণ।জেনারেলদের বক্তব্যশুনে তাদের এতদ্দেশীয় স্তাবক ও অনুসারীরা দুহাত উচিয়ে নেচে নেচে বলেছিলো ওজু করে আমরাও তৈয়ার।এবার তাদেরকে উচিত শিক্ষা দেবো।এ সময়ে ধলাই যুদ্ধের মাত্র সূচনা হয়েছে।আক্রান্ত হবার পর পাক বাহিনী প্রচন্ড ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললে যৌথ বাহিনী হটে যেতে বাধ্য হয়েছিলো।তিনজন ভারতীয় সৈনিক ও দু’জন মুক্তিযোদ্ধার লাশ হানাদার বাহিনী উদ্ধার করে মৌলভী বাজারে নিয়ে এসেছিলো প্রদর্শনীর জন্য।লাশবাহী ট্রাকে চেপে ঐদিন মুসলিম লীগ নেতা মিছির উল্লা এবং তার সহযোগী পশ্চিমবাজারের জনৈক ব্যবসায়ী লাশের উপর দাড়িয়ে নেচে নেচে শহর প্রদক্ষিণের দৃশ্য এখনও চোখে গেঁথে আছে।এখন যেভাবে যুদ্ধংদেহী হয়ে যারা লাফাচ্ছেন এবং যে সমস্থ হুজুররা জেহাদী চীৎকার দিয়ে মাইকে গলা ফাটাচ্ছেন তাদের পূর্বসূরীরাও সেকালে তদ্রূপ লাফালাফি শুরু করেছিলেন।ফলাফল কি হয়েছিলো?
পাক ভারতের মিডিয়াতে দাপাদাপি ও কাদাছোড়াছুঁড়ি ,কূটনৈতিক বিতর্ক ও ডিগবাজী এবং ভূরাজনৈতিক নেতিবাচকতার উপর ভর করে দু’দেশ যখন রণউন্মাদনা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলো তখন সপ্তাহ দিনের মাথায় জয় পরাজয় নিশ্চিত হয়েছিলো।পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতীয়দের দাপট এবং পূর্ব ফ্রন্টে একাধিপত্যের প্রেক্ষাপটে হিম্মৎওয়ালী পাকিস্তানের অবস্থা হয়েছিলো চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো।৪৮ এবং ৬৫ সনের মতো ৭১ সনের যুদ্ধে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা তথা যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ সোভিয়েত রাশিয়ার ভেটোর বলে উড়ে যায়।যুদ্ধ শুরুর আগে চীন ও ইরান যে আশ্বাস দিয়েছিলো সে অনুয়ায়ী ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধে নামেনি। এদিকে মার্কিন নৌবহর দ্রুত গতিতে ধাবিত হলেও ভারত মহাসাগরে পৌছার আগেই গতি থামিয়ে দিয়েছিলো রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ পিছুধরার কারণে।বিধি বামে থাকার কারণে তাই পরাজয় অবধারিত হয়ে উঠেছিলো।পূর্ব ফ্রন্টের হিলি বেলুনিয়া চৌগাছা যশোর আশুগন্জ ঠাকুরগাঁও এবং মৌলভীবাজারের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও বাকী সব এলাকাতে পলায়ন এবং আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের উপায় ছিলোনা।পূর্বফ্রন্টে ৫ ডিভিশন সৈন্য এবং তাদের নেতৃত্বে ৪ জন জেনারেল ডজন খানেক মেজর জেনারেল এবং ৩০ জন ব্রিগেডিয়ার থাকার পরও ঐতিহাসিক সারেন্ডার দলিলে স্বাক্ষর করতে হয়েছিলো।পাকবাহিনীর বি টীম হিসেবে এদেশের লাখের কাছাকাছি রাজাকার আলবদর এবং আলশামস কে ট্রেনিং রপ্ত করায়ে মাঠে নামানো হয়েছিলো।কিন্তু যুদ্ধের সাইরেন বাজার সাথে সাথেই রাতারাতি তারা পগারপাড়ে চলে গিয়েছিলো।এদেশীয় পাকি দালাল যারা আজাদী রক্ষার নামে ভেঁদর নাচে ছিলো পারঙ্গম তারা চলে গেলো আত্মগোপনে।যে হুজুরেরা জেহাদী জোশে মাইক ফাটাতো তারা ধাশা ও জোব্বা খুলে হয়ে গিয়েছিলো লাপাত্তা। ধর্ম্মাস্ত্র,জোশ এবং তকবীর ও জিকির দিয়ে যে যুদ্ধ জয় হয়না সেটির উপলব্ধি সে সময়ও তাদের ছিলোনা এবং এখনও নেই।একই ভাবে ফালতু আবেগ এবং কল্পনা বিলাসও যুদ্ধের সামনে তৃণের সমান। এ সত্যটি অবহিত হয়ে যেদেশ বা জাতি যুদ্ধে নামে সে জাতির কপালে দুর্গতি থাকে।
সরওয়ার আহমদ ঃ প্রবীন সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা গবেষক