Sharing is caring!
সালেহ আহমদ (স’লিপক):
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের বাজরাকোনায় ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফরসঙ্গী হযরত শাহ্ মইন উদ্দিন (রহ.) এর মাজারকে ঘিরে প্রতি বছরের ন্যায় পবিত্র ওরুস মোবারক উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী হুদা ভাতের মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই মাজারে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ছোট বড় হাঁড়ি-পাতিল ভর্তি সাদাভাত আর ক্ষীর নিয়ে ছুটে আসছেন। মাজার সংলগ্ন বিশাল বড় দু’টি স্থায়ী পাকা পাত্রে শিরণী সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিরণী মিশ্রণে ব্যস্ত স্বেচ্ছাসেবকরা। সেই সকাল থেকে শুরু হয়ে আসরের নামাজের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত এসে সংগ্রহকৃত শিরণী শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকরা বড় বড় গামলায় (বউল) নিয়ে মাজার সংলগ্ন বিশাল মাঠে অপেক্ষমান মানুষের মাঝে বিতরণ করেন।
প্রতিবছর ওরুস মোবারক উপলক্ষে হযরত শাহ্ মইন উদ্দিন (রহ.) এর মাজার কমিটি আয়োজন করে খতমে কোরআন, খতমে, খতমে খাজেগান, হালকা জিকির, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। নারী ও পুরুষ ভক্তদের জন্য পৃথকভাবে আছে ইবাদতের নির্ধারিত স্থান। ওরুস উপলক্ষে মাজারে বা এর আশেপাশে কোনোপ্রকার গান বাজনা কিংবা শরিয়ত বিরোধী কোনোপ্রকার অশ্লীলতা বা বেহায়াপনার স্থান নেই। নেই টাকা উত্তোলনের কোনপ্রকার ফিকির। ভক্তদের স্বইচ্ছায় দানকৃত টাকা ব্যবহৃত হয় মাজার, এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার উন্নয়নে।
আয়োজনকে ঘিরে মাজার সংলগ্ন বিশাল খোলা মাঠে বসে মেলা বা বান্নি। মেলায় দৈনন্দিন কাজের পণ্যসামগ্রী, খেলনা, ইমিটেশন, খাবারসামগ্রী, খাবারের হোটেল সহ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবজিও বিক্রি হয়। বিক্রেতা জানান এ মেলায় অন্য মেলার মতো কর্তৃপক্ষকে টোল হিসেবে আলাদা চাঁদা দিতে হয় না। তাই তাদের বেচাবিক্রি যেমন ভালো, তেমনি আয়-রোজগারও ভালো হয়।
মাজারে শিরণী নিয়ে আসা এবং নিতে আসা ভক্তবৃন্দের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, এখানে যেকোন নেক নিয়ত করে আসলে আল্লাহর রহমতে নিয়ত কবুল হয়। এর অনেক ফল আমরা পেয়েছি। তাই প্রতিবছর সাদাভাতের মেলায় আসি।
সেচ্চাসেবকদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, আমরা জন্মের পর থেকে দেখে আসছি এখানে হুদা ভাতের মেলাতে প্রতিবছর পুলাও আর ক্ষীর বিতরণ করা হয়। আমরা এলাকাবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেচ্চাসেবক হিসেবে কাজ করি।
বাজরাকোনা জামে মসজিদের সহ-সভাপতি সুমন বক্স আনসারী বলেন, প্রায় ১৫/২০ হাজার মানুষ আসেন শিরণী খাওয়ার জন্য। লাইন ধরে মানুষ শিরণী খান। আমি কখনো দেখিনি এখানে শিরণী সর্ট হয়েছে বা কেউ পায়নি।
মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ভিপি মিজানুর রহমান মিজান বলেন, আজকে ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফরসঙ্গী শাহ মঈন উদ্দিনের ওরুস মোবারক। প্রতি বছর মাঘ মাসের পহেলা বুধবার ওরুস পালন হয়। এখানে দুরদুরান্ত থেকে এবং পাশ্ববর্তী ইউনিয়নগুলো থেকে মানুষ শিরণী নিয়ে আসে। একটা নির্ধারিত স্থানে শিরণী রাখা হয় এবং হাজার হাজার মানুষের মাঝে সুন্দর-সুশৃঙ্খলভাবে শিরণী বিতরণ করা হয়। শিরণী বিতরণ পূর্বে মিলাদ এবং দেশ-বিদেশে বসবাসকারী সবার জন্য দোয়া হয়।
হযরত শাহ মঈন উদ্দিন (রহ.) মাজারের মোতাওয়াল্লী মোঃ আজাদ মিয়া জানান, হযরত শাহ্ জালাল (রহ.) এর সাথের পীর তিনি। প্রায় ৭০০ বছর ধরে এখানে ওরুসে আগত ভক্তদের মাঝে সাদাভাত আর ক্ষীর শিরণী বিতরণ করা হয়। পীরসাব জীবিত থাকা অবস্থায় এখানে গরু শিরণী করা হতো। তখন এক চোর গরু এনে বিক্রি করেছিল। গরু জবাই করে শিরণী তৈরির প্রস্তুতি নেয়াকালে গরুর মালিক এসে শিং ও চামড়া চেখে তার গরু দাবী করলে পীরসাব বললেন, তুমি বাড়ি চলে যাও। তোমার গরু হলে বাড়িতে যাবে। পীরসাব গরুর হাড়, চামড়া, শিং একত্র করে বললেন, তোমার মালিক তোমাকে খোজছে। তুমি তোমার বাড়ি যাও। তখন মালিকের পিছন পিছন গরুও বাড়িতে ফিরে যায়। তখন থেকে পীরসাব সবাইকে বললেন এখানে আর কখনো যেন শিরণীতে যেন রক্তওয়ালা কোন কিছু জবেহ করা না হয়। তখন থেকে এলাকার লোকজনেরা বাড়িতে সাদাভাত, সাদা পোলাও, ক্ষীর তৈরি করে নিয়ে আসেন। আমরা মাজারের পক্ষ থেকে কোনপ্রকার শিরণীর আয়োজন করি না।
উল্লেখ্য, প্রায় ছয় শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী ব্যতিক্রমী হুদাভাতের মেলা দর্শনার্থী ও ভক্ত-আশেকানদের মুগ্ধ করে। স্থানীয় বাসিন্দারা যত্ন করে ধরে রেখেছেন তাদের ঐতিহ্য। ভক্তরা আল্লাহ্র নামে নানা মনোবাসনায় শিরণী হিসেবে সাধ্যানুযায়ী সাদাভাত ও ক্ষীর নিয়ে আসেন এই ওলির মাজারে। সংগ্রহকৃত শিরণী পূনরায় অপেক্ষমানদের মাঝে বিতরণ করা হয়। নানা বয়সের লোকজন নানা মানতে এই শিরণী গ্রহণ করেন। রোগ-বালাই দূর করতে শিরণী খেয়ে অনেকেই বাড়িতে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যদের জন্য। বিভিন্নজনের বিভিন্নপ্রকার চালের রান্নাকৃত ভাতের সংমিশ্রণ হলেও তা খুবই সুঘ্রাণযুক্ত ও সুস্বাদু হয়। প্রতি বাংলাবর্ষের মাঘ মাসের প্রথম বুধবার হযরত শাহ্ মইন উদ্দিন (রহ.) এর মাজারকে কেন্দ্র করে এ আয়োজন হয়। স্থানীয়দের কাছে এটা হুদাভাতের শিরণী বা মেলা হিসেবে পরিচিত।
এই মাজারে কেন হুদাভাতের শিরণী বা মেলা হয় তার একটি ইতিহাস রয়েছে। হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামেনী (রহ.) এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ্ মইন উদ্দিন (রহ.) এই অঞ্চলে এসে ইসলাম প্রচারের জন্য হুজরা স্থাপন করেন। মহান এ ওলি জীবদ্দশায় তিনি মাজার এলাকায় গরু শিরণী করে ভক্তদের মাঝে বিতরণ করতেন। এক বছর শিরণীতে চুরি হয়ে যাওয়া অতিদরিদ্র একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর গৃহপালিত গরু জবাই করা হয়। ওই গরুটি চোরেরা চুরি করে বাজারে বিক্রি করলে তা অজান্তেই ক্রয় করে এনে শিরণীর জন্য জবাই করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী গরুর মালিক লোক মারফত খবর পেয়ে পীর সাহেবের কাছে এসে নালিশ করেন। পরে এই মহান ওলির শিরণীতে জবাইকৃত গরুর হাড় ও চামড়া মালিক শনাক্ত করলে মহান ওলি তাঁর ভক্তদের বলেন, ওখানে ওই চামড়ার উপর হাড় ও মাংস রাখতে। এরপর তারা তাই করলো। মহান ওলির কেরামতিতে ওই দরিদ্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি তার গরু ফিরে পান। এরপর থেকে হযরত শাহ্ মইন উদ্দিন (রহ.) স্থানীয় এলাকাবাসীকে ডেকে এই শিরণীতে সকল ধরনের পশু জবাই নিষিদ্ধ করেন। এলাকাবাসী ও মহান ওলির ভক্তবৃন্দরা এখন পর্যন্ত এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।